Advertisement
০৪ মে ২০২৪

প্রশাসনে গতি আনতে বাতিল সব মন্ত্রিগোষ্ঠী

নির্বাচনী প্রচারে মনমোহন সিংহ সরকারের নীতিপঙ্গুত্ব নিয়ে কটাক্ষ করার পাশাপাশিই বারবার বলেছিলেন, সরকারের কাজে গতি আনতে চান। সেই লক্ষ্যে মন্ত্রিসভা গড়ার সময় বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে একই ধরনের একাধিক মন্ত্রককে এক জন মন্ত্রীর আওতায় নিয়ে এসেছেন। এ বারে মন্ত্রীদের হাতে আরও ক্ষমতা দিতে মনমোহন আমলের ৩০টি মন্ত্রিগোষ্ঠীকে খারিজ করে দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সরকারের দাবি, এর ফলে যেমন মন্ত্রীরা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন, তেমনই তাঁদের দায়বদ্ধতাও সুনিশ্চিত হবে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০১ জুন ২০১৪ ০২:৩৫
Share: Save:

নির্বাচনী প্রচারে মনমোহন সিংহ সরকারের নীতিপঙ্গুত্ব নিয়ে কটাক্ষ করার পাশাপাশিই বারবার বলেছিলেন, সরকারের কাজে গতি আনতে চান। সেই লক্ষ্যে মন্ত্রিসভা গড়ার সময় বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে একই ধরনের একাধিক মন্ত্রককে এক জন মন্ত্রীর আওতায় নিয়ে এসেছেন। এ বারে মন্ত্রীদের হাতে আরও ক্ষমতা দিতে মনমোহন আমলের ৩০টি মন্ত্রিগোষ্ঠীকে খারিজ করে দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সরকারের দাবি, এর ফলে যেমন মন্ত্রীরা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন, তেমনই তাঁদের দায়বদ্ধতাও সুনিশ্চিত হবে।

তা হলে এ বারে কী হবে? মন্ত্রিগোষ্ঠীগুলির সামনে এত দিন ধরে যে সব বিষয়গুলি আটকে ছিল, সেগুলি কী হবে? এত দিন ৯টি বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন মন্ত্রিগোষ্ঠী এবং ২১টি মন্ত্রিগোষ্ঠী ছিল। প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় সূত্রে বলা হচ্ছে, এই সব মন্ত্রিগোষ্ঠীর সামনে পড়ে থাকা বিষয়গুলি নিয়ে এ বারে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রক ও দফতরগুলি। যদি তাদের কোনও সমস্যা হয়, তা হলে ক্যাবিনেট সচিবালয় এবং প্রধানমন্ত্রীর দফতর সেগুলির সমাধানে হস্তক্ষেপ করবে। কেন্দ্রীয় আইন ও তথ্য সম্প্রচার মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ বলেন, “সরকারের কাজে গতি আনতে গেলে এটা করতেই হতো। মন্ত্রীরা যদি নিজেরা সিদ্ধান্ত নেন, তা হলে এক দিকে যেমন কাজে গতি আসবে, তেমনই মন্ত্রীদের নিজেদের দায়বদ্ধতাও সুনিশ্চিত হবে। তাঁদেরও তো মানুষের কাছে জবাবদিহি করার কথা মাথায় রাখতে হবে। সমস্যা হলে প্রধানমন্ত্রী হস্তক্ষেপ করবেন।”

সরকার বদল হলে এই সব মন্ত্রিগোষ্ঠী স্বাভাবিক নিয়মেই বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু আজ সেগুলি খারিজের পিছনে অন্য ইঙ্গিত পাচ্ছেন রাজনীতি ও সরকারের সঙ্গে যুক্ত অনেকেই। এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর বক্তব্য, এ বার থেকে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হওয়ার জন্য আর মন্ত্রিগোষ্ঠীকে দায়ী করা যাবে না। ফলে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হবেন মন্ত্রীরা। তাতে কাজে গতি আসবে।

যদিও অনেকে আবার মনে করছেন, এ দেশের যা প্রশাসনিক কাঠামো, তাতে বিভিন্ন মন্ত্রকের মধ্যে বিরোধ অবধারিত। তখন সমস্যা হবেই। কংগ্রেসের তরফেও একই কথা বলা হচ্ছে। দলের নেতা মণীশ তিওয়ারির বক্তব্য, সমস্যার জটিলতার কথা মাথায় রেখেই এই সব মন্ত্রিগোষ্ঠী গড়া হয়েছিল। একই সঙ্গে কংগ্রেসের বক্তব্য, নতুন ব্যবস্থায় সমস্যা মেটাতে বারবার হস্তক্ষেপ করতে হবে প্রধানমন্ত্রীর দফতরকে। কংগ্রেসের এক প্রাক্তন মন্ত্রীর কথায়, “তখন দেখা যাবে, প্রধানমন্ত্রীর দফতরই সুপার-মন্ত্রিগোষ্ঠী হয়ে উঠবে!” বিজেপির তরফে অবশ্য এই ধরনের কোনও সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

মনমোহন সরকারের নীতিপঙ্গুত্ব নিয়ে যখনই অভিযোগের আঙুল উঠেছে, তখনই নিশানায় এসেছে এই সব মন্ত্রিগোষ্ঠী। মনমোহন সিংহের এক দশকে অসংখ্য মন্ত্রিগোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। সার বা গ্যাসের দাম থেকে বিমান পরিবহণ, তেলঙ্গানা রাজ্যভাগ থেকে স্পেকট্রাম বণ্টন যে কোনও বিষয়ে মন্ত্রীদের নিজেদের মধ্যে বা সরকার এবং দলের মধ্যে সামান্যতম বিতর্কের আঁচ পেলেই প্রণব মুখোপাধ্যায়, এ কে অ্যান্টনির মতো প্রবীণদের মাথায় রেখে একটি মন্ত্রিগোষ্ঠী গড়ে দিতেন মনমোহন। কখনও গড়া হতো বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন মন্ত্রিগোষ্ঠীও। গোড়ার দিকে কয়েকটি বৈঠক, আলোচনা। ব্যাস! বেশির ভাগ মন্ত্রিগোষ্ঠীর কাজকর্ম এর বেশি এগোতেই পারত না। ফলে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বস্তুত কোনও সিদ্ধান্তই নিতে পারেনি ইউপিএ সরকার।

এ নিয়ে সরকারের অনেক প্রবীণ মন্ত্রী বারেবারে ক্ষোভ প্রকাশও করেছেন, কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছু হয়নি। মোদীর এ দিনের সিদ্ধান্তের ফলে মন্ত্রীদের সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা দূর হল বলেই মনে করা হচ্ছে।

একাধিক মন্ত্রিগোষ্ঠী গড়ার কাজটা অবশ্য মনমোহনের আগে শুরু করেছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। তাঁর আমলে কখনও সুষমা স্বরাজ-প্রমোদ মহাজন, কখনও অরুণ শৌরি বনাম অরুণ জেটলি বিরোধ বেধেছে বিভিন্ন বিষয়ে।

তখনও সমস্যা সামাল দিতে লালকৃষ্ণ আডবাণীর নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল একাধিক মন্ত্রিগোষ্ঠী। এবং তারাও বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত না নিয়ে দিনের পর দিন ফেলে রাখত। বাজপেয়ীরও আগে নরসিংহ রাও বা দেবগৌড়া-চন্দ্রশেখরদের বিরুদ্ধেও এ ধরনের অভিযোগ কম নয়। বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েই সিদ্ধান্ত না নিয়ে দিনের পর দিন ফেলে রাখার অভিযোগ উঠত সে সময়েও। তখনও মন্ত্রীদের মধ্যে নানা বিষয়ে বিতর্ক বাধত। সে সময় নানা রকম কমিটি গঠন করে তখনকার মতো ধামাচাপা দেওয়া হতো বিরোধ। তাতেও অবশ্য কাজের কাজ কিছু হতো না। কিন্তু গোটা বিষয়টা অন্য মাত্রা পেয়েছিল মনমোহন সিংহের আমলে। তাই সব থেকে বেশি সংখ্যক মন্ত্রিগোষ্ঠীও গড়ে উঠেছিল এই আমলেই।

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদী এই জায়গাটাতেই আঘাত করতে চেয়েছেন। তাঁর সাফ কথা, সরকারে থেকে তখনই কাজ করা যায়, যখন দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় এবং সে ব্যাপারে মন্ত্রীদের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকা উচিত বলেই মনে করেন তিনি। বিজেপি এবং সরকারের সূত্রে আরও বলা হচ্ছে, এতগুলি কমিটি করার কোনও মানেই হয় না। এমনিতেই সচিব পর্যায়ে বিভিন্ন কমিটি থাকে। তারাই বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়। তারা আটকে গেলে তখন মন্ত্রী হস্তক্ষেপ করবেন।

রবিশঙ্কর বলেন, “ডু ইট নাও বললেই হয় না। সেটা করে দেখাতে হয়। আর সেটা করতে গেলে এত রকম জটিলতা রাখলে চলে না। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদী সেটাই করেছেন।”

সরকার এবং বিজেপি সূত্রে অবশ্য বলা হচ্ছে, আজকের সিদ্ধান্তের মানে এই নয় যে, মোদীর সরকার ভবিষ্যতে কোনও মন্ত্রিগোষ্ঠী গড়বে না। তবে, মুড়ি-মুড়কির মতো মন্ত্রিগোষ্ঠী গড়া হবে না। নিতান্ত প্রয়োজন হলে তবেই করা হবে। আপাতত এই বার্তাই দেওয়া হলো, দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকারের কাজে গতি আনো।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

ministerial panel cancel modi panel
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE