Advertisement
০১ মে ২০২৪

কয়লা খনি বণ্টন বাতিল সুপ্রিম কোর্টে

কর্পোরেট জগতের আশঙ্কাই সত্যি হল। ১৯৯৩ সাল থেকে ২০১০ পর্যন্ত ২১৪টি কয়লা খনি বণ্টনের সিদ্ধান্ত বাতিল করে দিল সুপ্রিম কোর্ট। যার ফলে আগামী দিনে বিদ্যুৎ উৎপাদন সংস্থাগুলিকে বেশি দামে কয়লা কিনতে হবে এবং তার জেরে বিদ্যুতের দাম বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। সামগ্রিক ভাবে অর্থনীতিতে এর ধাক্কা লাগবে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:০৮
Share: Save:

কর্পোরেট জগতের আশঙ্কাই সত্যি হল। ১৯৯৩ সাল থেকে ২০১০ পর্যন্ত ২১৪টি কয়লা খনি বণ্টনের সিদ্ধান্ত বাতিল করে দিল সুপ্রিম কোর্ট। যার ফলে আগামী দিনে বিদ্যুৎ উৎপাদন সংস্থাগুলিকে বেশি দামে কয়লা কিনতে হবে এবং তার জেরে বিদ্যুতের দাম বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। সামগ্রিক ভাবে অর্থনীতিতে এর ধাক্কা লাগবে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কেননা, বিদ্যুতের জোগানে সমস্যা হলে নতুন বিনিয়োগে বাধা আসতে পারে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরেই বিদ্যুৎ, সিমেন্ট ও ইস্পাত সংস্থাগুলির শেয়ারের দাম পড়তে শুরু করেছে।

কয়লা খনি বণ্টনে দুর্নীতির জেরে কেন্দ্রীয় সরকারি কোষাগারের ১ লক্ষ ৮৬ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছিল বলে রিপোর্ট দিয়েছিল সিএজি। ২৫ অগস্ট শীর্ষ আদালত রায় দেয়, ওই সময় যে ২১৮টি কয়লা খনি বণ্টন হয়েছে, তার সবটাই বেআইনি। কারণ, নিলাম না করে সরকারি কমিটির পছন্দ মতো বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাকে এই কয়লা খনিগুলি পাইয়ে দেওয়া হয়। অধিকাংশ সংস্থা কয়লাখনি পেয়েও কোনও কাজ করেনি। বরং তা দেখিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে সেই টাকা অন্য কাজে লাগিয়েছে। ২৫ অগস্ট বেআইনি ঘোষণার পরেই কেন্দ্রের মত জানতে চেয়েছিল শীর্ষ আদালত। সরকার জানায়, ৪৬টি খনিতে কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। তাই সেগুলিকে বাদ দিয়ে বাকি বণ্টন বাতিল করা যেতে পারে। এর পরেই আজ মাত্র ৪টি কয়লা খনিকে রেহাই দিয়ে বাকি ২১৪টির বণ্টনই বাতিল করে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। সরকারি কোষাগারের ক্ষতি মেটাতে প্রধান বিচারপতি আর এম লোঢার নেতৃত্বাধীন বেঞ্চের নির্দেশ, ওই সব খনি থেকে এত দিন যে কয়লা তোলা হয়েছে, তার টনপ্রতি ২৯৫ টাকা করে জরিমানা দিতে হবে। পাশাপাশি, সর্বোচ্চ আদালত জানিয়েছে, কয়লাখনি বণ্টনে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে সিবিআই তদন্ত যেমন চলছিল, তেমনই চলবে।

ইউপিএ-জমানায় মনমোহন সরকার বরাবরই কয়লাখনি বণ্টন বাতিলের বিরোধিতা করেছে। যুক্তি ছিল, বিদ্যুৎ, সিমেন্ট, ইস্পাত তৈরির জন্য এই কয়লা খনিগুলি বণ্টন করা হয়েছে। যাতে তারা প্রয়োজন মতো ওই কয়লা থেকে তাপবিদ্যুৎ তৈরি করে নিতে পারে। এই সব প্রকল্পে ২ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি বিনিয়োগ হয়েছে। কয়লার অভাবে প্রকল্পগুলি মুখ থুবড়ে পড়লে অর্থনীতিতে ধাক্কা লাগবে।

মোদী সরকার অবশ্য সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদের বক্তব্য, এর ফলে সব কিছু নতুন করে শুরুর সুযোগ মিলল। তিনি বলেন, “কোর্টের রায় কেন্দ্রের অবস্থানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সরকার ইতিমধ্যেই অবস্থান নিয়েছিল যে সব কয়লাখনি বণ্টন বাতিল হয়ে গেলে আমরা খুশিই হব।” কেন্দ্র সুপ্রিম কোর্টকে জানায়, সব খনি বণ্টন বাতিল হয়ে গেলে তার সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বা ধাক্কার মোকাবিলায় সরকার তৈরি। এ দিন আদালতের রায়ের পর্যালোচনা ও ভবিষ্যতে সরকারের পরিকল্পনা কী হবে, তা নিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে আলোচনা হয়। সরকারি সূত্রের খবর, খুব শীঘ্রই এই ২১৪টি খনি নিলামের বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে।

সেখানেই আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। শিল্প মহলের একাংশের মতে, সব চেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সংস্থাগুলিকে নিলামে কয়লাখনি কিনতে হবে, জরিমানাও দিতে হবে। কয়লার খরচ বাড়ায় বিদ্যুতের দামও বাড়বে। এই সব প্রকল্পে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি কোটি কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। তারাও বিপদে পড়বে। কারণ ঋণ কবে শোধ হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। ২১৮টির মধ্যে ৪৬টি খনিতে কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। কেন্দ্রের তরফে অ্যাটর্নি জেনারেল মুকুল রোহাতগির আবেদন ছিল, এই ৪৬টি ক্ষেত্রে যেন খনি বণ্টন বাতিল না করা হয়। ৪টি বাদে কাউকেই রেহাই দেয়নি আদালত। তবে সুপ্রিম কোর্ট ওই সংস্থাগুলিকে সুরাহা দিতে ঘোষণা করেছে, ৩১ মার্চ পর্যন্ত খনি থেকে কয়লা তোলা যাবে। তবে তার জন্যও জরিমানা দিতে হবে।

টু-জি স্পেকট্রাম ও খনি বণ্টন এই দুই ক্ষেত্রের দুর্নীতি নিয়ে মনমোহন সরকারকে সব থেকে বেশি আক্রমণ করা হয়েছিল। প্রথমটিতে ১ লক্ষ ৭৬ হাজার কোটি টাকা, দ্বিতীয়টিতে ১ লক্ষ ৮৬ হাজার কোটি টাকার সরকারি ক্ষতি হয়েছে বলে রিপোর্ট দেয় সিএজি। সুপ্রিম কোর্ট সব স্পেকট্রাম লাইসেন্স বাতিল করে দিয়েছিল। এ বার খনি বণ্টনও বাতিল হল। ১৯৯৩ সালে নরসিংহ রাওয়ের জমানায় খনি বণ্টন শুরু হলেও মনমোহন জমানাতেই তার সিংহভাগ, ১৫৫টি খনি বণ্টন হয়। এর মধ্যে অনেকটা সময় মনমোহন সিংহ নিজেই কয়লা মন্ত্রকের দায়িত্বে ছিলেন। সুপ্রিম কোর্টের আজকের সিদ্ধান্ত মনমোহনের জন্য নতুন করে অস্বস্তি তৈরি করল বলেই মনে করা হচ্ছে।

রাজনীতিকদের অস্বস্তির থেকেও বেশি উদ্বেগ ছড়িয়েছে অর্থনীতি নিয়ে। যে খনিগুলিতে কাজ শুরু হয়েছে, সেখান থেকে দেশের মোট কয়লা জোগানের ১০% সরবরাহ হয়। বণিকসভা সিআইআই সভাপতি অজয় শ্রীরাম বলেন, “কয়লার জোগানে ঘাটতি হলে বিদ্যুৎ বিভ্রাট হবে। আরও কয়লা আমদানি করতে হবে। বিদেশি মুদ্রা লেনদেনের ঘাটতি বাড়বে।” অ্যাসোচ্যাম সভাপতি রাণা কপূর বলেন, “দু’বছর ধরে মন্দার পরে সবে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। কয়লা থেকে তাপবিদ্যুৎ তৈরি হয়। তা থেকেই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলে। সেখানে ধাক্কা লাগবে। আমদানি করা কয়লার উপর নির্ভরতা বাড়বে।” শিল্পপতিরা মনে করছেন, কেন্দ্রের উচিত দ্রুত এই খনিগুলি নিলামের বিষয়ে নীতিনিয়ম ঠিক করে ফেলা। তা হলেই অনিশ্চয়তা কাটবে। হিন্দালকো-র চেয়ারম্যান কুমারমঙ্গলম বিড়লার আশা, “আমি নিশ্চিত যে খনি পুনর্বণ্টনের বিষয়ে সরকারের বিকল্প পরিকল্পনা রয়েছে।” রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির স্বাস্থ্য নিয়েও উদ্বিগ্ন শিল্পমহল। স্টেট ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান অরুন্ধতী ভট্টাচার্য জানান, তাঁরাও দ্রুত ও স্বচ্ছ নিলাম প্রক্রিয়ার দিতে তাকিয়ে রয়েছেন। প্রাক্তন কয়লা সচিব পি সি পরাখ বলেছেন, “কেন্দ্র কত দ্রুত খনির পুনর্বণ্টন সারতে পারে, তার উপরে নির্ভর করছে অর্থনীতিতে কতটা ধাক্কা লাগবে।”

অবশ্য সরকারের একটি সূত্রের বক্তব্য, অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা লাগবে না। কারণ খাতায়-কলমে ২ লক্ষ ৮৬ হাজার কোটি টাকা লগ্নির কথা বলা হলেও গত বছরের মার্চ পর্যন্ত মাত্র ৮,৮৩২ কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। যে সব প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে, কয়লাখনি বাতিল হয়ে গেলেও সেগুলি বন্ধ না-ও হতে পারে। কারণ জ্বালানির জন্য বহু সংস্থা আলাদা ভাবে চুক্তি করে রেখেছে। তা ছাড়া, ওই সংস্থাগুলি ফের নিলামে খনি কিনে নিতে পারে। যে চারটি সংস্থার কয়লা খনি বাতিল হয়নি, তার মধ্যে দু’টি অনিল অম্বানীর রিলায়্যান্স সংস্থার আলট্রা মেগা পাওয়ার প্রোজেক্ট। কে সব থেকে সস্তায় বিদ্যুৎ জোগান দেবে, সেই অনুযায়ী ওই প্রকল্পের বরাত দেওয়া হয়েছিল। অন্য দু’টি প্রকল্পের একটি এনটিপিসি, অন্যটি সেল-এর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE