সেই জমিদার নেই, নেই সেই জমিদারিও। কিন্তু গত ২৬৪ বছর, মতান্তরে ২৯৯ বছর ধরে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে চলে আসছে রাঙ্গাউটির পুরকায়স্থ বাড়ির দুর্গা বন্দনা। শুধু হাইলাকান্দি নয়, বরাক উপত্যকারও এতি প্রাচীন পারিবারিক পুজো এই পুরকায়স্থদের পুজো।
অখণ্ড ভারতের তৎকালীন বরাক উপত্যকায় কাছাড়ি রাজার দান করা ভূমিতে জমিদারি স্থাপন করেছিলেন পুরকায়স্থ বাড়ির পূর্বপুরুষরা। সে তিনশো বছর আগের কথা। জমিদারির সঙ্গে স্বাভাবিক অনুষঙ্গ হিসেবেই এসেছিল দোল-দুর্গোৎসব। পুরকায়স্থ বাড়ির বর্তমান প্রজন্মের প্রতিনিধি দেবদাস পুরকায়স্থই এখন এই পারিবারিক পুজো পরিচালনার মুখ্য দায়িত্বে।
দেবদাসবাবুর কথায়, পরিবারের পূর্বপুরুষ কুলচন্দ্র শর্মার হাত ধরেই এই এলাকায় পুরকায়স্থদের জমিদারির শুরু। কুলচন্দ্র শর্মা বর্তমান বাংলাদেশের সাতগাঁও এলাকার বালিশিরায় একটি আশ্রমের কর্ণধার ছিলেন। সেই সময় বরাক-সহ এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে ছিল কাছাড়ি রাজার রাজত্ব। পরাক্রমশালী কাছাড়ি রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমন্ত্রণে আনুমানিক ১৭০০ সালে কুলচন্দ্র সেই আশ্রম ছেড়ে বর্তমান হাইলাকান্দি জেলায় এসে মুরখাগোল গ্রামে এসে নতুন করে একটি আশ্রম স্থাপন করেন। পুরকায়স্থ পদবিটি রাজারই দেওয়া। তাঁর কয়েক বছর পর রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের ইচ্ছাতেই কুলচন্দ্রের পুত্র গোকুল চাঁদ শর্মা কাছাড়ি রাজাদের রাজগুরু নিযুক্ত হন। রাজার অনুজ্ঞাতেই রাজগুরু পরিবার ‘পুরকায়স্থ’রা বর্তমান হাইলাকান্দির রাঙ্গাউটি গ্রামে জমিদারির পত্তন করেন।
কাছাড়ি রাজার কাছ থেকে গুরুদক্ষিণা হিসেবে বরাকের রাঙ্গাউটি সহ প্রায় চার হাজার একর নিস্কর জমি পান তাঁরা। বাৎসরিক দেড়টাকার বিনিময়ে দশ হাজার প্রজার বসতি স্থাপন করিয়েছিলেন পুরকায়স্থরা। সেই আমল থেকে আজ অবধি পুরকায়স্থ বাড়ির পুজো আয়োজিত হয়ে আসছে। সেই হিসেবে পুজোর বয়স ২৬৪। অবশ্য অন্য মত হল, মুরগাখোল আশ্রমেই পুরকায়স্থ বাড়ির পুজোর শুরু। সেই হিসেবে পুজোর বয়স ২৯৯ বছর।
সাল-তামামির বিতর্ক বাদ দিলে অবশ্য শুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল, বরাকের অন্যতম প্রাচীন এই পারিবারিক পুজো বিরামহীন ভাবে আয়োজিত হয়ে আসছে। ‘জাতক শৌচ’, ‘মৃতাশৌচ’ পুজো কখনও বন্ধ হয়নি। এ পুজোর নিয়ম, পুজোর দিনগুলিতে পুরকায়স্থ বাড়ির কোন সদস্যের মৃত্যু হলে বা অন্য কোনও কারণে অশৌচ হলেও পুজো বন্ধ হবে না। সে অবস্থায় পুজো পরিচালনার দায়িত্ব গ্রামবাসীদের।
শতবর্ষ আগে পুরকায়স্থ বাড়ির যে মণ্ডপে পুজো অনুষ্ঠিত হতো, এখন তা জরাজীর্ণ ভগ্ন-অবস্থায়। পুরকায়স্থ বাড়ির প্রবীণতম ব্যক্তি কিশোরীমোহন পুরকায়স্থ অতীতের স্মৃতি অনর্গল আউড়ে যেতে পারেন। তাঁর কথায়, বর্তমানে প্রাচীন এই পারিবারিক পুজোর ধারাবাহিকতা ধরে রাখা হলেও অতীতের সেই জৌলুস আর নেই। আগে পুরকায়স্থ বাড়ির পুজোয় দেশ-বিদেশের যাত্রাদল, কীর্তনীয়ার দল তিন দিন ধরে গান বাজনার আসর বসাত রাঙ্গাউটিতে। পুজোর অনেক আগে থেকেই এই পরিবারের সদস্য কুঞ্জবিহারী পুরকায়স্থ ঘুরে ঘুরে পালা-দল বেছে আনতেন।
এই পুজোর বিশেষত্ব: দুর্গা, লক্ষ্মী এবং সরস্বতীকে নিয়ে এক কাঠামোর প্রতিমা।
হাইলাকান্দি শহর থেকে আড়াই কিলোমিটার দূরে, রাঙ্গাউটি গ্রামে অতীতের স্মৃতি আঁকড়ে পুরকায়স্থ বাড়ি এখনও দাঁড়িয়ে আছে। তবে পুরকায়স্থ বাড়ির বর্তমান প্রজন্মের সদস্যরা নতুন করে একটি পুজো মন্ডপ তৈরি করেছেন। ষষ্টীর দিন এটির উদ্বোধন করা হবে বলে পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন। পুরকায়স্থ বাড়ির ৫২টি পরিবার দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন। পুজোর টানে তাঁদের অনেকেই এই বাড়িতে এসে সকলের সঙ্গে কয়েকদিন কাটিয়ে যান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy