Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

‘গাঁধীর স্বরাজ আর সঙ্ঘের রাষ্ট্র এক নয়’

নাগপুরের দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলে হেডগেওয়ার ছিলেন কলকাতার ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তন ছাত্র, অনুশীলন সমিতির প্রতি আকৃষ্ট।

ছবি: পিটিআই।

ছবি: পিটিআই।

গৌতম চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০১৯ ০২:৪৩
Share: Save:

একদা কলকাতার বাসিন্দা ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা কেশব বলিরাম হেডগেওয়ারের কথা ধরেই মহাত্মা গাঁধীর সার্ধশতবর্ষে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানালেন সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত। এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, ‘‘আমাদের সকলের মহাত্মা গাঁধীর জীবনদৃষ্টি অনুসরণ করা উচিত।’’ অতঃপর ইতিহাসের স্মৃতি টেনে দাবি করেছেন, সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা হেডগেওয়ার গাঁধীকে ‘পুণ্যপুরুষ’ আখ্যা দিয়েছিলেন।

নাগপুরের দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলে হেডগেওয়ার ছিলেন কলকাতার ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তন ছাত্র, অনুশীলন সমিতির প্রতি আকৃষ্ট। ১৯২০ সালে কলকাতায় কংগ্রেসের অধিবেশনেরও সদস্য তিনি। ইতিহাসবিদ দীপেশ চক্রবর্তী বললেন, ‘‘জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে তখন অনুশীলন সমিতি, কংগ্রেস, সমাজবাদী প্রতিটি সুতোই বাকিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত। হিন্দু মহাসভার অধিবেশনে লালা লাজপত রায়, মতিলাল নেহরু, মদনমোহন মালব্যের মতো কংগ্রেস নেতারা উপস্থিত থাকতেন। হেডগেওয়ারের কথায় তাই অবাক হওয়ার কিছু নেই।’’

অর্থাৎ বলতে চাইছেন যে, ‘কংগ্রেস এবং অন্য কেউ কিছু করেনি, আমার দলের মহামানব এসেই দেশকে বাঁচালেন’ গোছের রাজনৈতিক বয়ানের চল তখন ছিল না? শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ হেসে বললেন, ‘‘হেডগেওয়ার ১৯৩৪ সালেই বলে দিয়েছিলেন, রাজনীতি বিষয়ে সঙ্ঘ উদাসীন। অন্য দলের সঙ্গে তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই, সে খাদির সমর্থক এবং অস্পৃশ্যতা বর্জনের বিরোধী নয়। তখনকার কংগ্রেস আর সনিয়া-রাহুলের কংগ্রেস যেমন এক নয়, হেডগেওয়ারের সঙ্ঘ আর আজকের সঙ্ঘও এক নয়।’’

ইতিহাসবিদ গৌতম ভদ্র আবার এত কথায় নারাজ। ভাগবতের লিখিত শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের শুরুটা দেখেই তিনি বিরক্ত। সরসঙ্ঘচালক সেখানে লিখেছেন, ‘‘ভারত আধ্যাত্মিক দেশ। আধ্যাত্মিক পথেই এর উত্থান হবে বলে চেয়েছিলেন গাঁধী।’’ গৌতমবাবুর বক্তব্য, ‘‘গাঁধী কখনওই আধ্যাত্মিক দেশ বলেননি। উনি ধর্মের কথা বলেছেন, রামরাজ্যের কথা বলেছেন। কিন্তু সেই রাম অযোধ্যায় থাকেন না, অস্তিত্বের ভিতরে তাঁর স্বর অনুভব করা যায়। ইনার ভয়েস!’’

সেই অন্তর্গত স্বর থেকেই গাঁধী ক্ষুধা, দারিদ্র ঘোচানোর কথা বলেন, চম্পারণে কৃষকদের সত্যাগ্রহে উদ্বুদ্ধ করেন। তাঁর অহিংসা দুর্বলের অজুহাত নয়। ‘‘আমি প্রতিবাদী এবং শক্তিমান। তাই অহিংসা আমার কাছে শুধু পথ নয়, পাথেয়।’’ দীপেশ চক্রবর্তীর মতে, ‘‘জেহাদি অহিংসা বলতে পারেন।’’ গৌতমবাবুও একমত। স্বাধীনতার পর ১৯৪৮ সালে গাঁধীর শেষ অনশনের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন তিনি। পাকিস্তানকে ৫৫ কোটি টাকা দিতে হবে, নেহরু-পটেল সবাই নারাজ। তাঁদের আশঙ্কা, পাকিস্তান ওই টাকা পেলেই অস্ত্র কিনবে। কিন্তু গাঁধীর মত অন্য। অস্ত্র কিনলে কিনুক, তখন বোঝা যাবে। সেই হামলা প্রতিরোধের শক্তি আমাদের আছে। কিন্তু সত্যভ্রষ্ট হওয়া যাবে না। সত্যাগ্রহ যে ‘সার্জিকাল স্ট্রাইক’-এর চেয়ে বড় অস্ত্র, মোহন ভাগবত তাঁর গাঁধী-শ্রদ্ধার্ঘ্যে সে কথা জানাননি। তাঁর ব্যাখ্যায় গাঁধীর ‘হিন্দ স্বরাজ’ প্রায় ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র পূর্বসূরি হয়ে উঠেছে।

গাঁধীজয়ন্তীর প্রাক্কালে মোহনের আক্ষেপ, ‘‘পরাধীনতার ফলে তৈরি গোলামি মানসিকতা যে কী ক্ষতি করতে পারে, গাঁধী বুঝতেন। স্বদেশি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লেখা ‘হিন্দ স্বরাজ’-এ তাই এক ছাত্রের চরিত্র এসেছিল। তৎকালীন রাজনীতিবিদরা দেশের পূর্ব গৌরব ভুলে পশ্চিমের অন্ধ অনুকরণ চালিয়ে যেতেন। তার প্রভাব আজও দেখা যাচ্ছে।’’ শেষে তিনি আশা ব্যক্ত করেছেন, ‘‘গাঁধীর পথ ধরেই ভারত আবার বিশ্বগুরু হয়ে উঠবে।’’

এইখানেই অবশ্য সঙ্ঘ-শ্রদ্ধার্ঘ্যের সবচেয়ে বড় বিভ্রান্তি— বলছেন দুই ইতিহাসবিদই। তাঁদের মতে, ‘‘হিন্দ স্বরাজ নিছক স্বদেশির কথা বলে না। সে আধুনিকতার বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গভীর নৈরাজ্যবাদের কথা বলে। সঙ্ঘের রাষ্ট্রবাদের সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই।’’ ‘আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতা আমাদের অ-সভ্য করে,’ ওই বইয়ে লিখেছিলেন গাঁধী। ‘হিন্দ স্বরাজ’ আর ‘হাউডি মোদী’ মেলে না কিছুতেই!

জ্ঞানপীঠজয়ী প্রয়াত গুজরাতি সাহিত্যিক উমাশঙ্কর জোশী বলতেন, ভারতে দু’পাঁচ বছর অন্তর কোনও না কোনও মহাত্মার জন্ম হয়, কিন্তু গাঁধী এক জনই, তিনি স্বেচ্ছায় রাজনীতির কাদাজল ঘাঁটেন, সত্যের পথ নিয়েও স্বেচ্ছায় পরীক্ষানিরীক্ষা করেন। এই কথাটা খেয়াল রাখলে মনে হতেই পারে— সঙ্ঘপ্রধান যে ভাবে বারবার গাঁধীর ‘পবিত্র, ত্যাগময়’ জীবনের কথা স্মরণ করান, সেটা ‘পুণ্যপুরুষ’-এর কাহিনি হয়েই থেকে যায়, রক্তমাংসের মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর নয়!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Mohan Bhagwat Mahatma Gandhi RSS India
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE