Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
সুনন্দা-মৃত্যু

খুনের মামলা দিল্লি পুলিশের, অবাক শশী

আর ঠিক দশ দিন পরে তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। এত দিনে দিল্লি পুলিশ ঘোষণা করল, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং কংগ্রেস সাংসদ শশী তারুরের স্ত্রী সুনন্দা পুষ্করের মৃত্যুর ঘটনায় খুনের মামলাই দায়ের করছে তারা। সুনন্দার মৃত্যুর পিছনে বিষক্রিয়াই দায়ী বলে পুলিশের দাবি। গত এক বছর ধরেই সুনন্দার মৃত্যু নিয়ে নানা গুঞ্জন, নানা ধোঁয়াশা রয়ে গিয়েছে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:১৬
Share: Save:

আর ঠিক দশ দিন পরে তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। এত দিনে দিল্লি পুলিশ ঘোষণা করল, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং কংগ্রেস সাংসদ শশী তারুরের স্ত্রী সুনন্দা পুষ্করের মৃত্যুর ঘটনায় খুনের মামলাই দায়ের করছে তারা। সুনন্দার মৃত্যুর পিছনে বিষক্রিয়াই দায়ী বলে পুলিশের দাবি।

গত এক বছর ধরেই সুনন্দার মৃত্যু নিয়ে নানা গুঞ্জন, নানা ধোঁয়াশা রয়ে গিয়েছে। মৃত্যুর পরপরই প্রশ্ন উঠেছিল, এটা মৃত্যু না হত্যা? নাকি আত্মহত্যা? পুলিশ এবং চিকিৎসকদের তরফে নানা সময় একাধিক তত্ত্ব সামনে এসেছে সংবাদমাধ্যমে। সুনন্দার ময়নাতদন্ত রিপোর্ট নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে কোনও কোনও মহলে। নতুন বছরে কিন্তু দিল্লি পুলিশ খুনের সম্ভাবনাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে দেখার কথাই বলছে। সেই কারণে খুনের মামলা দায়ের করেছে তারা। সব শুনে সুনন্দার স্বামী শশী এ দিন বলেছেন, তিনি খুবই অবাক। এমনটা যে হয়ে থাকতে পারে, সেটা তিনি ভাবতেই পারেননি! তাঁর কথায়, “আমার স্ত্রী সুনন্দার মৃত্যুতে দিল্লি পুলিশ অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে খুনের মামলা দায়ের করেছে শুনে আমি বিস্মিত। যদিও আমাদের কখনও মনে হয়নি, সুনন্দার মৃত্যুতে সন্দেহজনক কিছু রয়েছে।”

তবে কে বা কারা খুন করেছিল সুনন্দাকে, সেটা স্পষ্ট নয়। সেই কারণেই, সুনন্দা যে খুনই হয়েছিলেন, সেটা এখনও এক বাক্যে বলা হচ্ছে না পুলিশের তরফে। দিল্লির সরোজিনী নগর থানায় অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেই একটি খুনের মামলা রুজু করেছে তারা। অল ইন্ডিয়া মেডিক্যাল সায়েন্স (এইমস)-র ময়নাতদন্ত ও ফরেন্সিক চূড়ান্ত রিপোর্টের উপরে ভিত্তি করে আজ দিল্লি পুলিশ কমিশনার বি এস বাসি জানিয়েছেন, “বিষক্রিয়াই সুনন্দার মৃত্যুর কারণ। তবে তিনি নিজে বিষ খেয়েছিলেন না তাঁকে জোর করে বিষ খাওয়ানো হয়েছে, অথবা ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে বিষ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা এখনও স্পষ্ট নয়।”

সুনন্দাকে বিষ দিয়ে খুন করানো হয়েছে, এই দাবি অবশ্য আজকের নয়। গত বছর সুনন্দার মৃত্যুর পাঁচ সপ্তাহ পরেই বিজেপি নেতা সুব্রহ্মণ্যম স্বামী অভিযোগ করেছিলেন, সুনন্দা নাকি তারুরের সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানতে পেরেছিলেন এবং তা ফাঁস করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। যা প্রকাশ্যে এলে তারুরের রাজনৈতিক জীবন শেষ হয়ে যেত। সেই কারণে পেশাদার খুনিদের দিয়ে তারুরই সুনন্দাকে খুন করিয়েছেন, এমন মারাত্মক অভিযোগও সুব্রহ্মণ্যমই এনেছিলেন। এমনকী পোলোনিয়াম নামে একটি তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ বিষ হিসেবে প্রয়োগ করা হয়েছে বলেও তিনি দাবি করেছিলেন।

গত বছরের মাঝামাঝি বিজেপির ওই নেতার দাবিকেই জোরালো করে তোলে সুনন্দার দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের রিপোর্টটি। বিভিন্ন মহলের চাপে বাধ্য হয়ে দ্বিতীয় বার সুনন্দার ময়নাতদন্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল দিল্লি পুলিশ। গত জুলাই মাসে দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের রিপোর্টে জানা যায়, সুনন্দার শরীরে ১৫টি আঘাতের চিহ্ন মিলেছে। যার মধ্যে রয়েছে একটি সূক্ষ্ম দাগ। যেটি সম্ভবত ছুঁচ ফোটানোর কারণে সৃষ্টি হয়েছিল। বাকি দাগগুলি কোনও ভোঁতা অস্ত্রের আঘাতে হয়েছিল। দ্বিতীয় ওই রিপোর্টটি আসার পরে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ফের এক বার গোটা বিষয়টি খতিয়ে দেখার দায়িত্ব দেয় এইমস-এর ফরেন্সিক বিভাগকে। গত ২৯ ডিসেম্বর সেই রিপোর্ট জমা পড়ে। সেই রিপোর্টের ভিত্তিতেই আজ দিল্লি পুলিশ খুনের মামলা দায়ের করল।

সুনন্দার দেহে কী বিষ পাওয়া গিয়েছে, সে কথা পুলিশ অবশ্য আজ প্রকাশ্যে বলেনি। বরং ভিসেরা নমুনা চূড়ান্ত পরীক্ষার জন্য ব্রিটেন অথবা আমেরিকার কোনও পরীক্ষাগারে পাঠানো হতে পারে বলে জানিয়েছে তারা। তবে সূত্রের খবর, দ্বিতীয় ময়নাতদন্তে পোলোনিয়াম ২১০-এরই সম্ভাব্য উপস্থিতির উল্লেখ রয়েছে। আজ সুব্রহ্মণ্যম বলেছেন, “সুনন্দার একমাত্র অপরাধ, উনি সত্যি বলতে চেয়েছিলেন। এই খুনে বড় মাপের আর্থিক লেনদেন হয়েছে। বহু প্রভাবশালী মানুষের নাম জড়িয়ে যেতে পারে এই হত্যায়।” তবে এ দিন অবশ্য নতুন করে শশীর নাম শোনা যায়নি তাঁর মুখে।

নতুন করে তদন্ত শুরু হলে অবশ্য শশী তারুর ও তাঁর ব্যক্তিগত সচিব-সহ বেশ কয়েক জনকে ফের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুলিশ। শশীও বলেছেন, “আমি চাই গোটা বিষয়টির বিস্তারিত তদন্ত হোক। পুলিশকে সব ধরনের সাহায্য করতে প্রস্তুত আমি।” সুনন্দার পরিবারের পাশে থাকার আশ্বাসও দিয়েছেন তিনি। সুনন্দার পরিবারের মধ্যে আবার বিষয়টি নিয়ে নানা জনের নানা মত রয়েছে। সুনন্দার ছেলে যেমন মায়ের মৃত্যুতে শশী কোনও ভাবে জড়িত নন বলেই দাবি করেছিলেন সে সময়। আজও সুনন্দার ভাই আশিস দাস বলছিলেন, “এমন যে হতে পারে, এ আমাদের চিন্তার বাইরে ছিল।”

অন্য দিকে সুনন্দার মৃত্যুর সময়েই কিছু আত্মীয়স্বজনের মুখে আবার শোনা গিয়েছিল ভিন্ন সুর। ওই অংশটির দাবি ছিল, পরিকল্পিত ভাবে খুন করা হয়েছে সুনন্দাকে। মৃত্যুর কিছু দিন আগে পাকিস্তানি সাংবাদিক মেহর তরারের সঙ্গে শশী তারুরের ‘সম্পর্ক’ নিয়ে খুবই বিচলিত ছিলেন সুনন্দা। শশীর টুইটার অ্যাকাউন্টে ঢুকে মেহরের সঙ্গে বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তাই নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মনোমালিন্যও হয়েছিল। এই ঘটনার সঙ্গেই সুনন্দার মৃত্যুর যোগ রয়েছে বলে তখন সন্দেহ করেছিলেন পরিবারের কেউ কেউ। আজ পুলিশ খুনের মামলা করার পরে সুনন্দার তুতো ভাই অশোক কুমার বলেন, “আমাদের পরিবার প্রথম থেকেই বিশ্বাস করত সুনন্দাকে খুন করা হয়েছে। আমাদের ধারণা, এর পিছনে তারুরের হাত রয়েছে।”

গত বছর ১৭ জানুয়ারির রাতে দিল্লির একটি পাঁচতারা হোটেলে সুনন্দার মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছিল। প্রাথমিক ভাবে এইমস-এর ময়নাতদন্তের যে রিপোর্ট পুলিশকে দেওয়া হয়েছিল, তার ভিত্তিতে দিল্লি পুলিশ জানায়, অ্যালপ্রাক্সের মতো ঘুমের ওষুধ অতিরিক্ত মাত্রায় খাওয়ার জেরেই মৃত্যু হয় সুনন্দার। কিন্তু রিপোর্টে সুনন্দার শরীরে ডজন খানেকেরও বেশি আঘাতের চিহ্নের কথাও ছিল। তদন্তে সেই বিষয়গুলি এড়িয়ে যাওয়ার অভিযোগ ওঠে দিল্লি পুলিশের বিরুদ্ধে। দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত রিপোর্ট হাতে আসার পরে রহস্য আরও ঘনীভূত হয়।

কী রকম? প্রথমত, সুনন্দার মৃতদেহ যে খাটে পড়ে ছিল তার পাশে প্রচুর অ্যালপ্রাক্স জাতীয় ঘুমের ওষুধ ছড়িয়ে ছিল। অথচ চূড়ান্ত রিপোর্ট বলছে সুনন্দার পাকস্থলীতে কোনও ঘুমের ওষুধ পাওয়া যায়নি। তা হলে মৃতদেহের চারপাশে কেন এত অ্যালপ্রাক্স পড়েছিল? পরিকল্পনামাফিক পুলিশকে বিভ্রান্ত করতেই কি ওই ওষুধ ছড়িয়ে রাখা হয়েছিল?

দ্বিতীয়ত, প্রাথমিক ময়নাতদন্তে শরীরে একাধিক আঘাতের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু তদন্তে সেগুলি খতিয়ে না দেখে কেন আত্মহত্যার ঘটনা বলে চালানোর চেষ্টা করল পুলিশ? এর পিছনে কি কোনও চক্রান্ত ছিল?

তৃতীয়ত, মেহর তরারের ঘটনার পরে মৃত্যুর ঠিক আগের দিন সংবাদমাধ্যমের কাছে যৌথ বক্তব্য রাখেন শশী ও সুনন্দা। জানান, তাঁরা সুখী দম্পতি। যদিও সুনন্দার পরিবারের দাবি ছিল, শশীর চাপে ওই কাজ করতে হয়েছিল সুনন্দাকে। কিন্তু তদন্তে এই দিকটি সম্পূর্ণ উপেক্ষার অভিযোগ ওঠে পুলিশের বিরুদ্ধে।

চতুর্থত, সুনন্দার প্রথম ময়নাতদন্তের দায়িত্বে ছিলেন এইমস-এর ফরেন্সিক বিভাগের প্রধান সুধীরকুমার গুপ্ত। রিপোর্ট পেশের আগে তিনি অভিযোগ করেন, রিপোর্ট পাল্টাতে তাঁর উপরে একাধিক মহল থেকে চাপ তৈরি করা হয়েছে। যদিও এইমস কর্তৃপক্ষ এই অভিযোগ অস্বীকার করেন। সুধীরকেও দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। রিপোর্ট বদলের জন্য কোথা থেকে চাপ আসছিল সুধীরের উপরে, তা জানার আগ্রহ দেখায়নি পুলিশ।

আজকের ঘটনাপ্রবাহে স্বাভাবিক ভাবেই দিল্লি বিধানসভা ভোটের মুখে অস্বস্তিতে পড়েছে কংগ্রেস শিবির। সুনন্দার মৃত্যুর তদন্ত ইচ্ছে করে অন্য পথে চালিত করা হয়েছিল বলে প্রমাণিত হলে তার দায় গিয়ে পড়বে কংগ্রেসের উপরেই। কারণ তখন শশী কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী আর কেন্দ্রে কংগ্রেস নেতৃত্বধীন ইউপিএ সরকারই ছিল।

বিজেপি মুখপাত্র সম্বিৎ পাত্র আজ বলেই দিয়েছেন, “প্রথম থেকেই ওই মামলাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে আসছিল কংগ্রেস। লোকসভা ভোটের মুখে দলের ভাবমূর্তি রক্ষায় তারুরকে ক্লিনচিট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তারা।” অন্য দিকে এত দিন কংগ্রেস বলে আসছিল, সুনন্দার মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি করছে বিজেপি। আজ দলের মুখপাত্র অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি কিন্তু বলছেন,“এটা আইনি প্রক্রিয়া। সব মামলা নিয়ে এত বেশি হইচইয়ের প্রয়োজন নেই।”

এর আগে আইপিএল-এ কোচি টিম কেনা নিয়ে বিতর্কে জড়িয়েছিলেন শশী-সুনন্দা। তার জেরে সাময়িক ভাবে মন্ত্রিত্ব খোয়াতেও হয়েছিল তারুরকে। পরে নতুন করে আইপিএল-এ বেটিং কেলেঙ্কারির আবহে শশী-সুনন্দা নতুন করে ঝামেলায় পড়তে পারতেন কি না, সেই সন্দেহও রয়েছে কোনও কোনও শিবিরে। সুনন্দার মৃত্যুর পিছনে ওই ঘটনার ভূমিকাও তাই আতস কাচের নীচে থাকছে।

কেন্দ্রে মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পরে তারুর নিজের লেখায় মোদীর প্রশংসা করেছিলেন। সুনন্দা-তদন্ত তার পিছনে কোনও ভূমিকা নিচ্ছিল কি না, এই প্রশ্নও তখন উঠেছিল বিজেপি এবং কংগ্রেস দু’দলের অন্দরেই। দিল্লি পুলিশের বক্তব্য সব প্রশ্নকেই জিইয়ে রাখল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

sunanda pushkar shashi tharoor delhi police
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE