দলের নেতা-কর্মীদের তীব্র চাপ সত্ত্বেও ইস্তফা দেওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় রইলেন নীতীশ কুমার। তবে দলীয় বিধায়কদের ইচ্ছা অনুযায়ী বিহারের পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী বেছে দিলেন নীতীশ। সমাজের একেবারে অন্ত্যজ মুষাহার সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি তথা নীতীশ সরকারের তফসিলি জাতি-উপজাতি মন্ত্রী জিতনরাম মাঁজি বিহারের পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী হতে চলেছেন। উল্লেখ্য, এই প্রথম কোনও দলিত বা মহাদলিত বিহারের মুখ্যমন্ত্রী পদে বসতে চলেছেন।
তথ্য বলছে, এই মুহূর্তে বিহারে মোট জনসংখ্যার ১৪.২% দলিত ও মহাদলিত। রাজ্যের জাতপাতের পিরামিডে এই দলিত-মহাদলিতদেরও একেবারে শেষের দিকে মুষাহার সম্প্রদায়ের স্থান। সাধারণত ‘মূষিক বা ইঁদুর মেরে আহার’ করার কারণেই এই সম্প্রদায়ের নাম মুষাহার। তবে মূলত এঁদের জীবিকা কৃষিকাজ, অন্যের জমিতে জন-মজুর খাটা। সে সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিকে নিজের উত্তরসূরি হিসেবে কেন বাছলেন নীতীশ? একাংশের ধারণা, লোকসভা নির্বাচনের পরবর্তী পর্যায়ে রাজ্যে বিজেপির বিরুদ্ধে দ্বিতীয় পর্বের লড়াইয়ে জাতপাতের সমীকরণের কথা ভেবেই এই দলিত-তাস খেলেছেন তিনি।
সুচিন্তিত ভাবনা যে তাঁর রয়েছে সে কথা নিজ মুখেই স্বীকার করেছেন নীতীশ। তবে পুরোটাই নিজের ইস্তফা নিয়ে। আজ জেডিইউ পরিষদীয় দলের দ্বিতীয় দফার বৈঠকে তিনি জানান, অনেক ভেবেচিন্তেই মুখ্যমন্ত্রী পদ ছেড়েছেন। এবং এর পর বিহারে দলীয় সংগঠনকে মজবুত করতেই কাজ করবেন তিনি। তাঁর বয়ানে, “কোনও আবেগের বশে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। আমরা যে আদর্শের জন্য রাজনীতি করি, সেই নীতিগত বাধ্যবাধকতা থেকেই সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।” তাঁর আরও ব্যাখ্যা, “আমরা এক নজিরবিহীন পরিস্থিতির সামনে। সে কারণেই এমন কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।”
এর পরেই দলীয় বিধায়করা বিহারের পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী বাছাইয়ের দায়িত্ব তাঁর হাতে ছেড়ে দেন। বৈঠকের মধ্যেই রাজ্যপাল ডি ওয়াই পাটিলের সঙ্গে দেখা করতে সময় চান নীতীশ। বৈঠক শেষে তিনি, দলের সর্বভারতীয় সভাপতি শরদ যাদব, রাজ্য সভাপতি বশিষ্ঠনারায়ণ সিংহ রাজভবনে যান। সঙ্গে নিয়ে যান জিতনরামকে। তখনই প্রায় স্পষ্ট হয়ে যায়, পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী পদে জিতনরামই বসছেন। রাজভবন থেকে বেরিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে নীতীশ জিতনরামের নাম ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে জানিয়ে দেন, ২০১৫ সালে রাজ্যের পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনে দলকে তিনিই নেতৃত্ব দেবেন। তাতে যদি তাঁদের দল জেতে তখন কে মুখ্যমন্ত্রী হবেন? নীতীশের জবাব, “সাধারণ মানুষ যদি আমার উপর আস্থা জ্ঞাপন করেন, তবে তখন আবার আমি মুখ্যমন্ত্রী হতে পারি।”
নীতীশের ইস্তফার পর গত দু’দিন ধরে জেডিইউ-এর সর্বস্তরে বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল। তাঁকে ইস্তফা ফিরিয়ে নেওয়ার দাবি জানাতে শুরু করেছিলেন নেতা-কর্মীরা। গত কালের পরিষদীয় বৈঠকে বিধায়করাও নীতীশের উপর চাপ বাড়াতে থাকেন। অনশনেরও হুমকি দেন তাঁরা। পরিস্থিতি সামলাতে শেষ পর্যন্ত নীতীশ এক দিন সময় চেয়ে নেন। সেই মতো আজ দুপুর দু’টো নাগাদ ১ নম্বর অ্যানে মার্গে তাঁর বাড়িতে ফের পরিষদীয় বৈঠক বসে। তার পরেই এই ঘোষণা।
তবে ঘোষণার আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, মুখ্যমন্ত্রী পদে আপাতত ফিরছেন না নীতীশ। শেষ পর্যন্ত তাতে সিলমোহর লাগান শরদ যাদব। সকালেই তিনি বলেছিলেন, “নীতীশ কুমারের ইস্তফা সঠিক সিদ্ধান্ত। তাতে আজ বিধায়করা সম্মতি জানাবেন।” তার রাজনৈতিক কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “এনডিএ থেকে বেরিয়ে আসা ছিল আমাদের প্রথম পদক্ষেপ। এটা দ্বিতীয়। নীতীশের ইস্তফা বিহার তথা দেশের কাছে ইতিবাচক বার্তা দিয়েছে। এর ফলে দলেরও ভাল হল।” এর পরেই স্পষ্ট হয়ে যায় ছবিটা। বাকি ছিল ইস্তফার সিদ্ধান্তে জেডিইউ পরিষদীয় দলের সম্মতি পাওয়া।
নীতীশ এ দিন তাঁর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন। পরে বলেন, “আগামী নির্বাচনে মানুষের আরও বেশি সমর্থন নিয়ে আমরা ফের ক্ষমতায় আসতে চাই। তার জন্য আমাকে দলের কাজ করার সুযোগ দিন।” শেষ পর্যন্ত বিধায়করা তাঁর কথাই মেনে নেন। তবে তাঁর উত্তরসূরি বাছাইয়ের ভার নীতীশের একক সিদ্ধান্তের উপরেই ছেড়ে দেওয়া হয়। বশিষ্ঠনারায়ণ সিংহ একটি প্রস্তাব সভায় পেশ করেন। তাতে বলা হয়, আগামী বিধানসভা নির্বাচনে দলকে নেতৃত্ব দেবেন নীতীশ কুমার। পরে বশিষ্ঠ সাংবাদিকদের বলেন, “সকলেই নীতীশ কুমারের এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে সহমত হয়েছেন। তাঁর এই সিদ্ধান্ত নজির তৈরি করল।”
নীতীশের এই আচমকা পাল্টা-রাজনীতিতে রাজ্য বিজেপি নেতারা কিছুটা হতচকিত। জেডিইউ ভেঙে নীতীশকে ক্ষমতাচ্যুত করা আর এক মুষাহার মুখ্যমন্ত্রীকে গদিচ্যুত করা যে এক জিনিস নয় তা দলের শীর্ষ নেতারা একান্তে স্বীকার করে নিচ্ছেন। তবে রাজনীতিতে ভাঙা আছে, কিন্তু মচকানো নেই। তাই নীতীশের সিদ্ধান্তকে আক্রমণ করে বিজেপির অশ্বিনী চৌবের মন্তব্য, “মুখ লুকনোর জন্যই নীতীশ কুমার পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।” আর সুশীল মোদীর কথায়, “এ বার রিমোট কন্ট্রোলে সরকার চালাবেন নীতীশ।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy