Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪

থিম শব্দটাই বাংলা হয়ে গিয়েছে

আজকের পুজো বাণিজ্যিকীকরণের স্রোতে ধর্ম ও আন্তরিকতা হারাচ্ছে। না, এ অভিযোগ ঠিক নয়। আদতে হৃদয়ের এ উৎসব সমাজ ও মানুষের কাছ থেকে এখনও দূরে সরে যায়নি। বহু পেশার, বহু ধর্মের ও বিশ্বাসের মানুষ, নানা বর্ণ ও শ্রেণির মানুষের মেলামেশায় প্রকৃতই সর্বজনীন হয়ে ওঠে উৎসবের আবহ। কলকাতার পুজোর ভাব-বদল নিয়ে লিখলেন দেবাশিস আইচ।আজকের পুজো বাণিজ্যিকীকরণের স্রোতে ধর্ম ও আন্তরিকতা হারাচ্ছে। না, এ অভিযোগ ঠিক নয়। আদতে হৃদয়ের এ উৎসব সমাজ ও মানুষের কাছ থেকে এখনও দূরে সরে যায়নি। বহু পেশার, বহু ধর্মের ও বিশ্বাসের মানুষ, নানা বর্ণ ও শ্রেণির মানুষের মেলামেশায় প্রকৃতই সর্বজনীন হয়ে ওঠে উৎসবের আবহ। কলকাতার পুজোর ভাব-বদল নিয়ে লিখলেন দেবাশিস আইচ।

ছবি: দেবাশিস ভাদুড়ি

ছবি: দেবাশিস ভাদুড়ি

শেষ আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

পুঁথিকার দেবতা-সমস্তের ধ্যান দিলে শিল্পে, সেই ধ্যান মতো গড়ে চলল—এই ঘটাই যদি পুরোপুরি ঘটত তবে আমাদের আর্ট কেবলমাত্র ধ্যানমালার ইলাস্ট্রেশন হয়ে যেত কিন্তু এর চেয়ে বড় জিনিস হয়ে উঠল বুদ্ধ নটরাজ প্রভৃতি নানা দেবমূর্তি সেটা ধ্যানমালার লিখিত ধ্যানের অতিরিক্ত শুধু শিল্পের শিল্পক্রিয়া তাদের অমরত্ব দিল বলে এবং শুধু সেইটুকুর জন্য আর্ট জগতে এই সব দেবতার স্থান হল।----- অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বারো ইয়ারির পুজো। দালালি আর বেনিয়ানির পয়সা দু’হাতে উচ্ছুগ্গ করেছেন বাবুরা। এ পাড়ায় ও পাড়ায় মচ্ছবের ফোয়ারা। হাফ আখড়াই-সং-বাইজি নাচ-বুলবুলির লড়াই। বাবুর বারোয়ারির তলায় সাজ সাজ রব। দেড় মন গাঁজা, দু’মন চরস, সাত গামলা দুধ, বারো বেনের দোকান সাফ করে এলাচ, কর্পূর দারচিনি অম্বুরি ইরানি তামাকেরও পাহাড় জমেছে।

নাটমন্দিরে মা ভগবতীরও কী অপূর্ব রূপ। ‘ঠাকুরণের বিবিয়ানা মুখ, রং ও গড়ন আর্সল ইহুদি ও আরমানিকেতা।’ পুজো শেষ। আট দিন পর বিসর্জন। ইংরেজি বাজনা, তুর্কি ঘোড়া, নিশান হাতে ফিরিঙ্গি-সহ শহর ঘুরে গঙ্গায় বিসর্জন। বিশ-পঁচিশ হাজার টাকার ‘শ্রাদ্ধ’ ফুরলো। বিষণ্ণ বাবুরা ঘরে ফিরলেন। তাদের কাপড় ভিজে থাকলে ‘অনেকেই বিবেচনা কত যে বাবুরা মড়া পুড়িয়ে এলেন।’ (হুতোম)।

নবো মুনসি, ছিঁড়ি বেনে, ছুঁচোশীলদের পুজো কতটা মৌজ-মস্তি-মচ্ছব আর কতটাই বা দেবদ্বিজে ভক্তি, তা নিক্তি মেপে ওজন করা যায় কিনা, তা বিদ্বৎজনেরাই বলতে পারবেন। কিন্তু ক্রমে ক্রমে সে একদিন শারদোৎসব হয়ে উঠল। পুজোর গন্ধ পেলেই বাঙালির মন কেমন কেমন করে ওঠা। কোথায় যে তার ধর্মের বাঁধন, শাস্ত্রের বিধান আলগা হয়ে সামাজিক উৎসব হয়ে ওঠে, আমজনতা তার খোঁজ চায় না। বোধন-অঞ্জলি-সন্ধিপুজো-দধিকর্মার চিরাচরিত শাস্ত্রাচারের আবহে যে নম্র নতজানু ভক্তপ্রাণ, সেই যে পরমুহূর্তে বাঁধন ছেঁড়া প্রাণের জোয়ারে ভেসে যাবে দুর্গাপুজোয় এ যেন তার ভবিতব্য।

সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস-এর অধিকর্তা ইতিহাসবেত্তা তপতী গুহঠাকুরতা যেমন খুব সহজ ভাবেই মনে করেন, কলকাতার দুর্গাপুজো আসলে এক উৎসব। যে উৎসব ধর্মের, যে উৎসব সাংস্কৃতিক-সামাজিক। বিদ্যার আলয়ে জ্ঞান চর্চার কেন্দ্রমণি এই প্রবীণা, যিনি শিল্প-ঐতিহাসিকও বটে, পুজোর কথা উঠলে তিনি নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হন— তাঁর চোখের সামনে ভেসে ওঠে গাঁয়ের পুজো, পাড়ার পুজো। কিন্তু, আজকের পুজো বাণিজ্যিকীকরণের স্রোতে ধর্ম ও আন্তরিকতা হারাচ্ছে। না, এ অভিযোগ মানতে নারাজ তিনি। তাঁর মতে, হৃদয়ের এ উৎসব সমাজ ও মানুষের কাছ থেকে এখনও দূরে সরে যায়নি। বহু পেশার, বহু ধর্মের ও বিশ্বাসের মানুষ, নানা বর্ণ ও শ্রেণির মানুষের মেলামেশায় প্রকৃতই সর্বজনীন হয়ে ওঠে উৎসবের আবহ।

কিন্তু, এই যে বলা হয়, পুজো মানে শুধু কেনাকাটি-পণ্যসংস্কৃতি, একটা কার্নিভাল। উচ্চমার্গ থেকে নামিয়ে এনে যাকে মুনাফার উৎসে পরিণত করা হয়েছে। এই বুড়োটে অভিযোগও তিনি মানতে রাজি নন। উৎসব ঘিরে বাণিজ্যের বিকাশ ঘটছে, উৎসবের জন্যই তা জরুরি। কিন্তু মানুষকে বাদ দিয়ে যে কিছু হচ্ছে না— এ কথাটা সহজ করেই জানিয়ে দেন তিনি। পুজো তার কাছে এখন এক সচেতন নাগরিক উৎসব। আর পুজোও ক্রমে ক্রমে বদলে গেল কত। কুমোরটুলি ও ডেকরেটর সংস্কৃতি ভেঙে তৈরি হয়েছে আজকের ঘরানা। এখন যাকে শিল্পীদের ভাষায় বলা হচ্ছে মিথস্ক্রিয়-স্থান-নির্দিষ্ট-স্থাপনাশিল্প। পরিভাষায় ইন্টারঅ্যাকটিভ-সোইট স্পেসিফিক-ইনস্টলেশন আর্ট। এ কথা বলছেন শিল্পী পার্থ দাশগুপ্ত। শিল্পী সুশান্ত পাল বলছেন, বাঁশ-বাটাম-দড়ি কাপড়ের ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসার প্রচেষ্টা এটা। পুজোর স্থানটিকে স্থাপত্য-ভাস্কর্য-চিত্রশিল্পীদের রসে জারিত করে তোলা।

এই পুজো-স্থান, পাড়ার নির্দিষ্ট স্থানটি সে গলি হোক, পার্ক হোক, চার পাশের বাড়ি-ঘরের মাঝে ছোট্ট মাঠ হোক— এই স্থানটুকু আসলে শিল্পী ভবতোষ সুতারের কাছে এক সাদা ক্যানভাস। যেখানে তিনি শিল্পের স্বাক্ষর, শিল্পীর স্বাক্ষর খোদাই করে রেখে যেতে চান। সনাতন দিন্দা, রূপচাঁদ কুণ্ডু, দীপ্তীশ ঘোষ দোস্তিদার, শান্তনু মিত্রদের জিজ্ঞাসা করুন, তাঁরাও বলবেন একই কথা। বলবেন, এই শিল্প সমাহার পাবলিক আর্ট। শিল্পীর স্টুডিয়োতে যাঁরা কখনও পা রাখেননি, আর্ট গ্যালারিতে শিল্পের রসাস্বাদনের কথা যাঁদের মনে হয়নি—তাঁরাই, অধিকাংশ তারাই ভরিয়ে তুলেছেন পুজা প্রাঙ্গণ। যা শিল্প-প্রাঙ্গণ হয়ে উঠেছে। সরাসরি যোগাযোগ হচ্ছে সাধারণ মানুষের সঙ্গে শিল্পীর শিল্পের। এক মিথস্ক্রিয়া ঘটছে শিল্পীর সঙ্গে। পারস্পরিকতার মধ্য দিয়ে। আর এই ঘটনা ঘটিয়ে তুলছেন ‘পাড়ার ছেলে’রা। হুতোমের ভাষায় ‘হুজুকে কলকাতা’।

শিল্পী সুশান্ত বলছেন, এ বাঙালির পাগলামো। তিন মাস ধরে পাড়ার মধ্যে টিন দিয়ে ঘেরা স্থানে তৈরি হচ্ছে ভাস্কর্য, স্থাপনা শিল্প। তার সঙ্গে যোগ কত কারিগরের। কেউ গ্রিলের মিস্ত্রি, কারও কুলবৃত্তি বাঁশ-বেতের কাজ করা, কারও বা পেশা ফাইবার কাস্টিং। ব্যবসা আধ বন্ধ, চাকরিতে আধা-ছুটি। সকাল-দুপুর-সন্ধে-রাতে হাজির পাড়ার ছেলেরা, ক্লাব কর্মকর্তারা। ভবতোষ বলছেন, পাবলিকের টাকায় হচ্ছে এই সবই। কর্মকর্তারা শিল্পীর হাতে টাকা তুলে দিয়ে বলছেন, ‘কিছু একটা গড়ো। আর নিজের সব শিল্পসত্তা দিয়ে, মনন ও হাড়ভাঙা খাটুনি দিয়ে গড়ে তুলছেন শিল্পী। ইতালির মিলানবাসী শিল্পী সফিকুল কবির চন্দনকে উদ্ধৃত করে পার্থ দাশগুপ্ত বলছেন, এ হল স্থাপনাশিল্পের গণতন্ত্রীকরণ। সর্বজনীন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নন্দনতত্ত্ব। এ কথা সমান ভাবে মানেন তপতী গুহ ঠাকুরতা। ‘নিজস্ব অধিকারেই এ পাবলিক আর্ট। খোলা আকাশের নীচে একটু অনুপম কর্মকাণ্ড। শিল্পী সমাজ, শিল্পের সঙ্গে সাধারণ সমাজের একটা ভাবের আদান-প্রদান ঘটে চলেছে। পুজোর আঙিনায়। তাঁরা কেউ শিল্পদীক্ষিত, কেউ বা সীমিত শিক্ষার অধিকারী, কারও এখনও তেমন করে চোখ ফোটেনি। তবু, এই জানা-না-জানা প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াচ্ছে না উপভোগের, আদান-প্রদানের।’

এক চমৎকার ব্যাখ্যা দিলেন শিল্পী দীপ্তীশ ঘোষ দস্তিদার, তিনি বললেন, দেখুন অনেক মানুষই বলছেন শিল্প বুঝি না। অথচ তাঁরা খাজুরাহো যাচ্ছেন, কোনার্ক যাচ্ছেন, মহাবলীপুরম-অজন্তা-ইলোরা যাচ্ছেন। বিষ্ণুপুরের মন্দির দেখতে যাচ্ছেন। ইউরোপ গেলে গ্রিক-রোম-প্যারিস যাচ্ছেন, মিউজিয়াম দেখছেন—তাঁদের আসলে, সাধারণ মানুষেরও শিল্প দেখার একটা প্রবল খিদে রয়েছে। পার্থ কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, দেখুন এই তাজমহল, খাজুরাহো-কোনার্ক কিন্তু খোলা আকাশের নীচে জনপ্রিয় স্থানে গড়ে উঠেছে। সম্রাট অশোক স্তম্ভ গড়ে তুলছেন খোলা স্থানে প্রজাদের লক্ষ করেই—সেটা একটা পিস অফ আর্ট হয়ে উঠল শিল্পীদের হাতে পড়ে। আমরা যে আঙিনা নির্মাণ করছি সেখানে মানুষ কিন্তু স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই আসছেন। সে মানুষকে সহজ ভেবে নেওয়া ঠিক হবে না। সে দর্শক কঠিন।

স্বাভাবিক নিয়মে এ বদল একদিনে হয়নি। এর পিছনে একটা সলতে পাকানোর ইতিহাস রয়েছে। শিল্প-ইতিহাসের অধ্যাপক—এ বিষয়ে যাঁর এক গবেষণা গ্রন্থ বর্তমানে ছাপাখানায় এবং শিল্পীরা তার কাল নির্ধারণ করেছেন। পার্থর মতে, যার শুরুয়াত কলকাতা পুলিশ ও কলকাতা কর্পোরেশনের হাত ধরে। কলকাতার পুজোকে রুচিশীল করে তোলা, আইন-কানুন শৃঙ্খলা রক্ষা করে উৎসবের আনন্দে অংশগ্রহণ করার নাগরিক মন তৈরির সেই শুরু। তার জন্য আয়োজন প্রতিযোগিতা। ডানলপের আর্থিক সহযোগিতায় কলকাতা পুলিশের পুজো-ম্যাপ ও সেই লক্ষ্যে। আশির দশকের প্রথম ভাগ সেটা। এই ভাবনাকে জোর ধাক্কা দিয়ে গতির সঞ্চার করল এশিয়ান পেন্টস ‘শারদ সম্মান’। যার স্লোগান ছিল ‘শুদ্ধ শুচি ও সুস্থ রুচি।’ সালটা ১৯৮৫। তার সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এল পুজো মণ্ডপে বাংলা গান, বিশিষ্ট পল্লিগুলিতে সানাই, সরোদ বাজল। উৎকট উল্লাস লারেলাপ্পা থেকে মুক্তি পেয়ে বাঙালিয়ানায় ফিরল। পুজো সংস্কৃতির দিকে মুখ ফেরাল। আরও একটি পুরস্কার চালু হয়েছিল সে সময়, ‘শিরোমণি পুরস্কার’। প্রথম প্রাপক উস্তাদ বিসমিল্লা খান। একে একে পেলেন বিকাশ ভট্টাচার্য, গণেশ হালুইয়ের মতো শিল্পীরা। আবার এঁরাই শারদ সম্মানের বিচারক হয়ে মণ্ডপে মণ্ডপে যাচ্ছেন—তাঁদের মুখ দিয়ে ‘বাঃ’ বা ‘বেশ হয়েছে’ উক্তি শুনে পল্লিবাসী আত্মহারা। এই সৎ প্রচেষ্টা প্রতিষ্ঠা পেল অচিরেই। নতুন কিছু অভিনব তাড়না পাড়ায় পাড়ায় উন্মাদনা সৃষ্টি করল। যুক্ত হতে থাকলেন আর্ট কলেজের ছাত্র-শিক্ষকরা। স্বাধীন শিল্পীরা।

যেমন, তৈরি হল পুকুর-মরাই-সবজিবাগান-গ্রাম। তেমনই মুক্তেশ্বর মন্দির কিংবা সাঁচি স্তূপের অনবদ্য প্রায় নিখুঁত রেপ্লিকা গড়ে চমকে দিলেন দীপক ঘোষ। কারুকার্য মণ্ডিত সে অপূর্ব শোভা জানান দিল পুজো বদলাচ্ছে। অমর সরকার, ভবতোষ সুতাররা গ্রাম ছেড়ে তুলে আনছেন পট-গালা-নাগা শিল্প। সুবোধ রায় বস্তার-ছত্তিশগড়কে হাজির করছেন নাগরিক পল্লির অন্দরে। মধুবনি আসছে। শীতল পাটি-মাদুর-ডোকরা-টেরাকোটা-তাঁত আসছে। এ যেন পুজো মণ্ডপ নয়, লোকশিল্পের প্রদর্শশালা। গ্রাম থেকে শিল্পীরাও আসছেন।

কলকাতা বহিঃকলকাতা তখন বিস্ময়াবিস্ট। এ ভাবেই পুজো যোগ হয়ে গেল সারা বছরের কর্মকাণ্ডের মধ্যে। বছরভর গবেষণা শুরু করলেন শিল্পীরা। ইনকা কিংবা আফ্রিকা অথবা সিন্ধুসভ্যতা বিশ্বজুড়ে শিল্পের যত মণিমাণিক্য রয়েছে, কলকাতা তা সংগ্রহে বেরিয়ে পড়ল। কেউ চললেন ভিমবেটকায় গুহা চিত্রের সন্ধানে। কেউ বা চৌষট্টি যোগিনী নিয়ে মাতলেন। একটা ইংরেজি শব্দ পুজোর পাকেচক্রে বাংলা হয়ে গেল ‘থিম’। একটা বাংলা শব্দবন্ধ তৈরি হল ‘থিম পুজো’। শুধু তাই নয়, নীরদ মজুমদার, বিকাশ ভট্টাচার্য, পরিতোষ সেনদের মতো চিত্রশিল্পীদের কিংবা মীরা মুখোপাধ্যায়, উমা সিদ্ধান্তদের মতো ভাস্করদের ডাক পড়ল মায়ের শৈল্পিক মূর্তি গড়ে তোলার জন্য।

এ এক অন্য অভিঘাত সৃষ্টি করল নগর কলকাতায়। চার দিনের জন্য হলেও কলকাতায় মফফস্সল গ্রাম থেকে আসা লক্ষ লক্ষ মানুষের মধ্যে এক আশ্চর্য শৃঙ্খলাবোধ দেখা দেয়। তপতীদেবী যাকে বলছেন সিভিক সেন্স। তিনি বলছেন, ‘দেখুন এই সময়টা ধর্ষণের-লুঠ তরাজের খবর নেই। লক্ষ লক্ষ মানুষ দিনে রাতে রাস্তায়। আইন-শৃঙ্খলার অবনতি নেই। পুলিশি ম্যানেজমেন্ট এই সময়ই সবচেয়ে ভাল। ক্লাব-সদস্য, স্বেচ্ছাসেবীরা সহায়তা করছেন। একটু সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি হয়ে উঠেছে। পরিবেশ বিধির কথা বেশি বেশি শোনা যাচ্ছে। বিদ্যুৎ চুরি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। দেবীর রং যেন পরিবেশ বান্ধব হয় তার প্রচেষ্টা চলছে। বিসর্জনের সঙ্গে সঙ্গে নদী থেকে তুলে ফেলা হচ্ছে কাঠামো। এমনটা যে সারা বছর দেখা যায় না তার জন্যও গভীর আক্ষেপ রয়েছে তাঁর।

আরও একটা সুদূরপ্রসারী অভিঘাতের সৃষ্টি হয়েছে। এক বড় শ্রেণির দর্শকদের মধ্যে। তা হল রুচির বদল, রুচির সৃষ্টি। শিল্পীরা সকলেই বলছেন ঘরের দেওয়ালে লক্ষ্মী-গণেশের ক্যালেন্ডার বাতিল হয়ে গিয়েছে। ঝুলছে কোনও মেদিনীপুরের চিত্রকরের পট। মুলেপ, টেরাকোটা, ডোকরা, মাদুর দিয়ে তৈরি হচ্ছে গৃহসজ্জা। যা ছিল কতিপয় শিক্ষিত মানুষের অর্জিত চর্চা, তা এখন একটা গণচর্চার রূপ পাচ্ছে। বছরভর হস্তশিল্প মেলা, সর্বভারতীয় সরসমেলা, স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীর মেলা এই রুচি বদলের হাত ধরেই শহরে জাঁকিয়ে বসেছে।

কিন্তু একটা সময় আত্মপরিচয়ের সন্ধান শুরু হল শিল্পীদের মধ্যে। মন্দির প্রাঙ্গণ শিল্প-সম্মত করে সাজিয়ে গুছিয়ে তোলার দিকে তার আর মন রইল না। শিল্পচর্চা, শিল্পের ব্যাকরণ জানা প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পীরা এ বার ভাঙায় মন দিলেন। ক্ষেত্র প্রস্তুত ছিল। তৈরি হল এক নতুন খেলা। যেখানে মুখ্য শিল্পীই সব। তারই নির্দেশনায় গড়ে উঠছে এক স্থাপত্য ভাবনা। দেবী ভাস্কর্য হয়ে উঠছেন। যার মধ্যে একটা নির্মাণের জ্ঞান, নকশা তৈরির অধীত বিদ্যা, সঙ্গীত ও আলোর ব্যবহার। হয়তো কোনও শিক্ষানবীশ শিল্পী, কারিগর সঙ্গীত পরিচালক তাঁকে সাহায্য করছেন। কিন্তু সামগ্রিক ভাবনাটা শিল্পীর। তাঁর ভাবনায় বিচ্ছুরণ। সে পুজো তাঁর নামে নামাঙ্কিত। বদলাটা গত ১৫ বছরের।

এ নিয়ে গর্বের সীমা নেই শহরের। কেননা এমনটা আর কোথাও হয় না। একরটা শহর মাত্র কয়েকটা দিনের জন্য একটা ওপেন এয়ার আর্ট গ্যালারি হয়ে উঠছে। আর তার দর্শক লক্ষ লক্ষ। এমন কোনও ক্ষেত্রে হয় না যে একটি শিল্প তৈরি হয়নি বা তার জন্ম হয়নি কিন্তু বিক্রি হয়ে গিয়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, আপনি গড়ুন আর এই নিন আপনার পারিশ্রমিক। উত্তর কলকাতার কাঁকুরগাছির এক পুজোয় সুশান্ত পাল তাঁর যে ভাবনার রূপদান করছেন তা হল: ‘জ্যোতির্ময়ী মা’। এই জ্যোতি জ্ঞানের যা আলোর মতো ছড়িয়ে পড়বে নিদির্ষ্ট ভাবে। বিচ্ছুরিত আলো খেলা করবে বৃষ্টির ফোঁটার সঙ্গে আর দূরে আকাশ জুড়ে দেখা দেবে রামধনু। ‘মায়ের আলোর আঁধারে আমরা আলোকিত’, এই তাঁর ভাবনা। সমস্ত প্রাঙ্গণ জুড়ে যে আলো, সে আলোয় থাকবে ঘৃত-প্রদীপের ওম। যা এক আধ্যাত্মিক ভাব প্রকাশ করবে। সঙ্গীত ভাবনায় মল্লার ঘোষ।

তিন প্রথিতযশা শিল্পীকে এক সূত্রে গেঁথেছেন পার্থ দাশগুপ্ত। তার একজন আমেরিকার স্ট্রিট আর্ট শিল্পের প্রথিতযশা শিল্পী ট্রেসি লি স্টাম। অন্য দু’জন দীপ্তীশ ঘোষ দস্তিদার ও শান্তনু মিত্র। ট্রেসি ছবি আঁকেন রাস্তায়। ত্রিমাত্রিক ছবি। বিভ্রম ছড়ায়। নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে দেখলে মনে হবে, মাটি ফুঁড়ে উঠে আসছে কোনও অবয়ব। দীপ্তীশের ছবিও ত্রিমাত্রিক তবে তা ভার্টিকাল। সে ছবি চতুর্থমাত্রা বয়ে আনতে সিলিংয়ে আঁটা হবে। যেন মনে হবে কলকাতা শহর, আপনার চিরপরিচিত মোড়টি যেন সশরীরের আকাশযাত্রী হয়ে উঠেছে। শুধুমাত্র প্রথিতযশা শিল্পীদের নিয়ে বিশালাকার পেন্টিংস দিয়ে সেজে উঠেছে বিবেকানন্দ অ্যাথলিট পার্কের এই স্থাপনাশিল্প। বিরামহীন বয়ে চলেছে কাল। নিরবধি। চলেছে ধ্বংস আর সৃষ্টির খেলা। সময়ের পল অনুপল ঘণ্টা মিনিট পার হতে থাকে। দশভুজা এই মস্তকালের প্রতীক। আহিরীটোলার শারদীয়ার অঙ্গনে সেই কালের খেলায় অংশগ্রহণের জন্য ডাক পাঠিয়েছেন শিল্পী ভবতোষ সুতার। সূর্যের বুকের মধ্যে সময়ের ঘণ্টা বাজাবে একফালি চাঁদ। আমি যে এক সমগ্রের অংশ। সে কথাই শিল্পে স্থাপন করতে চাইছেন।

এ ভাবেই রূপান্তরিত হয়ে চলেছে কলকাতার দুর্গাপুজো। নদীর মতোই তার বাঁকে বাঁকে নতুন জনপদ। নিজেই সে খাত কাটছে, পলি দিয়ে নিজেই বুজিয়ে ফেলছে সেই খাত—আর এক খাত—গতিপথ সৃষ্টির তাগিদে। এক পার ভেঙেই সে আর এক পার গড়ে। গড়ে চর। সেখানে নতুন সম্ভাবনার বীজ বপন হয়। কলকাতার পুজো যে আবারও বাঁক নেবে সে ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

mumbai pujo debasish aich
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE