Advertisement
E-Paper

রাজ্যপাল পদ রেখে কাজ কী, তর্কাতর্কি তুঙ্গে

এক দিকের যুক্তি, সরকারি কোষাগারের কোটি কোটি টাকা খরচ করে নিছক আলঙ্কারিক পদটা রাখাই নিষ্প্রয়োজন। অন্য দিকের যুক্তি, ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচ হলে রেফারি তো লাগবেই!

প্রেমাংশু চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১৮ জুলাই ২০১৬ ০৩:৩৪

এক দিকের যুক্তি, সরকারি কোষাগারের কোটি কোটি টাকা খরচ করে নিছক আলঙ্কারিক পদটা রাখাই নিষ্প্রয়োজন। অন্য দিকের যুক্তি, ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচ হলে রেফারি তো লাগবেই!

রাজ্যপাল পদ তুলে দেওয়া উচিত কি না, বিতর্কটা তা নিয়েই। শনিবার দিল্লিতে আন্তঃরাজ্য পরিষদের বৈঠকে রাজ্যপাল পদের অবলুপ্তির দাবি তুলেছিলেন নীতীশ কুমার। উত্তরাখণ্ড-অরুণাচলে ৩৫৬ ধারা জারির পর কংগ্রেস, বাম থেকে বিজেডি-র মতো আঞ্চলিক দলগুলিরও অভিযোগ ছিল, নরেন্দ্র মোদী জমানায় অ-বিজেপি সরকার হঠাতে কাজে লাগানো হচ্ছে রাজ্যপালদের। সোমবার থেকে শুরু হতে চলা সংসদের বাদল অধিবেশনে রাজ্যপালদের ভূমিকা নিয়ে আলোচনার দাবি তুলেছে বিভিন্ন দল।

প্রশ্ন উঠেছে এখানেই, এত সমস্যার পরেও রাজ্যপাল পদটা রেখে দেওয়ার যুক্তি কী? রাষ্ট্রপতি না হয় দেশের সাংবিধানিক প্রধান। কিন্তু প্রতিটি রাজ্যেও এক জন করে সাংবিধানিক প্রধান রেখে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা কোথায়?

বিশেষজ্ঞরা দু’ভাগ। সুভাষ কাশ্যপ এবং পি ডি টি আচারির মতো সংবিধান বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভারতকে অখণ্ড রাখতে হলে রাজ্যপালের ভূমিকা যথেষ্ট। আপাত ভাবে মনে হয়, রাজ্যপাল শুধুই কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে রাজ্য সরকারের যোগসূত্র। কিন্তু ব্যাপারটা এত সীমিত নয়। ভারতের প্রতিটি অঙ্গরাজ্যকে এক সুরে বেঁধে রাখার কাজটি রাজ্যপালেরাই করে থাকেন। তা ছাড়া, মুখ্যমন্ত্রীকে তিনি নিরপেক্ষ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিতে পারেন। রাজ্যে শাসক ও বিরোধী দলের বিবাদ মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও নিতে পারেন। পশ্চিমবঙ্গে সিঙ্গুর-অশান্তির সময় গোপালকৃষ্ণ গাঁধী যেমন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য-মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে মধ্যস্থতার চেষ্টা করেছিলেন।

একই যুক্তি অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্যের। তিনি বলেন, ‘‘রাজ্যপালের কাছে শাসক দলের বিরুদ্ধে বিরোধীরা অভিযোগ তুলতে পারে। রাজ্য সরকার কী ভাবে কাজ করছে, রাজ্যপাল কেন্দ্রকে তার রিপোর্ট পাঠান। কাকে সরকার গড়তে ডাকা হবে, বিধানসভায় সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে কি না, তা রাজ্যপালই দেখবেন।’’ এই সূত্রেই তাঁর মন্তব্য, ‘‘ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচ হলে রেফারি থাকতেই হবে।’’

এই যুক্তি মানছেন না আর এক বিশ্বজিৎ। মিজোরামের অ্যাডভোকেট জেনারেল বিশ্বজিৎ দেব। তাঁর পাল্টা যুক্তি, ‘‘রাজ্যপালের হাতে তো কোনও ক্ষমতাই নেই। ব্রিটিশ জমানার এই আলঙ্কারিক পদের জন্য পেল্লায় রাজভবন, অফিস, কর্মী, অতিথিশালা, কনভয় রেখে সরকারি কোষাগারের কোটি কোটি টাকা কেন খরচ হবে? আর বিধানসভায় বিল পাশ হওয়ার পরে রাজ্যপালের আনুষ্ঠানিক সিলমোহরেরই বা কী দরকার!’’

প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক জাদ্ মাহমুদ অবশ্য কিছুটা মধ্যপন্থী। তিনি বলছেন, ‘‘ভোটে কোনও দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জিতে এলে রাজ্যপালের ভূমিকা থাকে না। কিন্তু তা না হলে কাকে সরকার গড়তে ডাকা হবে, সেই সিদ্ধান্ত নিতে তাঁর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে। পদটা তুলে দেওয়া যেতেই পারে। সে ক্ষেত্রে রাজ্যপালের এই দায়িত্বগুলি কে পালন করবে, তা ভাবতে হবে।’’ যদিও এই প্রসঙ্গে মিজোরামের অ্যাডভোকেট জেনারেল বিশ্বজিৎবাবু জানিয়ে দিচ্ছেন, সংবিধান ও আইন মেনে কেন্দ্রের যে কোনও উচ্চপদস্থ অফিসারই এই দায়িত্বগুলি পালন করতে পারেন। প্রয়োজনে রাষ্ট্রপতি তাতে অনুমোদন দেবেন। তার জন্য ২৯ জন রাজ্যপাল রাখার প্রয়োজন নেই।

পক্ষে-বিপক্ষে দুই শিবিরেরই অবশ্য মত— ভোটে হেরে যাওয়া, অবসর নেওয়া বা দলে কোণঠাসা হয়ে যাওয়া নেতাদের রাজ্যপালের পদে বসানোর হিড়িক শুরু হওয়ার ফলেই এত বিতর্ক। কেন্দ্রে নতুন দল ক্ষমতায় এলেই দেখা যায়, রাজ্যে রাজ্যে নতুন রাজ্যপাল নিয়োগ হচ্ছে। রাজ্যপালের মেয়াদ যে হেতু বকলমে কেন্দ্রীয় সরকারের ইচ্ছের উপরেই নির্ভরশীল, তাই প্রায়শই ওই রাজ্যপালদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রের হাতের পুতুলে পরিণত হওয়ার অভিযোগ ওঠে। সম্প্রতি যেমন উঠেছে উত্তরাখণ্ড ও অরুণাচলে। সংবিধান বিশেষজ্ঞ আচারির কথায়, ‘‘আদতে অরাজনৈতিক বিশিষ্ট ব্যক্তিদেরই রাজ্যপালের পদে বসানোর কথা
ভাবা হয়েছিল। পরে দেখা যায়, পরাজিত বা অবাঞ্ছিত নেতাদের রাজ্যপাল করে তাঁদের পুনর্বাসন বা বাণপ্রস্থের ব্যবস্থা হচ্ছে।’’

আবার অন্য উদাহরণও রয়েছে। খলিস্তানি আন্দোলনে অশান্ত পঞ্জাবে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়কে রাজ্যপাল করে পাঠিয়েছিল কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার। অনেকেই বলে থাকেন, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে পশ্চিমবঙ্গে নকশাল আন্দোলন সামলানো সিদ্ধার্থবাবুর অভিজ্ঞতাকে পঞ্জাবে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন রাজীব গাঁধী। তাতে সাফল্যও এসেছিল।

রাজ্যপালদের নিয়োগ ও ভূমিকা নিয়ে একগুচ্ছ প্রস্তাব ছিল মনমোহন জমানায় গঠিত মদনমোহন পুঞ্ছি কমিশনের রিপোর্টে। রাজ্যপাল নিয়োগে মুখ্যমন্ত্রীদের মতামত নেওয়া, পাঁচ বছরের স্থায়ী মেয়াদ বেঁধে দেওয়া, রাজ্যপালদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য পদে বসানোর প্রথা তুলে দেওয়ার মতো বেশ কিছু প্রস্তাব রয়েছে তাতে। ওই সুপারিশ খতিয়ে দেখে কার্যকর করার জন্য কমিটিও গড়েছেন মোদী। যা নিয়ে আবার আপত্তি তুলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে বিশেষজ্ঞদের একাংশ আশাবাদী, অরুণাচল নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক রায়ের পরে রাজ্যপালরা আপাতত রাজ্যের নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে সক্রিয় হবেন না। তাঁদের ভূমিকা সার্থক হবে রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠলেই।

CM nitish kumar
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy