Advertisement
১১ মে ২০২৪

পাল্টাক ঠান্ডা যুদ্ধের আমলের মানচিত্র, দাবি ‘নতুন’ সিপিএমের

আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে রাজ্য সদর দফতরের দোতলায় যে ঘরটিতে সাংবাদিক বৈঠক হয় এবং রাজ্য কমিটির বৈঠকও হয়, সেই ঘরের পিছনের দেওয়ালে ঝোলানো আছে এক বিশাল বিশ্ব মানচিত্র। কিন্তু এই মানচিত্রটি সত্তরের দশকে লাগানো এবং এখনও এই মানচিত্রে সোভিয়েত ইউনিয়ন অবিভক্ত।

জয়ন্ত ঘোষাল
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০১৫ ১৭:১০
Share: Save:

আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে রাজ্য সদর দফতরের দোতলায় যে ঘরটিতে সাংবাদিক বৈঠক হয় এবং রাজ্য কমিটির বৈঠকও হয়, সেই ঘরের পিছনের দেওয়ালে ঝোলানো আছে এক বিশাল বিশ্ব মানচিত্র। কিন্তু এই মানচিত্রটি সত্তরের দশকে লাগানো এবং এখনও এই মানচিত্রে সোভিয়েত ইউনিয়ন অবিভক্ত। যে সোভিয়েত ইউনিয়ন এখন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে। ধূলি-ধূসরিত এই মানচিত্রটিতে সেই বলকানাইজেশনের কোনও প্রতিফলন নেই। ঘরটিতে এখনও প্রাচীন কিছু ছবি আছে। যেগুলি ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে। যেখানে আছেন স্টালিন। এবং সেই দেওয়ালে ছেঁড়া ক্যালেন্ডারে সেলোটেপ লাগানো। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মেশিনও ঘরটিতে নেই।

দলের আর একটি প্লেনাম যখন আসন্ন, সেই সময় দাবি উঠেছে এই ঠান্ডা যুদ্ধের সময়কার মানচিত্রটি বদল হোক। কংগ্রেসের সঙ্গে জোট হবে কি হবে না, সে সব পরের কথা। দলের সংগঠনকে আবার পুনরুজ্জীবিত করতে গেলে এই মান্ধাতার আমলের মানসিকতা থেকে তো বেরোতে হবে! বিষয়টি সম্পর্কে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং বিমান বসু অবহিত। বুদ্ধবাবু নির্দেশও দিয়েছেন ঘরটিকে নতুন করে সাজানোর জন্য। সূর্যকান্ত মিশ্র নিজে এই ঘরে আজকাল সাংবাদিক বৈঠক করেন। টেলিভিশনের যুগে সব রাজনৈতিক দল তাদের দলীয় অফিসে হাল-হকিকত বদলে দিয়েছে। যাতে একটা ঝা চকচকে ছবি ক্যামেরার সামনে ফুটে ওঠে। বিমান বসু দলীয় সহকর্মীদের জানিয়েছেন, নতুন মানচিত্রের জন্য বলা হয়েছে। কিন্তু এত বড় ও এত ভাল একটি বিশ্ব মানচিত্র পাওয়াও যাচ্ছে না। কমিউনিস্ট পার্টির তো একটি বিশ্ব দীক্ষা আছে, তাই বিমান বসুও মনে করেন একটি বিশ্ব মানচিত্র থাকাটা খুব জরুরি।

বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্র দলে জিবি (জেনারেল বডি) বৈঠকে গেলে কমরেডদের বলছেন, সংবাদমাধ্যম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যাপারে সমালোচনায় মুখর হলেও এটা ভাবার কোনও কারণ নেই যে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস পরাস্ত হবে আর সিপিএম ক্ষমতায় আসবে। ৩৪ বছরের মানুষের অসন্তোষ এত সহজে ঘোচানো যাবে না। আর তাই আগে সংগঠনকে মজবুত করতে হবে। মানুষের আস্থা ফিরে পেতে হবে। মানুষ যেন ভাবতে শুরু করে, পুরনো সিপিএম নয়, এ বার আসবে নতুন সিপিএম। সিপিএমের এক পলিটব্যুরো সদস্যের ভাষায়: ‘‘ফজলি থেকে ফজলিতর আম হয় না। বাজারে নতুন ওঠা এমন আতা।’’

কিন্তু কী ভাবে হতে পারে নতুন সিপিএম?

প্লেনামের আগে এ বারের পলিটব্যুরোর বৈঠকে প্রকাশ কারাটকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, বিভিন্ন রাজ্য ও জেলা ইউনিটের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা। তাদের কাছে প্রশ্নাবলী গ্রহণ করা। এবং তাদের সমস্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে প্লেনামের একটি রিপোর্ট তৈরি করা। দল সীতারাম ইয়েচুরিকে দায়িত্ব দিয়েছে, সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে দলীয় সিদ্ধান্ত কী হবে, তার খসড়া প্রস্তাবটি চূড়ান্ত করা। সেই প্রস্তাবেই থাকবে দলের ভবিষ্যৎ। স্বল্পমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি রণকৌশল। আর এই কারণেই বিহারের নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে আদৌ মাথা ঘামাচ্ছে না সিপিএম পলিটব্যুরো।

সিপিএমের শীর্ষ নেতৃত্ব ধরেই নিয়েছেন, এই ভোটে তাদের ফলাফল ভাল হবে না। লালুপ্রসাদ যাদব এবং নীতীশ কুমার চেয়েছিলেন, যাতে সিপিএম তাদের জোটে অংশ নেয়। কিন্তু সে প্রস্তাবেও ইয়েচুরি-কারাট রাজি হননি। লোকসভা নির্বাচন এখনও ঢের দেরি। এখনই কংগ্রেস বা লালুর জোটে অংশ না নিয়ে সিপিএম নিজেদের সাংগঠনিক বিচ্যুতি দূর করতে অনেক বেশি মরিয়া। এই কারণেই এ বারের পলিটব্যুরো এবং আসন্ন কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকেও সিপিএমের শীর্ষ নেতৃত্ব পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস, এমনকী মুকুল রায়ের সম্ভাব্য দলের সঙ্গেও সমঝোতার কূটনৈতিক বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতেও রাজি নন।

পলিটব্যুরো সূত্র বলছে, সীতারাম ইয়েচুরি সম্পর্কে একটা সাধারণ ধারণা আছে, তিনি বিজেপি-র বিরুদ্ধে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করতে তৈরি। সম্ভবত এই কারণেই সীতারাম এ ব্যাপারে আরও বেশি সচেতন। তাই তিনিও এ বারের বৈঠকে সংগঠনের কার্যকলাপের জন্য অনেক বেশি জোর দিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের কী কৌশল হবে, সে ব্যাপারেও তড়িঘড়ি কোনও সিদ্ধান্ত না নিয়ে আর একটু দেখতে চাইছেন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব যে কোথাকার জল কোথায় গড়ায়।

সমস্যা হচ্ছে, সংগঠনকে নতুন করে চাঙ্গা করার জন্য চাই আরও বেশি করে নবীন প্রজন্মের অগ্রাধিকার। চাই পুরনো ভাবনার বর্জন। সিপিএম নেতারা বুঝতে পারছেন, এই দুটি ব্যাপারে এখনও তাদের গতি খুবই শ্লথ। দিল্লির কেন্দ্রীয় কার্যালয় এ কে জি ভবনে সীতারামের সাংবাদিক বৈঠকে যা কখনও হয়নি, সেটা এ বারে হয়েছে বটে। কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্যের মন্তব্য, বুর্জোয়া সংবাদমাধ্যমকে চায়ের সঙ্গে বিস্কুট দেওয়া হয়েছে। আপাতত এটাই সিপিএমের নতুন হয়ে ওঠার মস্ত বড় লক্ষণ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE