Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
আঁধারেই ঢাকা রইল ভূস্বর্গ

সিসের টুকরো স্বপ্ন কেড়েছে আকিবদের

তাঁর দু’চোখ ভরা স্বপ্নে ছুটে আসতেন জাহির খান! হা-করা চোখে দেখে নিজে থেকেই শিখে নিয়েছিল মসৃণ রান আপ, নিখুঁত ডেলিভারি। স্বপ্ন পূরণে এক সময়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মাঠে নিজেকে নিংড়ে দিত বছর ষোলোর আকিব রশিদ।

দৃষ্টি ফেরার অপেক্ষায়। হাসপাতালে আকিব রশিদ। শ্রীনগরে।— নিজস্ব চিত্র

দৃষ্টি ফেরার অপেক্ষায়। হাসপাতালে আকিব রশিদ। শ্রীনগরে।— নিজস্ব চিত্র

অনমিত্র সেনগুপ্ত
শ্রীনগর শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৩:৩৭
Share: Save:

তাঁর দু’চোখ ভরা স্বপ্নে ছুটে আসতেন জাহির খান! হা-করা চোখে দেখে নিজে থেকেই শিখে নিয়েছিল মসৃণ রান আপ, নিখুঁত ডেলিভারি। স্বপ্ন পূরণে এক সময়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মাঠে নিজেকে নিংড়ে দিত বছর ষোলোর আকিব রশিদ। কিন্তু অশান্তির উপত্যকায় একঝাঁক সিসের টুকরো তার চোখ দু’টোকে কালোয় ঢেকে দিয়েছে।

কালো চশমায় আড়ালে থাকা আকিবের চোখে আজ সব কিছুই ঝাপসা। আর স্বপ্ন নয়, সেখানে বাসা বেঁধেছে ছররা গুলি। প্রাথমিক চিকিৎসা করে কয়েকটা বের করা গিয়েছে। বাকিগুলো বের করতে শ্রী মহারাজা হরি সিংহ হাসপাতাল (এসএমএইচএস)-এ চোখের অপারেশনের জন্য হত্যে দিয়ে পড়ে রয়েছে আকিব ও তাঁর পরিবার। ক্রিকেট, জাহির খান এখন অনেক দূরের স্বপ্ন! আপাতত একটাই লক্ষ্য, চোখটা কী ভাবে বাঁচানো যায়!

আর পাঁচটার মতোই এ ক্ষেত্রেও অভিযোগের নিশানায় সেই ছররা বন্দুক। যা বাতিল করার প্রশ্নে বিতর্ক কম হয়নি। কমিটিও গড়েছিল কেন্দ্র। সুপারিশ এসেছে, একেবারে বাধ্য না হলে ব্যবহার করা যাবে না ওই বন্দুক। আকিবদের অভিযোগ, বাধ্য হলে কথাটাই তো বাজে কথা! তাঁকে তো বিনা প্ররোচনায় ছররা বন্দুকের নিশানা করা হয়েছে! আকিবের কথায়, ‘‘দিন তিনেক আগে লালচক এলাকায় ঝিলমের ধারে পাঁচ-সাত জন বন্ধু মিলে বসেছিলাম। এত জনকে একসঙ্গে বসে থাকতে দেখে আধা সেনা দল বেঁধে এসে আমাদের উঠে যেতে বলে। আমরা আপত্তি করতেই ক্ষেপে গিয়ে গুলি করে!’’ যা সোজা গিয়ে বিঁধে যায় আকিবের চোখে।

আকিবের পাশের বেডে শুয়ে থাকা একাদশ শ্রেণির ছাত্র পারভেজের চোখেও কালো চশমা। সে-ও ছররা বন্দুকের শিকার। শ্রীনগর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরের হামহামা এলাকায় মামাবাড়ি থেকে ফিরছিল সে। রাস্তায় ওমপোড়ার কাছে গণ্ডগোলের মধ্যে পড়ে যায়। তাকে পালাতে দেখে বিক্ষোভকারী সন্দেহে ছররা বন্দুক ছোড়ে নিরাপত্তাবাহিনী। এক ঝাঁক সিসের টুকরো বিঁধে গিয়েছে পারভেজের শরীরে, চোখেও।

প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, গত ৫৮ দিন ধরে চলা কার্ফুতে শ্রীনগরের বিভিন্ন হাসপাতালে প্রায় ৯ হাজার আহতের চিকিৎসা হয়েছে। এর মধ্যে শ্রীনগরের শ্রী মহারাজা হরি সিংহ হাসপাতালের চক্ষু বিভাগেই আটশোর বেশি লোক ভর্তি হয়েছেন চোখে ছররা বুলেটের আঘাত নিয়ে। যাঁদের বয়স পাঁচ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে! হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, আহতদের বেশির ভাগই বয়সে তরুণ। অনেকের চোখই এমন ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যে, ভবিষ্যতে তাঁরা আর দেখতে পাবেন না।

আর যাঁদের চোখ বেঁচে গিয়েছে? শরীরে ছররা নিয়ে তাঁরাও ভবিষ্যতে খুব স্বস্তিতে থাকবেন, এমন আশা দিচ্ছেন না চিকিৎসকেরা। ছররা বুলেট শরীরের গভীরে ঢুকে থাকায় আজীবন তাঁদের সমস্যায় পড়তে হতে পারে বলেই মত চিকিৎসকদের। ভবিষ্যতে ছররাবিদ্ধদের ক্যানসার-সহ বিভিন্ন চিকিৎসার জন্য এমআরআই করাও অসম্ভব। তা ছাড়া রেলস্টেশন, বিমানবন্দর, শপিং মলের মতো জায়গায় নিরাপত্তার প্রশ্নে মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে এঁদের পরীক্ষা করা হলে বিপদের আশঙ্কা থাকবে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। কাশ্মীর চিকিৎসক সংগঠনের সভাপতি নিসার উল হাসানের কথায়, ‘‘মেটাল ডিটেক্টর বা এমআরআই একটি শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে। সেই ক্ষেত্রের আওতায় এলে আহতদের শরীরের মধ্যে থাকা ধাতব ছররার বিপরীতমুখী সরণ হবে। যা শরীরের নরম পেশী থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গকে নষ্ট করে দিতে পারে।’’

তা হলে অপারেশন করে কেন বের করে দেওয়া হচ্ছে না এগুলো? হাসান বলেন, ‘‘ছররাগুলি ভীষণ ছোট, প্রচণ্ড গতিতে প্রবেশ করায় একেবারে শরীরের ভিতরে ঢুকে যায়। এগুলিকে চিহ্নিত করা গেলেও আয়তনে ছোট হওয়ায় এদের বের করতে গেলে উল্টে প্রচুর রক্তপাত এবং অভ্যন্তরীণ কোনও অঙ্গ নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।’’

চলতি অশান্তিতে ঘি ঢালার পিছনে ছররার ভূমিকা থাকায় সব দলই এর ব্যবহার বন্ধ করার দাবি তুলেছে। বিকল্প হিসেবে ঠিক হয়েছে, এখন থেকে ব্যবহার করা হবে ‘পাভা শেল’। লঙ্কার গুঁড়ো ভর্তি এই গ্রেনেড ফাটলে সাময়িক ভাবে চোখ জ্বালা, অস্বস্তিতে ভুগবেন বিক্ষোভকারীরা। কিন্তু ছররার মতো দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি হবে না। সূত্রের খবর, সর্বদলীয় প্রতিনিধি দল নিয়ে রাজনাথ সিংহের সঙ্গে সঙ্গে হাজার খানেক পাভা শেলও আজ পৌঁছে গিয়েছে উপত্যকায়। বিক্ষোভ মোকাবিলায় লঙ্কার গুঁড়ো কেমন কাজ দিচ্ছে, তা দেখে পরবর্তী ধাপে আরও পাভা শেল পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে নয়াদিল্লি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Youth Blind Unrest Kashmir Pellet gun
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE