Advertisement
০৪ মে ২০২৪

ফিরে এল নির্ভয়া-স্মৃতি, গণধর্ষিতা ২ শিশু, লজ্জায় ডুবে রাজধানী দিল্লি

দেশের রাজধানীতে এখন নিরাপদ নয় আড়াই বছরের শিশুকন্যাও। নির্ভয়া-কাণ্ডের পর দু’বছর কাটতে চললেও দিল্লি রয়েছে দিল্লিতেই। একই দিনে রাজধানীর বুকে গণধর্ষণের শিকার হল দু’টো মেয়ে। এক জনের বয়স আড়াই, অন্য জনের পাঁচ।

সংবাদ সংস্থা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০১৫ ০৪:১৮
Share: Save:

দেশের রাজধানীতে এখন নিরাপদ নয় আড়াই বছরের শিশুকন্যাও। নির্ভয়া-কাণ্ডের পর দু’বছর কাটতে চললেও দিল্লি রয়েছে দিল্লিতেই।

একই দিনে রাজধানীর বুকে গণধর্ষণের শিকার হল দু’টো মেয়ে। এক জনের বয়স আড়াই, অন্য জনের পাঁচ। গত কাল চরম অত্যাচার সহ্য করে দু’জনেই এখন হাসপাতালে ভর্তি। ছোট্ট দু’টো শরীরের উপরে যে ভাবে নির্যাতন চালানো হয়েছে, তা দেখে শিউরে উঠেছেন চিকিৎসকেরাই।

হাসপাতালে দুই শিশুকে দেখে এসে টুইটারে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবাল দাবি তুলেছেন, হয় এর প্রতিকার করুন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। না হলে অন্তত এক বছরের জন্য দিল্লি পুলিশের দায়িত্ব রাজ্য সরকারের হাতে দেওয়া হোক। তার পরেও যদি তাঁরা আইন-শৃঙ্খলার হাল ফেরাতে না পারেন, তা হলে পুলিশের দায়িত্ব আবার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে ফিরিয়ে দেওয়া যেতে পারে। মুখ্যমন্ত্রী লিখেছেন, ‘‘পরপর এই ধরনের ঘটনা অত্যন্ত লজ্জাজনক। চিন্তারও। কী করছেন মোদী এবং তাঁর উপ-রাজ্যপাল?’’

দিল্লি পুলিশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কেজরীবালের সঙ্গে কেন্দ্রের চাপান-উতোর চলছে তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্বের প্রথম ইনিংস থেকেই। আজ কংগ্রেস-বিজেপি একযোগে আক্রমণ শানাতে শুরু করেছে আপ নেতার বিরুদ্ধে। যাঁর আমলে নির্ভয়ার ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, সেই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিত বলেছেন, ‘‘কেজরীবালকে অনুরোধ করব, অন্যের ঘাড়ে দোষ না চাপিয়ে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করুন।’’ দিল্লির ভারপ্রাপ্ত বিজেপি নেতা শ্যাম জাজুর অভিযোগ, ‘‘দিল্লির যে কোনও ছোটখাটো ঘটনা নিয়ে কেজরীবাল অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে রাজনীতি করতে শুরু করেন।’’ উত্তরে শ্যামের তীব্র সমালোচনা করে কেজরীবাল বলেছেন, দু’টি শিশুর গণধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধকে কী ভাবে ‘ছোটখাটো ঘটনা’ বলেন বিজেপি নেতা?

ফলে ঘটনার ভয়াবহতাকে ছাপিয়ে অনেকাংশেই উঠে এসেছে রাজনৈতিক তরজা। মাঠে নেমে পড়েছেন ছোট-বড় নেতা থেকে মানবাধিকার কর্মী। সোশ্যাল সাইটে লেখা হয়ে গিয়েছে দীর্ঘ মন্তব্য। কিন্তু সব ছাপিয়ে উঠে আসছে একটা প্রশ্ন— আর কবে লজ্জা হবে দিল্লির? নির্ভয়ার ধর্ষণের পর আরব বসন্তের ‘তাহরির স্কোয়ার’-এর প্রতিবাদ যেন উঠে এসেছিল দিল্লির রাজপথে। জলকামান থেকে মোমবাতি, টিভি চ্যানেলে নেতাদের তর্ক, কিছুই বাকি ছিল না। তবুও বদলায়নি বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের রাজধানী। সেখানে মেয়েদের নিরাপত্তা সেই ঠুনকোই থেকেই গিয়েছে। টনক নড়েনি পুলিশের।

গত সপ্তাহেই গণধর্ষিতা হয়েছিল পশ্চিম দিল্লির কেশবপুরম অঞ্চলের চার বছরের একটি বাচ্চা। গত রাতের একটি ঘটনা সেই পশ্চিম দিল্লিরই নিহাল বিহার এলাকার। আড়াই বছরের মেয়েকে নিয়ে বেশ রাতেই বাড়ির কাছে ‘রামলীলা’ দেখতে গিয়েছিলেন মা। আচমকা লোডশেডিং। অন্ধকারের মধ্যেই মায়ের হাত ছাড়িয়ে মেয়ে দৌড় লাগিয়েছিল বাড়ির দিকে। কিন্তু বাড়ি অবধি পৌঁছতে পারেনি। রাস্তা থেকেই তাকে মোটরবাইকে তুলে নিয়েছিল দু’জন।

মেয়েকে খুঁজে না পেয়ে পুলিশে যায় বাড়ির লোক। ঘণ্টা দুয়েক পর তার খোঁজ মেলে বাড়ির কাছেই একটি পার্কের কোণে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে সারা শরীর। কান্নার আওয়াজটাও যেন গোঙানির মতো শোনাচ্ছে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকেরা দেখেন, ছোট্ট মেয়ের সারা শরীরে কামড়ের দাগ। কোথাও কোথাও রক্ত জমাট বেঁধে কালশিটে পড়ে গিয়েছে। গোপনাঙ্গ থেকে রক্তপাত হয়েই চলেছে। চিকিৎসকরা মনে করছেন, কোনও জঙ্গলে বা ঝোপের আড়ালে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছে শিশুটিকে। সারা শরীরে ফুটে থাকা অজস্র কাঁটা তারই প্রমাণ। অন্য একটি সূত্রের দাবি, মা নয়, ঠাকুরমার সঙ্গে রামলীলা দেখতে গিয়েছিল মেয়েটি। দাঁড়িয়ে ছিল একটু দূরে। লোডশেডিংয়ের পর আলো ফিরতে ঠাকুরমা দেখেন, নাতনি নেই।

ওই এলাকাতেই রয়েছে পুলিশের সিসিটিভি ক্যামেরা। সেটির ফুটেজে দেখাও গিয়েছে, মোটরবাইকে চাপিয়ে মেয়েটিকে নিয়ে যাচ্ছে দু’জন। অথচ বাইকের নম্বর স্পষ্ট নয়। হেলমেট না থাকা সত্ত্বেও লোক দু’টির ছবি এমন কিছু স্পষ্ট নয় যে, মুখের আদলে স্কেচ আঁকানো যাবে। অভিযুক্তদের ধরার ব্যাপারে তাই এখনও এগোতে পারেনি পুলিশ। পাঁচ বছর বয়সি অন্য শিশুটিকে ধর্ষণের অভিযোগে তিন জন ধরা পড়েছে ঠিকই। কিন্তু তাতে আইনরক্ষকদের তেমন কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। কারণ, ওই তিন জনকে বেধড়ক পিটিয়ে পুলিশের হাতে দিয়েছিলেন স্থানীয়রাই।

পাঁচ বছরের মেয়েকে বাড়িতে একা রেখেই শুক্রবার কাজে বেরিয়েছিলেন পূর্ব দিল্লির আনন্দ বিহারের বাসিন্দা শ্রমিক দম্পতি। কোনও এক ফাঁকে তাঁদেরই প্রতিবেশী একটি ছেলে শিশুটিকে ডেকে নিয়ে যায় উপরের তলায়, নিজের ঘরে। সেখানে ছিল তার দুই বন্ধু। বাবা-মায়ের অভিযোগ, ফাঁকা বাড়িতে তিনটি ছেলে মিলে একাধিক বার ধর্ষণ করে শিশুটিকে। রক্তমাখা, ছেঁড়া জামা গায়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে আসে মেয়ে। বাবা-মাকে সব খুলে বললে প্রতিবেশীদের ডাকেন তাঁরা। তার পর বাড়ি থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে ওই তিন জনকে পিটিয়ে তুলে দেওয়া হয় পুলিশের হাতে। এই মেয়েটি যে হাসপাতালে ভর্তি, সেখানকার চিকিৎসকেরাও বলেছেন, চরম অত্যাচার চলেছে তার উপরে। তিন অভিযুক্তকেই নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গ্রেফতার করা হয়েছিল। তাদের নাম প্রকাশ, সীতারাম এবং রেবতী। শনিবার আদালতে তোলা হলে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ওই তিন জনকে বিচার বিভাগীয় হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে শিশু দু’টির শারীরিক অবস্থা ভাল।

দিল্লি মহিলা কমিশনের প্রধান স্বাতী মালিবাল আজ সকালে তিনি টুইটারে লিখেছিলেন, ‘‘ঘুম ভাঙল আড়াই বছর আর পাঁচ বছরের দু’টি বাচ্চার গণধর্ষণের খবর শুনে।’’ পরে সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘‘দিল্লির বাসিন্দা হিসেবে এই ঘটনায় আমি অত্যন্ত লজ্জিত। মহিলাদের উপরে নির্যাতনের প্রবণতা দিল্লিতে মহামারীর আকারে ছড়িয়ে পড়ছে।’’

‘‘সত্যিই মহামারী,’’ বলছেন অনেকে। এখনও শুধু দিল্লি নয়, দিল্লি সংলগ্ন এলাকাতেও বাড়ছে ধর্ষণের ঘটনা। শুক্রবার যেমন গুড়গাঁওয়ে ২০ বছরের এক কিশোরীকে গণধর্ষণের অভিযোগ উঠেছিল। সেই কিশোরী আদতে পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা। এমনকী নির্ভয়ার ঘটনার পরেও গাড়িতে তুলে ধর্ষণের একাধিক অভিযোগ শোনা গিয়েছিল রাজধানীতে। প্রতিবাদী মোমবাতি নিভে গিয়েছিল তত দিনে।

ইউটিউবে এখনও পাওয়া যায় ভিডিওটা। নির্ভয়ার ধর্ষণের পর দিল্লির সড়কের নিরাপত্তা নিয়ে স্টোরি করছিলেন হিন্দি চ্যানেলের মহিলা সাংবাদিক। রাস্তার ধারেই বুম হাতে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন। স্টিল কালারের ওয়াগনার গাড়িটা এসে থামল গা ঘেঁষে। উড়ে এল মন্তব্য, ‘‘চলে?’’ অবশ্য প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই গা়ড়ির সওয়ার এক যুবকের নজর পড়ে, ক্যামেরায় ছবি উঠে যাচ্ছে তাদের। স্পিড বাড়িয়ে উধাও হয় গাড়ি। ধারেকাছে তখনও পুলিশ নেই। সহকর্মীরা বলেন, টিভি ক্যামেরা ছিল বলেই সে দিন বেঁচে গিয়েছিলেন তরুণী সাংবাদিক।

দু’বছর কাটতে চলল। কিছুই বদলায় না। লজ্জার রাজধানী দেখে, মা-বোন তো দূর, কোলের মেয়েরও সেখানে কোনও ইজ্জত নেই!

ধর্ষণ-মন্তব্যে বিতর্কে নেতা

মহিলা সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, রাজ্যে মহিলারা নিরাপদ নন, তবু কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে কেন সরব নয় বিজেপি? মেজাজ হারিয়ে কর্নাটকের প্রাক্তন উপমুখ্যমন্ত্রী ঈশ্বরাপ্পা বলেন, ‘‘আপনিও তো মহিলা। আপনাকে কেউ তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করলে বিরোধীরা কী করতে পারে? আপনি বলুন, কী করা উচিত। আমরা সেটাই করব।’’ এতে ঝড় উঠেছে কর্নাটকে। মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়ার কড়া সমালোচনার মুখে চাপে পড়ে ঈশ্বরাপ্পা পরে বলেন, ‘‘কর্নাটকের মহিলাদের বোনের মতো দেখি। তাঁদের নিরাপত্তার জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করছে দল।’’ তবে তাঁকে বিপাকে ফেলতেই এই খবর বড় করে দেখানো হচ্ছে, দাবি ঈশ্বরাপ্পার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE