তপন সিংহ পরিচালিত ‘কাবুলিওয়ালা’ ছবির দৃশ্য।
খোবানি-পেস্তা-বাদামের দিন শেষ। ‘হাঁতি’ নয়, পাওয়া যাচ্ছে দুম্বা!
আজকের ‘মিনি’ এবং তার পরিবারের জন্য কাবুলিওয়ালার ঝোলায় থাকছে দুম্বার শুকনো মাংস, কন্দহরের খরবুজা, ‘হিন্দুস্তানি’ ব্র্যান্ডের কাপড় কিংবা তা দিয়ে তৈরি আফগানি স্যুট।
তালিবানের সঙ্গে যুদ্ধের পর আফগানিস্তানের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য আগের তুলনায় অনেকটাই মসৃণ হয়েছে। তার সঙ্গে বদলাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে থেকে যাওয়া পাখতুনদের পেশার ধরন, জীবনযাত্রা। বদলে যাওয়া সময়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে ডানলপ, কাশীপুর, বারুইপুর, টিটাগড়ের বাসিন্দা প্রায় সাড়ে তিন হাজার কাবুলিওয়ালা জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন নিজেদের মতো করে।
বিদেশ মন্ত্রকের মতে, গত এক দশকে ভারত-আফগানিস্তান বাণিজ্যের অভিমুখ ঊর্ধ্বমুখী। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ৫০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছে অনেক আগেই। চেষ্টা চলছে আফগানিস্তানের পণ্য যাতে ভারতের বাজারে বিনা বাধায় ঢুকতে পারে, তার জন্য সব রকম আইনকানুন শিথিল করার। আফগান প্রেসিডেন্ট আশরফ ঘানির এ বারের ভারত সফরেও দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। ঘানি এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, দু’জনেই এ ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছেন। আর এ সবেরই সুফল পাচ্ছেন আজকের রহমতেরা।
তিন চার পুরুষ ধরে কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল এঁদের ভিটেমাটি। তবু ঢাকা পড়ে না ছিন্নমূলের পাসপোর্ট-হীন জীবনের যন্ত্রণা। তার উপর তালিবান যুদ্ধের পরোক্ষ পরিণতি হিসেবে এসেছে দারিদ্র্য। প্রতিনিয়ত সমস্যার মুখোমুখি হয়ে ২০০০ সালে তৈরি হয়েছিল একটি সংগঠন— ‘খুদাহি খিদমদগর’ (এই নামটি খান আব্দুল গফ্ফর খানের স্মৃতিধন্য)। কালক্রমে এই সংগঠন গোটা ভারতের পাখতুন মানুষের সামাজিক মঞ্চ হিসেবে গড়ে ওঠে। এই সংগঠনের (সদস্য সংখ্যা প্রায় হাজার দশেক) প্রেসিডেন্ট আমির খান তিন পুরুষ ধরে কাশীপুরের বাসিন্দা। তাঁর বাড়িটির বয়সও প্রায় দেড়শো বছর। বাপ-পিতেমোর ছিল জমজমাট মহাজনী কারবার। শালপ্রাংশু এই আফগান জানাচ্ছেন, ‘‘মহাজনী কারবারের সেই রমরমা আজ আর নেই। দিনকাল বদলেছে। ছোট-বড় ব্যাঙ্ক, অজস্র টাকা দেনেওয়ালা সংস্থা। অনেক তাদের কোমরের জোর, পুঁজি এবং বিপণন কৌশল। তাদের সঙ্গে আমরা পেরে উঠব কী করে!’’
এই সঙ্কটবিন্দু থেকেই নতুন চিন্তা-ভাবনার শুরু, জানাচ্ছেন আমির। পাশাপাশি, বাপ-ঠাকুর্দার আমলের সেই খোবানি-কিসমিসে আটকে না থেকে (আজকের দুনিয়ায় যার ‘ইউএসপি’-ও আগের মতো নেই) নতুন পরিস্থিতিতে নতুন ব্যবসা-চিন্তারও সূত্রপাত হয়েছে ধীরে ধীরে। আমিরের কথায়, ‘‘আগে আফগানিস্তান থেকে হরেক রকম জিনিস আনার সুযোগ ছিল না। তালিবান আমলে তো কাবুল থেকে পুরোপুরিই আমদানি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তখন নেহাতই ঝুট বলে কলকাতায় বিক্রি করতে হতো অন্য রাজ্যের বাদাম-আখরোট। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলে গিয়েছে।’’
সেই নতুন পণ্যের মধ্যে চাহিদার দিক থেকে এক নম্বরে রয়েছে রয়েছে দুম্বার মাংস। এটি ভারতের পাখতুন পরিবারগুলিতে জনপ্রিয়তা তো পাচ্ছেই, ধীরে ধীরে জিভে জল আনছে বড়বাজার-চাঁদনি মহল্লাতেও। বাঙালিরাও নাকি ইদানীং আগ্রহ দেখাচ্ছেন এই মাংসের সুরুয়ায়। আশি বছর আগে মুজতবা আলি তাঁর ‘দেশে বিদেশে’ গ্রন্থে যে ঘ্রাণ ছড়িয়েছিলেন, তা হয়তো আবার ফিরে আসছে। মুজতবা আলি বর্ণিত, কাবুলের সেই খানসামা আগা আবদুর রহমানের তৈরি, ‘ঘিয়ের ঘন ক্কাথে সেরখানেক দুম্বার মাংস— তার মাঝে মাঝে কিছু কিছু বাদাম কিসমিস লুকোচুরি খেলছে…।’ দুম্বার মাংসের ব্যবসায়ী মহম্মদ নাজিমের বাসা দমদম। দু’তিন মাস অন্তর তাঁর অস্থায়ী ঠিকানা হয় দিল্লির চাঁদনি চকের কাছে বিল্লিমারাও গলিতে। কারণ এখানেই বছরে বেশ কয়েক বার আফগানিস্তানের ধনী ব্যবসায়ীরা কাবুল থেকে শুকনো দুম্বার মাংস নিয়ে আসেন। পুরনো দিল্লিতে তার পাইকারি বিক্রির ব্যবস্থা হয়। নাজিমের কথায়, ‘‘আমরা দিল্লি থেকে ৬০০ টাকা কেজি দরে মাংস কিনে কলকাতা ফিরি। পশ্চিমবঙ্গে তা দ্বিগুণ, তিন গুণ দামেও বিক্রি হয়। ঈদের সময় এই বিক্রি আরও বাড়ে।’’
সুরাত থেকে সস্তায় ভারতীয় ব্র্যান্ডের কাপড় কিনে এনে আফগানি স্যুট বানানোর ছোট দোকানও শুরু করেছেন এই কাবুলিওয়ালারা। কলকাতায় তৈরি করে এই স্যুটের রফতানি হয় অসম, পটনা, রাঁচিতে (সেখানে পাখতুন সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ রয়েছেন যথেষ্ট)। পাশাপাশি, দীর্ঘদিন ভারতে থাকতে থাকতে অনেক পরিবারই প্রণয়সূত্রে আবদ্ধ হচ্ছেন ভারতীয় পরিবারের সঙ্গে। তেমনই এক জন, ইমাম বললেন, ‘‘আমার নিজের মেয়েরই তো বিয়ে দিয়েছি রাজাবাজারের এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে। দিব্যি সুখে রয়েছে তারা।’’ ফলে বৈবাহিক সূত্রেও কলকাতার মুসলিমদের মধ্যে মিশে যাচ্ছে আফগান রক্ত। ছড়িয়ে যাচ্ছে পেশার সুযোগও। কাপড়ের ব্যবসায়ী নাজির মহম্মদ জানালেন, ‘‘আমার ছেলে আর পৈতৃক ব্যবসায় থাকতে চাইছে না। কম্পিউটার নিয়ে পড়াশোনা করছে ও। ইচ্ছে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার।’’
‘দুইধারে বন্ধুর দুর্গম দগ্ধ রক্তবর্ণ উচ্চ গিরিশ্রেণী, মধ্যে সংকীর্ণ মরুপথ, বোঝাই করা উষ্ট্রের শ্রেণী চলিতেছে….কাহারও হাতে বর্শা, কাহারও হাতে সেকেলে চকমকি ঠোকা বন্দুক’—নব্য কাবুলিদের ঝোলায় কলকাতার বাবুদের শোনাবার জন্য পূর্বপুরুষদের এই গল্পও বোধহয় আর থাকবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy