Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

তাক লাগানো কেরিয়ারে মগজই তাঁর অস্ত্র

কলকাতার অফিসাররা মুম্বই উড়ে গিয়ে বুঝতে পারলেন, তাঁদের এত দূর উজিয়ে না-এলেও চলত। প্রায় সব কাজই সেরে রেখেছেন মহারাষ্ট্র পুলিশের অ্যান্টি টেররিজম স্কোয়াডের (এটিএস) প্রধান রাকেশ মারিয়া। কলকাতা থেকে তিন জন আইপিএস মুম্বই গিয়েছিলেন আজমল কসাবকে জেরা করতে। যদি লস্কর-ই-তইবার কোনও কলকাতা বা বঙ্গ-যোগ পাওয়া যায়।

রাকেশ মারিয়া

রাকেশ মারিয়া

সুরবেক বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:৩০
Share: Save:

কলকাতার অফিসাররা মুম্বই উড়ে গিয়ে বুঝতে পারলেন, তাঁদের এত দূর উজিয়ে না-এলেও চলত। প্রায় সব কাজই সেরে রেখেছেন মহারাষ্ট্র পুলিশের অ্যান্টি টেররিজম স্কোয়াডের (এটিএস) প্রধান রাকেশ মারিয়া।

কলকাতা থেকে তিন জন আইপিএস মুম্বই গিয়েছিলেন আজমল কসাবকে জেরা করতে। যদি লস্কর-ই-তইবার কোনও কলকাতা বা বঙ্গ-যোগ পাওয়া যায়। ২৬/১১-র মাসখানেক পরের কথা। কিন্তু তাঁরা গিয়ে দেখলেন, কসাবকে করার মতো আর কোনও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন মারিয়া ও তাঁর তদন্তকারী দল বাকি রাখেননি। পরে কসাবের আইআর (ইনটেরোগেশন রিপোর্ট) খুঁটিয়ে পড়া লালবাজারের আর এক আইপিএস বলছেন, ‘‘রাকেশ মারিয়া যে কতটা দক্ষ ও পেশাদার অফিসার, সেটা শুধু ওই নথি থেকেই বোঝা যায়।’’

মারিয়ার শিষ্য, মহারাষ্ট্র এটিএসের এসিপি সঞ্জয় কড়মের কথায়, ‘‘শার্লক হোমস পড়েছেন তো? মারিয়াই বাস্তবের শার্লক হোমস!’’

১৯৯৪-এ মারিয়া তখন ডিসি (অপরাধ দমন)। জালিস আনসারি নামে বহু বিস্ফোরণের ঘটনায় এক সন্দেহভাজনকে ধরে়ছিল সিবিআই। কিন্তু তার পেট থেকে কথা বার করা যাচ্ছিল না। ডাক পড়ে মারিয়ার। জেরা শুরুর আধ ঘণ্টার মধ্যেই আনসারি কবুল করে, ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৪— ৬০টিরও বেশি বিস্ফোরণে তার হাত রয়েছে। আর এই স্বীকারোক্তি আদােয় এক বারের জন্যও আনসারির গায়ে হাত তুলতে হয়নি মারিয়াকে। সঞ্জয় বলেন, ‘‘মারধরের দরকার হয় না মারিয়ার। অপরাধী যখন প্রথম পদক্ষেপের কথা স্বীকার করে, তখন জানবেন মারিয়া তার দশ নম্বর পদক্ষেপ পর্যন্ত বুঝে ফেলেছেন।’’

বাবা বিজয় মারিয়া ছিলেন বলিউডের প্রযোজক, ‘কলা নিকেতন’ প্রযোজনা সংস্থার কর্ণধার। ছেলের কিন্তু সিনেমা-ব্যবসায় আগ্রহ ছিল না। মজার কথা, পরে সেই ছেলেই খোদ সিনেমার চরিত্র হয়ে ওঠেন। ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’ ছবিতে কে কে মেনন এবং ‘দ্য অ্যাটাকস অব ২৬/১১’-তে নানা পটেকর ‘রাকেশ মারিয়া’ চরিত্রেই অভিনয় করেন। লোকে বলে ‘আ ওয়েনেসডে’ ছবিতে অনুপম খের অভিনীত পুলিশ কমিশনারের চরিত্রটিও মারিয়ার ছায়া অবলম্বনে।

১৯৮১ ব্যাচের আইপিএস। তার আগে মুম্বই সেন্ট জেভিয়ার্সের স্নাতক। ইউপিএসসি পরীক্ষার ফর্মে আবেদনকারীকে নিজের পছন্দ জানাতে হয়— আইএএস, আইএফএস না আইপিএস? মারিয়া লিখেছিলেন— আইপিএস, আইপিএস, আইপিএস। তিন বার! পরে বলেছিলেন, পুলিশের মর্যাদা ও শৃঙ্খলা তাঁকে টানে। তাই আইপিএস-ই হতে চেয়েছিলেন।

প্রথম পোস্টিং আকোলার এএসপি হিসেবে। হতে চেয়েছিলেন ট্রাফিক বিশেষজ্ঞ। জাপানে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু ১৯৯৩-এর একটা ঘটনা তাঁর জীবন অন্য খাতে বইয়ে দেয়— মুম্বইয়ের ধারাবাহিক বিস্ফোরণ। মারিয়া তখন ডিসি (ট্রাফিক)। কিন্তু তাঁর তদন্তেই উঠে আসে একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ সূত্র। দেশ জানতে পারে জনৈক টাইগার মেমনের কথা। সেই প্রথম রাকেশ মারিয়ার প্রচারের আলোয় আসা। তত দিনে মুম্বইয়ের গলি-তস্য গলি হাতের তেলোর মতো চেনা হয়ে গিয়েছে তাঁর। শহর জুড়ে তৈরি করেছেন নিজস্ব ‘ইনফর্মার’ বাহিনী। এই ‘বিশেষ সূত্রে’ আসা খবরের জোরেই গ্রেফতার করে ফেলেন সঞ্জয় দত্তকে। মুম্বই বিস্ফোরণের আগে দাউদ ইব্রাহিম বাহিনীর পাঠানো অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে থেকে কয়েকটা সঞ্জয়ের কাছেও রয়েছে বলে খবর পান তিনি। সঞ্জয়ের তখন লম্বা চুল। এমনিতে মারধরের ‘বদনাম’ না থাকলেও পুলিশের কেউ কেউ বলেন, স্বীকারোক্তি আদায় করতে সঞ্জয়ের লম্বা চুল ধরে তাঁকে নাকি চেয়ার থেকে তুলে ফেলেছিলেন মারিয়া।

মুম্বই বিস্ফোরণ পর্বের পর মাঝে কিছু দিন ছিলেন তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ পদে। ২০০৭-এ ফেরেন যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ দমন) হয়ে। শুরু হয় ক্রাইম ব্রাঞ্চের ঝোড়ো ইনিংস। ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন (আইএম)-এর প্রথম মডিউল ধরা পড়ে মারিয়ার দৌলতেই। গাড়ি চুরির একটি চক্রের পিছু নিয়ে ধরা হয় ২২ জন সন্দেহভাজন জঙ্গিকে। ২০০৫ থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল এরা। এর কিছু দিন পরেই ২৬/১১। সে রাতে পুলিশ কন্ট্রোল রুম সামলানোর পাশাপাশি প্রধান তদন্তকারী অফিসারও ছিলেন মারিয়া। হদিস দিয়েছিলেন পাণ্ডাদের।

অবশ্য বিতর্কও পিছু ছাড়েনি। ২৬/১১-র রাতে নিহত আইপিএস অফিসার অশোক কামটের স্ত্রী বিনীতাদেবী পরে অভিযোগ করেন, মারিয়ার গাফিলতিতেই কামা হাসপাতালে যথেষ্ট পুলিশ পাঠানো হয়নি। ওই এলাকাতেই নিহত হন অশোক-সহ তিন অফিসার। মারিয়ার আইডি থেকেই এক বার মুম্বইয়ের এক ধর্মস্থানে বিস্ফোরণের হুমকি-মেল গিয়েছিল। পরে জানা যায়, থেকে এক ইন্সপেক্টর ওই কীর্তি করেন।

অস্বস্তি আরও আছে। তাঁর নাম জড়িয়েছে ক্রিকেট বেটিং চক্রে, প্রকাশ্যে এসেছে লন্ডনে তাঁর সঙ্গে ললিত মোদীর ছবি। লেখক সুকেতু মেটা তাঁর ‘ম্যাক্সিমাম সিটি’ বইয়ে অজয় লাল নামে একটি অত্যাচারী পুলিশ চরিত্র তৈরি করেছিলেন মারিয়ার আদলেই।

আসলে ব্যক্তিগত মত যা-ই হোক, রাকেশ মারিয়া নামটার ওজন মেনে নিতেই হয় সকলকে। কারণ রেকর্ডই তাঁর হয়ে কথা বলে। কথা বলে ‘মগজাস্ত্র’। কখনও পুণের জার্মান বেকারির বিস্ফোরণ, কখনও মুম্বইয়ে ২০১১-র ১৩ জুলাইয়ের বিস্ফোরণ, কখনও কুখ্যাত কিডনি পাচার চক্রের রহস্যভেদ। সেই তিনিই আবার অবসরে গজল ও কাওয়ালি শোনেন। ভলিবল, বাস্কেটবল, ক্রিকেটের ভক্ত। স্ত্রী প্রীতি, দুই ছেলে কুণাল ও ক্রিশকে নিয়ে সুখী গৃহকর্তা।

ব্ল্যাক ফ্রাইডে-র ‘রাকেশ মারিয়া’ কে কে মেননের জেরার দৃশ্যগুলো ইউ টিউবে পাওয়া যায়। তবে সে তো সিনেমা। বাস্তবের মারিয়ার একটা গল্প বলেন সহকর্মীরা। ২০০৮-এ টিভি চ্যানেল কর্তা নীরজ গ্রোভার উধাও হয়ে যাওয়ার পর প্রথম বার মারিয়ার কাছে এসে কন্নড় অভিনেত্রী মারিয়া সুসাইরাজ জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘‘আপনার কাউকে সন্দেহ হয়?’’ মারিয়া বলেছিলেন, ‘‘আমার কিন্তু আপনাকেই সন্দেহ হচ্ছে।’’ পরের ঘটনা সকলের জানা। নীরজকে খুন করে টুকরো টুকরো কেটে জঙ্গলে গিয়ে পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে দেওয়ার দায়ে গ্রেফতার হন মারিয়া ও তাঁর বয়ফ্রেন্ড।

শিনা বরার শেষ পরিণতির সঙ্গে অনেকটাই মিলে যায় নীরজের গল্প। এখন নীরজের মতোই শিনার গল্পের শেষ দেখার দায়িত্ব রাকেশ মারিয়াই সামলান কি না, সেটাই দেখার!

এই সংক্রান্ত আরও খবর:

পুলিশ হয়েও সেলিব্রিটি, তিনি রাকেশ মারিয়া

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE