Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪

চিংড়ি নিয়ে দু’চার কথা

চিংড়ি নিয়ে তো কম কথা হল না। চিংড়ি নাকি জলের পোকা। চিংড়ি নাকি মাছ না। তা বাপু চিংড়ি জলের পোকা হবে না তো কি ড্যাঙার পোকা হবে! আ মোলো যা। ওই যে সরু সরু ল্যাগব্যাগে কয়েকটা পা দিয়ে ড্যাঙায় হাঁটা যায় নাকি! না না, ও সব জলের মধ্যেই সোন্দর লাগে। আর তা ছাড়া চিংড়ি মাছ না মাছ না যতই বলো, মেনুতে কিংবা খেতে বসলে সে মেগাস্টার। তার তুল্য অমিতাভ বচ্চন বা লিওনেল মেসিও নয়।

রূপক চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

চিংড়ি নিয়ে তো কম কথা হল না। চিংড়ি নাকি জলের পোকা। চিংড়ি নাকি মাছ না। তা বাপু চিংড়ি জলের পোকা হবে না তো কি ড্যাঙার পোকা হবে! আ মোলো যা। ওই যে সরু সরু ল্যাগব্যাগে কয়েকটা পা দিয়ে ড্যাঙায় হাঁটা যায় নাকি! না না, ও সব জলের মধ্যেই সোন্দর লাগে। আর তা ছাড়া চিংড়ি মাছ না মাছ না যতই বলো, মেনুতে কিংবা খেতে বসলে সে মেগাস্টার। তার তুল্য অমিতাভ বচ্চন বা লিওনেল মেসিও নয়। বাঙালদের ওই এক দোষ, ইলিশ ইলিশ করে হেদিয়ে মরল। তার ওপরে আরও দাবি —এ পৃথিবীতে নাকি সর্বত্র ইলিশ ঘুরে বেড়াচ্ছে। যেন মার্কো পোলো বা হিউয়েন সাঙ। বাঙালদের দাবি—আমেরিকায় স্যামন হল এখানকার ইলিশ। একদা মগের মুলুক মানে এখনকার মায়ানমারে ইরাবতী নদীতে যে ইলিশ পাওয়া যায় তার স্বাদ নাকি দেবভোগ্য। তা সে সব ইলিশ তো সাপ্লাই আসে। ফ্যাকাশে ফ্যাকাশে হলদেটে, হলদেটে। কে যেন বলেছিল নোনামাছ তো, মিষ্টি জলে যখন ঢোকে তখনই আসল স্বাদ পাওয়া যায়। যার জন্য বাগবাজার বা শ্রীরামপুরের ইলিশের টেস্ট সবচেয়ে ভাল। এই ভাগাভাগি আর আদিখ্যেতা করতে করতেই ইলিশ গেল। অথচ আমাদের চিংড়িকে দেখো—ঠিক যেন ফুটবলের ব্রাজিল, ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়া। অলওয়েজ এক স্ট্যান্ডার্ড বজায় রেখে চলেছে। আর কত রকমই তার বাহার। মেতি থেকে চাপড়া হয়ে বাগদা হয়ে গলদা। একটু কষ্ট করে বানতলার রাস্তা ধরে মালঞ্চে যাও। দেখবে চিংড়ি কাকে বলে! কত রকম তাদের গায়ের রং, কত রকম তাদের ডিজাইন, ডিভাইন দৃশ্য সে সব। মেতি চিংড়ি মানে মেছুনিদের কাছে মিলবে। কুচি কুচি হদ্দ কুচি। স্তূপ হয়ে পড়ে থাকে। আলাদাই করা যায় না। সাইজে বড় জোড় পিঁপড়ে কিংবা মশা-মাছির মতন। আহা-হা, ভাল করে ধুয়ে নুন, হলুদ, লংকা মাখিয়ে ছোট ছোট বড়া আর হুইস্কি। হ্যাঁ, ভাই পাগলের মতো গিলবেন না। পেট ছেড়ে দিতে পারে। এর ওপরে কুচো চিংড়ি, মেতি চিংড়ির অগ্রজ। বড়াভাজা খাওয়ার জন্য আদর্শ। এ কলকাতা শহরের প্রায় সমস্ত দিশিমদের পানশালায় মিলবে কুচো চিংড়ি ভাজা, লাল টকটকে। ওপরে পেঁয়াজ লঙ্কার কুচো ছড়ানো। শুধু কি তাই? না শুধু তাই নয়, এই যে বাঙালরা লাফায় ওদের সাধের ইলিশ ইলিশ করে, তারা অব্দি পান্তাভাতের সঙ্গে চিংড়ির মানে কুচো চিংড়ির বড়া খায়। এর পর এসে গেল ছোট ও মাঝারি সাইজের ককমারি চিংড়ি। কী বা তাদের গায়ের রং, কীই তাদের বাহার। এদের মধ্যে ভীষণ সেক্সি দেখতে টাইগার প্রন। হ্যাঁ টাইগার প্রনকে এ নামেই সবাই ডাকে। তাকে কেউ চিংড়ি বলে না। লাল-গাঢ় খয়েরি রঙের ডোরাকাটা দাগ পিঠের খোলসের ওপর। যদিও স্বাদের কথা বললে বলতে হবে চাবড়ার কথা। অফ হোয়াইট অথবা ঘি অথবা চন্দন রঙের এ চিংড়ির স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয়।

কোথায় লাগে এর কাছে খোকা ইলিশ-চন্দনা ইলিশ। এই মাপের মধ্যেই দেখা মিলবে বাগদা। বাগদার স্বাদ সবাই-ই জানে। বাঙালরা তো ইলিশ ছেড়ে বাগাদ দিয়ে আলু-ফুলকপির ঝোল খায় এক থালা ভাত মেখে। বাঙালির ক্রমবর্ধমান বাঙালি রেস্তোরাঁয় ডাবচিংড়ি নামক খাদ্য তালিকায় বাগদার অনিবার্য উপস্থিতি রয়েছে। বাগদা আর গলদা এ বলে আমায় দেখ তো ও বলে আমায় দেখ। অভিজাত নীলচে-সবুজ দাঁড়া আর বর্ণ-সহ গলদাকে দেখে মনে হয় যেন ফ্যারাও তুতেনখামেন। গলদা চিংড়ির মালাইকারী —এই বাক্যবন্ধ যেন প্রবাদ কিংবা কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে। পোস্তবাটা, নারকোল, সাদা সর্ষেবাটা দিয়ে গলদাচিংড়ির সহমরণ বা মধুচন্দ্রিমা ভোজনরসিকের অ্যাড্রিনালিনের ক্ষরণ বাড়িয়ে দেয়। সাহেবরা আবার বেশি ‘স্পাইস’ খান না। তাঁরা স্বাস্থ্য সচেতন। ফলে গলদা সেদ্ধ করে তার ওপরের বর্ম (খোসা লিখতে দুখ্খু হয়) ছাড়িয়ে নানা রকমের মেয়োনিজ-চিজ ও সস মাখিয়ে খান। কলকাতার দুটো বাজার মাছের জন্য অতি প্রসিদ্ধ। প্রথমটা মানিকতলা, দ্বিতীয়টা গড়িয়াহাট। সম্ভবত এই দুটো বাজারেই দেখা যায় সমুদ্রের চিংড়ি। আহা কি তাদের গরিমা। কী তাদের ঔজ্জ্বল্য। একবার দেখা একটি চিংড়ি, যাকে বলে জেড ব্ল্যাক। কিলোয় বড়জোড় দেড়খানা। এমনকী একে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্ল্যাকক্যাটও বলা যায়। আর একটার রং একেবারে সমুদ্র সবুজ রঙের। সে সম্ভবত একটা নশো গ্রাম ওজনের মতো ছিল। তা ইলিশের সঙ্গে চিংড়ির পার্থক্য কী? আরে ভাই জলের পোকা যতই বলো না কেন তাকে মাছের সম্মান দিতেই হয়।

যদিও তার চেহারায় মাছের মাছত্ব বা মৎস্যত্ব বিন্দুমাত্র নেই। কিন্তু আমেরিকার স্যামন আর কোলাঘাটের ইলিশের চেহারায় যেমন মিল নেই, কিন্তু সারা পৃথিবীর সর্বত্র চিংড়ির চেহারা একই রকম। এখানেই চিংড়ির মতো সর্বহারাদের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমাদের দক্ষিণ কলকাতার মধ্যবিত্ত বাজারে মাঝে সাঝে আসে চিংড়িমাছের মাথা, না গোটা বডি নয়। শুধু মাথা। বাঙালি চিংড়িকে এতই আপন করেছে যে ওই মাথা দিয়ে মাখা মাখা ঝালটাল এক রকমের পদ হয়। যা দিয়ে এক সানকি ভাত মেরে দেওয়া যায়। বাকি বডির দাম এতই এবং চাহিদাও এত যা সাত সমুদ্র পেরিয়ে সাহেবদের পাতে গিয়ে উপস্থিত হয়। ইলিশের সে গ্ল্যামার নেই। মধ্যবিত্ত-দরিদ্রদের ধরাছোঁয়ার বাইরে সে। অথচ চিংড়ির দেখা —সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রামের সাবিনাবিবি থেকে মুম্বইয়ের আলিয়াভাট—সবার পাতেই তার বিচরণ সমান। গরিবের যেমন ভগবান আছে, গরিবের তেমন চিংড়িও আছে। তবে—সাধু সাবধান। চিংড়ি কিনে রান্না করে খাওয়ার আগে তাকে যথেষ্ট সম্মান জানিয়ে পাতে তুলবেন। না হলে স্যালাইন-সহ হাসপাতালে শুয়ে থাকতে হবে। পেট সে এমন ছোটাবে ,—যা কল্পনাতীত। আমার প্রাণের বন্ধু চিরঞ্জীবের সঙ্গে গিয়েছিলাম বউবাজারে এক মাছের আড়তে। সে মালিক অল্প বয়সি। রসিক। সন্ধে নামলে ওই অফিসে বসেই সে পানভোজন করে। আমাদেরও পান করার আহ্বান জানায়। হুইস্কির সঙ্গে সে জিজ্ঞেস করে চিংড়ি মাছ ভাজা খাব কি না। আমরা সম্মতি জানাতেই তার লোকও একটি বড় থালায় একটা চিংড়ি নিয়ে আসে, যা প্রায় এক ফুটেরও বেশি। সেই চেহারা দেখে তাকে খাব কি, তার নামে শহিদ বেদি বানাতে ইচ্ছে হয়েছিল বউবাজার মোড়ে। এ গ্ল্যামার ইলিশের নেই। সে কখনও ধরা পড়ে, কখনও পড়ে না। চিংড়ি নিত্যদিন আমজনতার সঙ্গে। এতটাই পুরনো যে কালীঘাটের পটেও তার উপস্থিতি রয়েছে। আসলে সে আমাদের পরিবারের, মানে মানুষের পরিবারে ও পাতে সারা বছরের অঙ্গ। ইলিশের মতো সাময়িক না। সে চিরকালের থালা অথবা ডিসের রাজাধিরাজ। মহানুভব সম্রাট।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

abpnewsletters
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE