Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

‘আমাদের কে উদ্ধার করবে? হাল ছেড়ে হোটেলে বসে আছি’

যত সময় যাচ্ছে, ততই অস্থিরতা বাড়ছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ। এবং ভয়ও। বেরতে পারব তো এই দ্বীপ থেকে? শুনলাম, পরিস্থিতি এমনই ভয়ানক যে নৌসেনার উদ্ধারকারী দল হ্যাভলকে পৌঁছতে পারেনি। সমুদ্র এতটাই উত্তাল। আর আমরা তো রয়েছি নিল দ্বীপে। একটা থেকে আর একটায় যেতে লঞ্চে প্রায় আধ ঘণ্টা লাগে। এমনিতেই বিচ্ছিন্ন দ্বীপ, আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে আমরাও। খবরে জানলাম, হ্যাভলক এবং নিলে সব মিলিয়ে প্রায় ১৪০০ পর্যটক আটকে রয়েছেন।

দীপক বিশ্বাস
নিল দ্বীপ, আন্দামান (কলকাতার নিউটাউনের বাসিন্দা) শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০১৬ ১৪:১০
Share: Save:

যত সময় যাচ্ছে, ততই অস্থিরতা বাড়ছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ। এবং ভয়ও।

বেরতে পারব তো এই দ্বীপ থেকে?

শুনলাম, পরিস্থিতি এমনই ভয়ানক যে নৌসেনার উদ্ধারকারী দল হ্যাভলকে পৌঁছতে পারেনি। সমুদ্র এতটাই উত্তাল। আর আমরা তো রয়েছি নিল দ্বীপে। একটা থেকে আর একটায় যেতে লঞ্চে প্রায় আধ ঘণ্টা লাগে। এমনিতেই বিচ্ছিন্ন দ্বীপ, আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে আমরাও। খবরে জানলাম, হ্যাভলক এবং নিলে সব মিলিয়ে প্রায় ১৪০০ পর্যটক আটকে রয়েছেন।

সোমবার সকাল থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টি এখনও থামেনি। কাঁহাতক আর ভাল লাগে! মনে হচ্ছে, ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। ভাবছি, না এলেই বোধ হয় ভাল হত। মাঝে মাঝে ভয়ে সেঁধিয়ে যাচ্ছি। অন্ধকার আকাশ। চার দিক এখনও সাদা। ঝেঁপে বৃষ্টি হচ্ছে। তিন দিনের মধ্যে তার দাপট এক ফোঁটাও কমেনি। একনাগাড়ে হয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে প্রবল ঝোড়ো হাওয়া। রীতিমতো দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া। কবে যে থামবে! হোটেল থেকে বেরতে পারছি না। গত দু’দিন কার্যত ঘরবন্দি হয়ে বসে আছি। পরশু সকালে পোর্ট ব্লেয়ার থেকে চেন্নাইয়ের বিমান। কী যে করব! কিছুই বুঝতে পারছি না।

অসহায় লাগছে। এত দিন তো থাকার কথাও নয়। গোনা টাকায় টান পড়ছে। এটিএমগুলো সব খারাপ। টাকা তোলা যাচ্ছে না। তার থেকেও ভয় বাড়ছে অন্য কারণে! স্থানীয় কোনও দোকানপাট খোলা নেই। কেউ বাইরে বেরতে পারছেন না। ফলে হোটেলের ভাঁড়ারঘরে টান পড়বে কিছু পরেই। পানীয় জল ফুরিয়ে আসছে। বাইরে থেকে জল কিনে আনাও কার্যত অসম্ভব। সবচেয়ে সমস্যা ওষুধ নিয়ে। কিছু প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র কাছে রয়েছে। কিন্তু, হঠাত্ তার বাইরে কিছু দরকার পড়লে! কোথায় পাব? যে ভাবে লোডশেডিং হচ্ছে, তাতে বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় বন্ধ। টিভি দেখা যাচ্ছে না। বাইরের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র ভরসা এখন মোবাইল। সেটাও কত ক্ষণ টিকে থাকবে বুঝতে পারছি না। কারণ, চার্জ দেওয়া যাচ্ছে না। যাদের ল্যাপটপ আছে তাঁদেরও সমস্যা। এই মুহূর্তে বাইরের সঙ্গে যোগাযোগটা ভীষণ প্রয়োজন। কিন্তু, সেটাও যদি কয়েক ঘণ্টা পর থেকে না থাকে!

আজ সকালে কলকাতা থেকে আমার এক আত্মীয় ফোন করলেন। শুনে আশা জাগে। হ্যাভলক দ্বীপে প্রায় ৮০০ পর্যটক আটকে রয়েছেন। নিলে প্রায় ৬০০। তাঁদের উদ্ধার করতে নৌসেনার সাহায্য চাওয়া হয়েছে। পোর্টব্লেয়ার থেকে তাঁরা রওনা দিয়েছেন। কিন্তু, আমাদের কী হবে? নিলের কথা কী কিছু বলেছে? জবাব পেলাম না। কয়েক ঘণ্টা পরে অন্য এক বন্ধু ফোন করে বললেন, ‘না, উদ্ধার করা যাচ্ছে না পর্যকদের।’ কারণ, সমুদ্র প্রবল উত্তাল। নৌসেনার লঞ্চ পাড়ে ঘেঁষতে পারছে না। অনেক বার চেষ্টা করেও উদ্ধারকারীরা পৌঁছতে পারেননি। হ্যাভলকে যদি এমন হয়, তবে নিলের কী হবে? আগের দিন যে সমুদ্রকে দেখে এসেছি, তার চেহারা এই দু’দিনে আরও মারাত্মক হয়েছে জানি। টিভিতে দেখা সুনামির আতঙ্কটা আস্তে আস্তে গ্রাস করছে।

স্ত্রী এবং এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতার নিউটাউন থেকে শনিবার সকালে পোর্টব্লেয়ারের উদ্দেশে উড়েছিলাম। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে নেমেও পড়ি। পোর্টব্লেয়ারে দু’দিন কাটিয়ে নিল দ্বীপ। সেখানে এক দিন থেকে হ্যাভলক হয়ে ফের পোর্টব্লেয়ার। ৯ ডিসেম্বর সেখান থেকে ফিরতি বিমান ধরার কথা। সেই মতো সব জায়গায় ব্যবস্থা করা ছিল। এখন গোটাটাই ভেস্তে যাওয়ার মুখে। শুধু ভেস্তে যাওয়াই নয়, একটা ভয় গ্রাস করছে প্রতি নিয়ত। লোডশেডিং এবং ইন্টারনেট না থাকার কারণে বিমানের টিকিটও ক্যানসেল করতে পারছি না। ওই টাকাটাও হয়তো জলে যাবে!

সে দিন সকালে যখন আন্দামানের রাজধানী শহরে নেমেছিলাম, আবহাওয়া তখন বেশ পরিষ্কার। এমন দুরাবস্থার কোনও পূর্বাভাস কোথাও ছিল না। সোমবার সকালে পোর্টব্লেয়ার থেকে যখন ক্রুজে চড়লাম, তখন মেঘলা আকাশ। তবে, বৃষ্টি শুরু হয়নি। সমুদ্র ধরে কিছুটা এগোতেই ঝোড়ো হাওয়া ওঠে। ক্রমশ তা বাড়তে থাকে। হাল্কা বৃষ্টিও শুরু হয়। ওই আবহাওয়াতে প্রায় সওয়া দু’ঘণ্টা পরে নিল দ্বীপে এসে নামি। এখানেও তখন বৃষ্টি হচ্ছিল। কিন্তু, সেই ঝড়বৃষ্টি যে পরের দু’দিন একেবারে ঘরবন্দি করে রাখবে, তার আভাস ছিল না।

সোমবার বিকেলে নিল দ্বীপের তিনটি সাইট দেখে সন্ধের আগেই হোটেল ঢুকে পড়ি। সমুদ্র তখন ভীষণ উত্তাল। বৃষ্টির দাপট সকালের থেকে বেশ কয়েক গুণ বেড়েছে। বেড়েছে ঝড়ের গতিও। মিনিট দশেক দূরের লক্ষ্মণপুর বিচ থেকে কী ভাবে যে হোটেলে পৌঁছেছিলাম, তা আমরাই জানি। আটান্ন বছর বয়সে সে ভাবে কী আর দৌড়নো যায়! সেই যে সে দিন সন্ধেতে হোটেলে ঢুকলাম, আজ দু’দিন হয়ে গেল, বেরতে পারিনি। হোটেলে আরও অনেকেই আটকে রয়েছেন। সিংহ ভাগই বাঙালি।

আমাদের হোটেলে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের অনেকেরই মঙ্গলবার বিকেলে ফেরার বিমান ছিল। কারও আজ সকালে এবং বিকেলে। কিন্তু, নিলে আটকে গিয়ে সে সব এখন শিকেয়। কী ভাবে এই দ্বীপ থেকে বেরবো, তার উপায় খুঁজছে সবাই। কিন্তু, ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই। হোটেল কর্তৃপক্ষ বেশ ভাল ব্যবহার করছেন। এক বারের জন্যও টাকা চাননি। খাবারদাবার এখনও সময় মতো মিলছে। তবে, আর কত দিন এ ভাবে কাটবে বুঝতে পারছি না।

জলে ঘেরা দ্বীপে আনন্দ করে কয়েকটা দিন কাটাব বলেই আসা। কিন্তু, এ ভাবে জলবন্দি হয়ে ভয়ের পরিবেশে বসে থাকতে আর ভাল লাগছে না। হোটেলের কাছেই লক্ষণপুর বিচ। সমুদ্রের তর্জনগর্জন ঝড়ের শব্দের সঙ্গে মিশে এক বিচিত্র অনুভূতি তৈরি হচ্ছে। মনে হচ্ছে, সব ছিঁড়ে যদি পালানো যেত! কিন্তু, পালাব বললেই তো আর হয় না। এ তো আর স্থলপথ নয় যে, কিছু না কিছু একটা মিলে যাবে। মিনিট কয়েকের পথ পেরলেই তো সমুদ্র। গত সোমবার সেখান থেকে পোর্টব্লেয়ারের জন্য শেষ লঞ্চ এবং ক্রুজ ছেড়েছে। তার পর থেকে আর কিছুই মিলছে না। মিলছে না বলা ভুল। কে এই প্রবল প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নেবে! কাজেই শুনশান ফেরিঘাট।

মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে একটা ডুঙি (ডিঙা নৌকা) ভাড়া করে পোর্টব্লেয়ার চলে যাই। কিন্তু, হোটেলের ম্যানেজার আনন্দবাবুকে সে কথা বলতেই রে রে করে উঠলেন। বললেন, ‘‘আপনার কী এই বয়সে মাথা খারাপ হয়ে গেল! এই দুর্যোগের মধ্যে ডুঙায় করে সমুদ্রে নামবেন! এক কদম এগোনোর আগেই তো সলিলসমাধি হবে! জানি জলের মধ্যে আটকে আছেন। কিন্তু, জলে পড়ে নেই তো!’’ এটুকু ভরসা নিয়েই সমুদ্রবন্দি হয়ে হোটেলে বসে আছি। কিন্তু, ভয়টা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।

আরও পড়ুন: প্রবল বৃষ্টিতে আন্দামানে আটকে ৮০০ পর্যটক, উদ্ধারে নামল সেনা

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Andaman & nicobar Deep depression heavy rainfall
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE