Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

ওই যাচ্ছেন ডন, চলল চোর পুলিশ

‘আরে দিওয়ানো, মুঝে পহচানো, কাঁহাসে আয়া, ম্যায় হুঁ কৌন’— বলতেই পারতেন তিনি। কিন্তু ডন ছোটা রাজনকে চেনা তো দূরস্থান, দেখারই সুযোগ পেলেন না কেউ।

বালির বিমানবন্দরের পথে ছোটা রাজন। বৃহস্পতিবার। ছবি: রয়টার্স।

বালির বিমানবন্দরের পথে ছোটা রাজন। বৃহস্পতিবার। ছবি: রয়টার্স।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০১৫ ০৩:৪২
Share: Save:

‘আরে দিওয়ানো, মুঝে পহচানো, কাঁহাসে আয়া, ম্যায় হুঁ কৌন’— বলতেই পারতেন তিনি। কিন্তু ডন ছোটা রাজনকে চেনা তো দূরস্থান, দেখারই সুযোগ পেলেন না কেউ।

ভোর সাড়ে পাঁচটা। পালাম বিমানবন্দরের বাইরে তখন সাংবাদিকদের জটলা। খবর পাওয়া গিয়েছে, দু’দিন দেরি হলেও শেষ পর্যন্ত ফেরানো হচ্ছে তাঁকে। ইন্দোনেশিয়ার বালি থেকে মাফিয়া ডন ছোটা রাজনকে নিয়ে ভারতে আসছে সিবিআই, দিল্লি ও মুম্বই পুলিশের যৌথ দল। যে রাজনের কাছ থেকে তাঁর প্রাক্তন ‘বস’, অধুনা পয়লা নম্বর দুশমন দাউদ ইব্রাহিম সম্পর্কে প্রচুর তথ্য পাওয়া যাবে বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা।

বায়ুসেনার বিশেষ বিমান রাজনকে নিয়ে যে পালাম বিমানবন্দরের মধ্যে বায়ুসেনার হাতে থাকা ‘টেকনিক্যাল এরিয়ায়’ নামবে, সে খবর জানতেন সাংবাদিকেরা। তাই প্রায় রাত থাকতেই ভিড় জমছিল গেটের বাইরে। ভোর পৌনে ছ’টা নাগাদ বিমানবন্দর থেকে বেরোল একটি কনভয়। তার পরেই আরও একটি।

কোন কনভয়ে আছেন রাজন? রীতিমতো চিন্তায় পড়ে গেলেন সাংবাদিকেরা। প্রথম কনভয়ের পিছনে ছুটল সংবাদমাধ্যমের কিছু গাড়ি। দ্বিতীয় কনভয়ের পিছনে অন্যেরা। দু’টি কনভয়েরই মাঝখানে একটি করে কালো কাচের অ্যাম্বাসাডর। দু’দল সাংবাদিকই তখন নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছেন, বোধহয় ওই কালো কাচের গাড়িতেই আছেন ‘ডন’।

ছ’টা নাগাদ প্রথম কনভয় পৌঁছে গেল লোদী রোডে। প্রায় একই সময়ে লোদী রোড থানায় পৌঁছে গেল দ্বিতীয় কনভয়। কিন্তু কোথায় রাজন?

ওই দু’টি কনভয়ই ছিল নকল। তাতে রাজনের ‘ডামি’রও ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সাংবাদিকেরা যখন নকল রাজনের পিছনে ছুটছেন, তখন আসল রাজনকে নিয়ে লোদী রোডে সিবিআইয়ের সদর দফতরের দিকে রওনা হয়ে যায় তৃতীয় একটি কনভয়। ৬টা ১০ নাগাদ সেই কনভয়টি নিরাপদে সিবিআই দফতরে পৌঁছে দেয় দাউদের দুশমনকে।

কার্যত ভিভিআইপি নিরাপত্তা। বিশেষ বিমান নামার আগেই বিমানবন্দর চলে গিয়েছিল আধাসেনার হাতে। রাজনের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য কুড়ি জন কম্যান্ডোর বিশেষ দল নিয়ে হাজির ছিলেন দিল্লি পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (স্পেশ্যাল সেল) সঞ্জীব যাদব। তার ওপরে ছিল ‘আসল’ রাজনকে লুকোতে এই বিপুল বন্দোবস্ত।

এবং সেটা মোটেও বাড়াবাড়ি নয়, জানাচ্ছেন দিল্লি পুলিশের অফিসারেরা। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে এক অফিসারের সংক্ষিপ্ত জবাব, ‘বিকজ হি ইজ ছোটা রাজন!’ সেই ছোটা রাজন। যিনি ১৯৯৩ সালের মুম্বই বিস্ফোরণের মূল অভিযুক্ত দাউদ ইব্রাহিমের প্রাক্তন সহযোগী। মুম্বই বিস্ফোরণ ঘিরেই যাঁদের মধ্যে বিরোধ শুরু। পরবর্তী কালে যিনি ‘দাউদ ভাইয়ের’ পয়লা নম্বর শত্রু। এবং যাঁর কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে দাউদের সাম্রাজ্যে নরেন্দ্র মোদীর সরকার নতুন করে আঘাত হানতে চাইছে বলে সরকারি সূত্রের দাবি। গোয়েন্দাদের সন্দেহ, রাজনকে খতম করতে মরিয়া হতে উঠতে পারেন পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়ের মদতপুষ্ট দাউদ।
মনে রাখা দরকার, রাজন ধরা পড়ার পরেই দাউদের নিরাপত্তা বাড়িয়েছে পাক সেনা।

নিজের পরিচয় দিয়ে থাকেন ‘দেশপ্রেমিক ডন’ বলে। দীর্ঘদিন পালিয়ে বেড়ানোর পর সেই ডনের দেশের মাটিতে পা দেওয়ার প্রথম মুহূর্তটাও কোনও ফিল্মি চিত্রনাট্যের চেয়ে কম নাটকীয় নয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রে খবর, পালামে নেমেই মাটিতে চুমু খান রাজন। তার পরে তাঁকে বসিয়ে দেওয়া হয় সেই তৃতীয় কনভয়ের নম্বরহীন অ্যাম্বাসাডরে। তার আগেই তাঁর দু’টি ‘ডামি’ কনভয়ের পিছনে ধাওয়া করেছে তামাম মিডিয়া। ভোর থেকে চোর-পুলিশ খেলে বোকা বনেছে তারা।

যে কারণে চূড়ান্ত সুরক্ষিত এক দুর্গ থেকে অন্য দুর্গে তিনি পৌঁছনোর পর দিনভর কী কী করলেন, বিশেষ সূত্রে শুধু তার খবর জোগাড় করতে হয়েছে সাংবাদিকদের। কিন্তু একটাও ছবি তোলা যায়নি!

সিবিআইয়ের দফতরে রাজনের পাহারায় রয়েছে কেন্দ্রীয় বাহিনী আইটিবিপি ও সিআরপি। জওয়ানদের সঙ্গে মোতায়েন রয়েছে স্নিফার ডগ। সিবিআই দফতরেই বিশেষ সেলে বসে আজ প্রাতরাশ সারেন রাজন। তার পর স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় এইমস হাসপাতালে। বলা বাহুল্য, কাকপক্ষীর চোখ এড়িয়ে। রাজনের কিডনির অসুখ নিয়ে সম্প্রতি নানা জল্পনা শোনা গিয়েছে। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রে খবর, রাজনের শরীর এখন যথেষ্ট ফিট বলে জানিয়ে দেন এইমসের চিকিৎসকেরা। বলেন, এখনই ডনের কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন নেই। ডাক্তারি পরীক্ষার পর ফের সিবিআই দফতরের বিশেষ সেলে ফেরেন রাজন।

এ বার শুরু হয় জেরার পালা। এখন সিবিআইয়ের হেফাজতে আছেন রাজন। কিন্তু জেরার জন্য সিবিআই, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা ব্যুরো (আইবি), গুপ্তচর সংস্থা র’-এর গোয়েন্দাদের নিয়ে তৈরি হয়েছে একটি যৌথ দল। প্রথম দিনে সেই যৌথ দলই তাঁকে ঘণ্টা তিনেক জেরা করে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রে খবর, প্রথম দিনেই যথেষ্ট নাটকীয় তথ্যও দিয়েছেন রাজন। ইন্দোনেশিয়ায় বসেই দাবি করেছিলেন, দাউদের সঙ্গে মুম্বই পুলিশের একাংশের যোগ রয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অফিসারেরা জানিয়েছেন, মুম্বই পুলিশে দাউদের শিকড় কতটা গভীর, তা নিয়ে আজ আরও বিস্তারিত তথ্য দেন রাজন। এমনকী, ১৮ জন অফিসারের নামও করেন। গোয়েন্দাদের দাবি, ওই ১৮ জনকে দাউদ এখনও ‘মাসোহারা’ দেন বলে জানিয়েছেন রাজন। এ ছাড়াও পশ্চিম এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে দাউদের সাম্রাজ্য নিয়েও প্রচুর তথ্য দেন তিনি।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তারা জানাচ্ছেন, মুম্বই পুলিশের একাংশের বিরুদ্ধে রাজনের এই অভিযোগ এখনও বিশ্বাস বা অবিশ্বাস কিছুই করছেন না তাঁরা। রাজনের সঙ্গে মুম্বই পুলিশের বহু বার স‌ংঘাত হয়েছে। তাই হতেই পারে, কিছু অফিসারকে ফাঁসাতে চাইছেন তিনি। আবার এই অভিযোগ পুরোপুরি অবিশ্বাসও করা যাচ্ছে না। কারণ, আগেও বহু বার এমন কথা উঠেছে। প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রসচিব, বর্তমানে বিজেপি নেতা রাজকুমার সিংহও এক সময়ে অভিযোগ করেছিলেন, মুম্বই পুলিশের কিছু অফিসারের জন্যই নাকি অটলবিহারী বাজপেয়ীর জমানায় কেন্দ্রের দাউদ-বিরোধী অভিযান ভেস্তে যায়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রে খবর, মুম্বই পুলিশের দাউদ-যোগের অভিযোগ নিয়ে আলাদা তদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছে মোদী সরকার। ওই তদন্তের সময়ে আর কে সিংহের বক্তব্যও জানতে চাওয়া হবে বলে খবর। মহারাষ্ট্রের রাজনৈতিক বিরোধীদের অবশ্য বক্তব্য, মুম্বই পুলিশকে নিয়ে রাজন প্রশ্ন তোলার পরেই তার সব মামলা সিবিআইকে দিয়ে দেওয়া হল। শিনা বরা হত্যা থেকে ছোটা রাজন— সব মামলাই কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এতে মুম্বই পুলিশের মনোবল একেবারে ভেঙে যাবে।

তবে আজ থেকে অন্তত ভারতীয় পুলিশের রাজনের পিছনে দৌড় শেষ। তা সে নেপথ্য কাহিনি নিয়ে জল্পনা যতই থাক। ‘ডন’ অমিতাভ বচ্চনের ‘তলাশ’ করছিল ১১ দেশের পুলিশ। ডন রাজনকে নিয়ে বাস্তব চিত্রনাট্যে আপাতত ‘না মুমকিন’ বলে কোনও শব্দ নেই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

chhota rajan delh brought back deportation
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE