Advertisement
১১ মে ২০২৪

কর্মীদের যত্নে ট্রেনেই জন্ম রেল-তনয়ার

দরকারের সময়ে দেখা মেলে না। টাকা নিয়ে বাড়তি যাত্রী তোলেন। এমনকী যাত্রীদের টাকা-জিনিসপত্র হাতানো থেকে ছিনতাইবাজদের সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগও হামেশাই ওঠে এক শ্রেণির রেল কর্মীর বিরুদ্ধে। ঠিক যে-ভাবে রক্ষক পুলিশের বিরুদ্ধে ওঠে ভক্ষকের ভূমিকা নেওয়ার অভিযোগ।

রেলকর্মীদের সঙ্গে সদ্যোজাত শিশু ও প্রসূতি। — নিজস্ব চিত্র

রেলকর্মীদের সঙ্গে সদ্যোজাত শিশু ও প্রসূতি। — নিজস্ব চিত্র

অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৩:১৫
Share: Save:

দরকারের সময়ে দেখা মেলে না। টাকা নিয়ে বাড়তি যাত্রী তোলেন। এমনকী যাত্রীদের টাকা-জিনিসপত্র হাতানো থেকে ছিনতাইবাজদের সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগও হামেশাই ওঠে এক শ্রেণির রেল কর্মীর বিরুদ্ধে। ঠিক যে-ভাবে রক্ষক পুলিশের বিরুদ্ধে ওঠে ভক্ষকের ভূমিকা নেওয়ার অভিযোগ।

তবে ভাল পুলিশের দেখা মেলে মাঝেমধ্যেই। একই ভাবে পাওয়া গেল যাত্রী-বান্ধব দুই রেলকর্মীকে। তাঁদের সৌজন্যে চলন্ত এক্সপ্রেস ট্রেনেই আস্ত বাতানুকূল আঁতুড়ঘর পেয়ে গেলেন এক প্রসূতি। ডাক্তার বা নার্স মেলেনি। তবে ছিল রেলকর্মীদের বাড়ানো হাত। আর ছিল কিছু সহযাত্রীর সহযোগিতা। সমবেত যত্নে ভূমিষ্ঠ, না, রেলস্থ হল কন্যাসন্তান।

শনিবার বিকেলে টাটানগর থেকে রৌরকেলা হয়ে আলেপ্পি অভিমুখে ছুটে চলা আলাপূজা এক্সপ্রেসের ঘটনা। ট্রেনটি রৌরকেলায় পৌঁছনোর পরে প্রসূতি ও নবজাতিকাকে রেলের অ্যাম্বুল্যান্সে করে নিয়ে যাওয়া হয় সেখানকার একটি বেসরকারি ক্লিনিকে। আপাতত কয়েকটা দিন সেখানেই রাখা হবে তাঁদের। প্রাথমিক পরীক্ষার পরে চিকিৎসকেরা জানান, মা আর মেয়ে এখন সম্পূর্ণ সুস্থ।

বাড়িতে নয়। হাসপাতালে, অন্তত প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রসবের উপরে জোর দিচ্ছে সরকার। কিন্তু নিতুদেবী আর বজরং প্রসাদ যেখানকার বাসিন্দা, ঝাড়খণ্ডের সেই মাওবাদী অধ্যুষিত গোয়েলকার এলাকায় সেই সুবিধে সহজলভ্য নয়। সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে নিয়ে তাই রৌরকেলায় চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছিলেন বজরং। গোয়েলকার থেকে রৌরকেলা ঘণ্টাখানেকের পথ। বিকেল ৫টা নাগাদ গোয়েলকার স্টেশন থেকে আলাপূজা এক্সপ্রেসের একটি সাধারণ সংরক্ষিত থ্রি-টিয়ার স্লিপার কামরায় ওঠেন তাঁরা। ট্রেনটি মনোহরপুর স্টেশন পেরোতেই প্রসববেদনা ওঠে নিতুদেবীর। যন্ত্রণা ক্রমশ বাড়তে থাকায় ওই কামরার রেল অ্যাটেন্ড্যান্ট বা যাত্রী-সহায়ক লালচাঁদ যাদবকে বিষয়টি জানান বজরং। লালচাঁদ সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলে খবর দেন ট্রেনের টিকিট পরীক্ষক বিকাশ কুমারকে।

ওই দুই রেলকর্মীর মিলিত উদ্যোগে ঠিক হয়, তখনকার মতো কোনও একটি বাতানুকূল কামরায় রাখা হবে নিতুদেবীকে। সহযাত্রীদের সাহায্যে আসন্নপ্রসবাকে নিয়ে যাওয়া হয় ওই ট্রেনেরই একটি বাতানুকূল কামরায়। সেই কামরার একটি সংরক্ষিত কুপের যাত্রীদের অনুরোধ করে সেটি খালি করা হয়। সেখানেই শোয়ানো হয় প্রসূতিকে। তার পরে দু’জন মহিলা যাত্রীর সহযোগিতায় ওই কুপেতেই কন্যাসন্তানের জন্ম দেন নিতুদেবী। ট্রেনেরই তোয়ালে-চাদরের আদরে মুড়ে রাখা হয় নবজাতিকাকে।

তবে ট্রেনে দূষণমুক্ত যন্ত্রপাতি না-থাকায় নবজাতিকার নাড়ি কাটার ঝুঁকি নেওয়া যায়নি। ওই অবস্থায় শুইয়ে রাখা হয় মা-মেয়েকে। ট্রেনে কোনও চিকিৎসক-যাত্রীর খোঁজ না-মেলায় বিকাশবাবু ইতিমধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব রেলের কন্ট্রোল রুমে খবর দিয়ে রৌরকেলা স্টেশনে ডাক্তারের ব্যবস্থা করতে বলেছিলেন। সেখানকার রেলকর্মীরা খবর পেয়ে শুধু ডাক্তার নয়, আস্ত একটি মেডিক্যাল টিম আর অ্যাম্বুল্যান্সের ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন রৌরকেলা স্টেশনে।

ট্রেনটি রৌরকেলায় পৌঁছতেই মেডিক্যাল টিম তড়িঘড়ি উঠে পড়ে প্রসূতির কামরায়। চিকিৎসকেরা নাড়ি কেটে দেন। প্রাথমিক চিকিৎসা করা হয় সেখানেই। প্রসূতি ও নবজাতিকা একটু সুস্থ-ধাতস্থ হওয়ার পরে অ্যাম্বুল্যান্সে তাঁদের পৌঁছে দেওয়া রৌরকেলায় নিতুদেবীদের পরিচিত চিকিৎসকের কাছে।

সড়কপথ হোক বা রেল, কোথাও সহযাত্রীদের সহৃদয় হাতের এমন স্পর্শ এর আগে কখনও পাননি নিতু-বজরং। রেলকর্মী এবং সহযাত্রীদের বারবার ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন ওই দম্পতি। ‘‘শিশুটিকে সুষ্ঠু ভাবে পৃথিবীর আলোয় আনতে পেরে আমরাও আনন্দিত,’’ বলেছেন দক্ষিণ-পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক সঞ্জয় ঘোষ।

২০১৩ সালের ৮ অগস্ট জার্মানিতে চলন্ত লোকাল ট্রেনে পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন এক মহিলা। সে-দিনের পরিস্থিতি বেশ ঘোরালো ছিল। কোনও আড়ালই পাওয়া যাচ্ছিল না কামরায়। শেষ পর্যন্ত রেলকর্মী আর সহযাত্রীরাই কামরায় এক চিলতে জায়গা আড়াল করে দাঁড়ান। সেখানেই জন্ম নেয় নবজাতক। শিশুটির সঙ্গে নাড়ির সম্পর্ক স্থাপন করে রেল। পরের দিন জার্মানির লোকাল ট্রেন কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করেন, ট্রেনে জন্ম নেওয়ায় ওই শিশু আজীবন লোকাল ট্রেনে চড়তে পারবে বিনা পয়সায়।

নিতু-বজরংয়ের মেয়েকে এখনই বলা হচ্ছে ‘রেল-তনয়া’ বা ‘রেল-কন্যা’। প্রধানমন্ত্রীর ‘বেটি বাঁচাও’, ‘বেটি পড়াও’ পরিকল্পনার পাশাপাশি রেলে ‘জননী সেবা’ প্রকল্প এখন দারুণ জনপ্রিয়। জার্মানির মতো এ দেশের ওই নবজাতিকার জন্য রেল কোনও বিশেষ উপহারের ব্যবস্থা করে কি না, সেই দিকে তাকিয়ে আছেন সাধারণ রেলকর্মী আর আমযাত্রীরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Rail Newborn
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE