বাংলাদেশের কারাগারে ১৮ বছর কাটিয়ে অবশেষে ভারতে ফিরলেন এক সময়ে অসম কাঁপানো জঙ্গি সংগঠন আলফার সাধারণ সম্পাদক গোলাপ বরুয়া ওরফে অনুপ চেটিয়া। দীর্ঘ কূটনৈতিক টালবাহানার পরে গত কাল গভীর রাতে ঢাকায় কাশিমপুর কারাগার থেকে বার করে ভারতীয় দূতাবাসের হাতে তুলে দেওয়া হয় চেটিয়াকে। সেখান থেকে সিবিআই দুই সঙ্গী-সহ এই জঙ্গি নেতাকে ভারতে নিয়ে আসে। এই হস্তান্তরের জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আজ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
নয়াদিল্লির বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্রে বলা হয়েছে, দীর্ঘ দিন এই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তটি আটকে ছিল। দু’দেশের মধ্যে পূর্ণ সহযোগিতার ফলেই এ’টি সম্ভব হল। বাংলাদেশ দূতাবাসের এক কর্তার মতে, ‘‘ছিটমহল হস্তান্তরের পরে চেটিয়ার হস্তান্তর একটি অত্যন্ত ইতিবাচক ঘটনা।’’ বিদেশ মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, প্রায় দু’দশক ধরেই বাংলাদেশের জেলে বন্দি অনুপ চেটিয়াকে দেশে ফেরত দেওয়ার দাবি জানাচ্ছে ভারত সরকার। গত মে মাসে ঢাকা সফরের সময়েও চেটিয়াকে হস্তান্তরের বিষয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। সে সময়েই চেটিয়াকে ফেরাতে রাজি হয়ে যায় বাংলাদেশ সরকার। তার পরে আইনি জটিলতা কাটাতে আরও কিছু সময় লাগল।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রের খবর, আজ বেলা সওয়া ১২টা নাগাদ বিমানে করে চেটিয়া ও তাঁর দুই সঙ্গী আরও দুই আলফা সদস্য মঙ্গলদইয়ের মনোজ গোস্বামী এবং নগাঁও বেবেজিয়ার লক্ষ্মীপ্রসাদ গোস্বামীকে নিয়ে দিল্লি আসে সিবিআইয়ের দলটি। সরকারি ভাবে চেটিয়ার প্রত্যার্পণের কথা ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ জানান। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরেণ রিজিজু দাবি করেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ব্যক্তিগত উদ্যোগেই এই সাফল্য এসেছে। চেটিয়া দেশে ফেরায় আলফার সঙ্গে আলোচনা প্রক্রিয়া নতুন গতি পাবে।’’ ছোটা রাজনকে ভারতে আনার এক সপ্তাহের মধ্যেই চেটিয়াকে হাতে পাওয়া বড় সাফল্য বলেই দাবি করছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।
বর্তমানে আলফার সঙ্গে শান্তি চুক্তি নিয়ে আলোচনা করছে কেন্দ্র। আলফার পক্ষ থেকে সেই আলোচনার নেতৃত্ব দিচ্ছেন সংগঠনের চেয়ারম্যান অরবিন্দ রাজখোয়া। চেটিয়াকে হাতে পাওয়ায় ওই আলোচনা বাড়তি ওজন পাবে বলে মনে করছে কেন্দ্র। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের আশা, আগামী মাসের মধ্যে আলফার সঙ্গে শান্তি চুক্তিও সেরে ফেলা সম্ভব হবে। এ দিন অসমের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈয়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন রাজনাথ। অসমে চেটিয়ার বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলির ব্যাপারে খবর
নেন তিনি।
১৯৬৭ সালে জেরাই গাঁওয়ে গোলাপ ওরফে অনুপের জন্ম। ১৯৭৯ সালে, শিবসাগরে রংঘরের সামনে পরেশ বরুয়া, অরবিন্দ রাজখোয়া, ভীমকান্ত বুড়াগোঁহাইদের সঙ্গে মিলে তিনি ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব অসম বা আলফার জন্ম দেন। অনুপ, সুনীল বরুয়া-সহ বিভিন্ন নাম নিয়ে পালিয়ে বেড়ানো অনুপ বাংলাদেশে ভাইজান ও আহমেদ নামেও পরিচিত ছিলেন। হত্যা, অপহরণ, ডাকাতির বিভিন্ন মামলার অভিযুক্ত অনুপকে ১৯৯১ সালে প্রথম বার গ্রেফতার করে অসম পুলিশ। কিন্তু, তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী হিতেশ্বর শইকিয়ার হস্তক্ষেপে তিনি মুক্তি পান। এর পরেই দেশ ছাড়েন তিনি। পাকিস্তান-সহ বিভিন্ন দেশে গিয়ে অর্থ ও অস্ত্র সংগ্রহ করা অনুপকে ১৯৯৭ সালের ২১ ডিসেম্বর ঢাকায় গ্রেফতার করে বাংলাদেশ পুলিশ। ভুয়ো পাসপোর্ট নিয়ে দেশে ঢোকা, ১৬টি দেশের মুদ্রা বহন করা এবং বেআইনি অস্ত্র সঙ্গে রাখার তিনটি অভিযোগে আদালত তাঁকে সাত বছর কারাদণ্ড দেয়। ২০০৩ সালে চেটিয়া ঢাকা হাইকোর্টে আবেদন জানান— তাঁর প্রাণের ভয় রয়েছে। জেল থেকে বেরোলেই ভারতীয় গোয়েন্দারা তাঁকে হত্যা করতে পারে। তাই তিনি কারাগারেই থাকতে চান। হাইকোর্ট চেটিয়ার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ সরকারকে। তাই কারাবাসের মেয়াদ ফুরোনোর পরেও নিরাপদ হেফাজতে তাঁকে জেলেই রেখে দেয় বাংলাদেশ সরকার। দিল্লির আর্জি সত্ত্বেও দেশে ফেরানো হয় না।
পরিস্থিতি বদলায় শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পরে। বাংলাদেশ থেকে আলফার সব ঘাঁটি তিনি ভেঙে দেন। ২০০৯ সালে অবিভক্ত আলফার সভাপতি অরবিন্দ রাজখোয়া, তাঁর স্ত্রী তথা মহিলা বাহিনীর প্রধান কাবেরী কছারি রাজখোয়া, অর্থসচিব চিত্রবন হাজরিকা, সংস্কৃতিসচিব প্রণতি ডেকা ও বিদেশসচিব শশধর চৌধুরীকে ঢাকা থেকে আটক করে ভারতের হাতে তুলে দেওয়া হয়। ২০১১ সালে আলফার আরও তিন নেতাকে ভারতে ‘পুশ ব্যাক’ করে বাংলাদেশ। তখনও ভারতে আসতে প্রবল আপত্তি ছিল চেটিয়ার। পরে কেন্দ্রের সঙ্গে আলফার শান্তি আলোচনা শুরুর পরে আলফার তরফে চেটিয়াকে ভারত আসতে অনুরোধ করা হয়। ২০১৩ সালে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তিও স্বাক্ষর হয়ে যায়। ২০১৪ সালে তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব অনিল গোস্বামীর সঙ্গে বৈঠকের পরে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রসচিব মোজেম্মেল হক জানিয়েছিলেন, চেটিয়া এত দিনে ভারতে ফিরতে রাজি হয়েছেন। কিন্তু চেটিয়ার বদলে, নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার প্রধান আসামি নুর হোসেনকে জিম্মায় চায় বাংলাদেশ। নুর এখন দমদম জেলে বন্দি। কলকাতা পুলিশ সূত্রে খবর, আগামী ২-৩ দিনের মধ্যেই নুরকে বাংলাদেশের হাতে তুলে দেওয়া হতে পারে।
বার বার আশা জাগিয়েও চেটিয়ার ঘরে ফেরা যে ভাবে বাতিল হয়েছে— তাতে তাঁর পরিবার আশা ছেড়েই দিয়েছিল। কিন্তু গত বছর মে মাসে হঠাৎই বাংলাদেশ থেকে জেরাই গাঁওয়ে ফিরে আসেন অনুপের স্ত্রী মনিকা বরা চেটিয়া, ২২ বছরের ছেলে জুমন ও ১৮ বছরের মেয়ে বুলবুলি। দু’জনই ঢাকায় পড়াশোনা করছিল। তখন থেকেই অনুপের ফেরার প্রক্রিয়াও শুরু হয়। যা শেষ হল আজ। মণিকাদেবী সকালেই জেরাই গাঁও থেকে গুয়াহাটি রওনা হন। তবে স্বামীর সঙ্গে কথা হয়েছে কি না, তা নিয়ে মুখ খুলতে চাননি তিনি। শুধু বলেন, ‘‘আজ আমার জীবনে সব চেয়ে বড় দীপাবলি। ১৯৯৭ সালের ২১ ডিসেম্বরের পর থেকে স্বামীকে দেখিইনি। কবে ফের তাঁকে দেখব সেই অপেক্ষায় আছি।’’ খবর পেয়ে, আজ চেটিয়ার বাড়িতে ঘুরে যান প্রতিবেশী পরেশ বরুয়ার ভাই বিকুলও। চেটিয়া ভারত ফেরায় তিনিও খুশি। একই ভাবে নগাঁওয়ে লক্ষ্মীপ্রসাদ ও মঙ্গলদইয়ে মনোজবাবুর পরিবারেও খুশির হাওয়া। আলফার আলোচনাপন্থী নেতা শশধর চৌধুরী, মৃণাল হাজরিকা, জিতেন দত্তরা বাংলাদেশ ও ভারত সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, চেটিয়ার প্রত্যাবর্তনের ফলে দ্রুত আলোচনা শেষ হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy