Advertisement
১৮ মে ২০২৪

বেলুড়ের প্রসাদী ফুল নিয়েই মোদীর শপথ

পঞ্চদশতম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সোমবার নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী যখন রাষ্ট্রপতি ভবনে শপথবাক্য পাঠ করবেন, তখন তাঁর পকেটে থাকবে বেলুড় মঠ থেকে পাঠানো ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের প্রসাদী ফুল। কয়েক দিন আগেই রামকৃষ্ণ মিশন থেকে স্বামী আত্মস্থানন্দ চিঠি দিয়ে মোদীকে আশীর্বাদ এবং শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। তার পরে শপথ গ্রহণের আগেই বেলুড় মঠ থেকে দিল্লির গুজরাত ভবনে তাঁর হাতে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে এই প্রসাদী ফুল। সঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দের সার্ধশতবর্ষ উপলক্ষে প্রকাশিত বিশেষ মুদ্রা। মুদ্রাটি বেলুড়ে ঠাকুরের চরণ স্পর্শ করিয়ে আশীর্বাদ স্বরূপ পাঠানো হয়েছে।

জয়ন্ত ঘোষাল
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০১৪ ০৩:৪৬
Share: Save:

পঞ্চদশতম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সোমবার নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী যখন রাষ্ট্রপতি ভবনে শপথবাক্য পাঠ করবেন, তখন তাঁর পকেটে থাকবে বেলুড় মঠ থেকে পাঠানো ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের প্রসাদী ফুল।

কয়েক দিন আগেই রামকৃষ্ণ মিশন থেকে স্বামী আত্মস্থানন্দ চিঠি দিয়ে মোদীকে আশীর্বাদ এবং শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। তার পরে শপথ গ্রহণের আগেই বেলুড় মঠ থেকে দিল্লির গুজরাত ভবনে তাঁর হাতে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে এই প্রসাদী ফুল। সঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দের সার্ধশতবর্ষ উপলক্ষে প্রকাশিত বিশেষ মুদ্রা। মুদ্রাটি বেলুড়ে ঠাকুরের চরণ স্পর্শ করিয়ে আশীর্বাদ স্বরূপ পাঠানো হয়েছে। মোদী নিজে বলছেন, “সেই কোন শৈশব থেকে আমি ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের ভক্ত। স্বামী আত্মস্থানন্দ বেলুড় মঠের সংঘগুরু। তাঁর আশীর্বাদ নিয়েই আমি রাষ্ট্রপতি ভবনে যাচ্ছি।”

মোদীকে ফুল পাঠালেও বেলুড় মঠ কিন্তু চিরকালই রাজনীতি থেকে নিজেকে হাজার মাইল দূরে রেখেছে। এমনকী ভগিনী নিবেদিতা স্বাধীনতা আন্দোলনে পরোক্ষ ভাবে যুক্ত হয়েছিলেন বলে সে সময় বেলুড় মঠ নিবেদিতার সঙ্গে দূরত্ব রচনা করে নিয়েছিল। ভরত মহারাজের সঙ্গে ইন্দিরা গাঁধীর সম্পর্ক ছিল সুবিদিত। কিন্তু স্নেহের ‘ইন্দু’র সঙ্গে ভরত মহারাজের মতো প্রবীণ সন্ন্যাসীর সম্পর্ক নিয়েও তৎকালীন কিছু ট্রাস্টি প্রশ্ন তুলেছিলেন। মঠ মহারাজকে পরামর্শ দিয়েছিল, ইন্দিরার সঙ্গে সম্পর্ক থাকলেও তা নিয়ে আতিশয্য পরিহার করা ভাল। এখন বেলুড় মঠের কিছু সন্ন্যাসী মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখেন। তার জন্য কিছু প্রবীণ সন্ন্যাসী কিন্তু কিঞ্চিৎ অস্বস্তিরই শিকার। তাঁদেরই এক জন বলছিলেন, “এটা একটু বাড়াবাড়ি হচ্ছে। খুব শীঘ্রই এঁদের সতর্ক করে দেওয়া হবে।”

নরেন্দ্র মোদীর ক্ষেত্রে কি তা হলে এর ব্যতিক্রম হতে চলেছে?

মঠের এক প্রবীণ সন্ন্যাসীর কথায়, বিষয়টা তা নয়। মোদীকে নিয়ে এই সমস্যাটাই হবে না। কেন? “বেলুড় মঠ যে কোনও দিন বাবা রামদেব বা রবিশঙ্কর হবে না, সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরেই থাকবে, সেটা নরেন্দ্র মোদীর থেকে বেশি কেউ জানেন না।” নির্বাচনী প্রচারের সময় রামদেব বা রবিশঙ্কর মঞ্চে দাঁড়িয়ে মোদীর সমর্থনে সভা করেছেন। রামকৃষ্ণ মিশনের থেকে কিন্তু মোদী সেই সক্রিয় সমর্থনের প্রত্যাশা করেননি। প্রেসিডেন্ট মহারাজের সঙ্গে মোদীর নিজস্ব সম্পর্কের একটা অতীত পটভূমি আছে। সেটা সকলেই জানেন। ওই সন্ন্যাসীর বক্তব্য, “প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অনেক আগে থেকেই মোদীর সঙ্গে বেলুড় মঠের একটা ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল। মোদী জানেন বেলুড় মঠের মতো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্ক কী ভাবে কতটুকু রাখা উচিত।”

বস্তুত রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে মোদীর সম্পর্ক বড় গভীর। কৈশোরে মোদী বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন সন্ন্যাসী হবেন বলে। প্রথমে তিনি চলে যান হিমালয়ে। তিন মাস কোনও খোঁজখবর ছিল না। কেউ জানত না নরেন্দ্র মোদী কোথায়। তিনি তখন গিয়েছিলেন আলমোড়ায় রামকৃষ্ণ মিশনে। তারপর আসেন রাজকোট আশ্রমে। আজকের ‘প্রেসিডেন্ট মহারাজ’ স্বামী আত্মস্থানন্দ ১৯৬৬ সালে রাজকোট মিশনের সচিব ছিলেন। এক সতীর্থ সন্ন্যাসীর মাধ্যমে মোদী আত্মস্থানন্দের কাছে পৌঁছন। বলেন যে তিনি সন্ন্যাসী হতে চান। এর আগে আলমোড়া আশ্রমেও তিনি একই আবেদন করেছিলেন। তাঁরা মোদীকে সন্ন্যাস ধর্মে মন্ত্র দিতে রাজি হননি। স্বামী আত্মস্থানন্দের কাছে মোদী যখন আবার একই অনুরোধ করলেন, তখন তিনি মোদীকে বোঝান বেলুড় মঠে কোনও শাখার সচিব সন্ন্যাস প্রদানের বিষয়ে একতরফা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না।

এর পরে মোদী রাজকোটের আশ্রমেই ব্রহ্মচারীর মতো থাকতে শুরু করেন এবং আশ্রমের কাজকর্মে যুক্ত হয়ে যান। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই স্বামী আত্মস্থানন্দের স্নেহভাজন হয়ে ওঠেন তিনি। স্বামী আত্মস্থানন্দই তাঁকে বেলুড় মঠের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মহারাজ স্বামী মাধবানন্দের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন। কিন্তু স্বামী মাধবানন্দও মোদীকে বলেন, সন্ন্যাস যোগ তাঁর জন্য নয়। রাষ্ট্র গঠন ও সমাজের সংস্কারে তাঁকে কাজ করতে হবে। হিমালয়ের এক সাধুও গুজরাতের গ্রামে এসে মোদীর মা’কে বলেছিলেন, “তোমার ছেলে এক দিন দেশ চালাবে। ওর কুণ্ডলীতে রাজযোগ আছে।”

বেলুড় মঠের সহকারী সম্পাদক স্বামী সুবীরানন্দ এ দিনও বলছিলেন, “মোদী সন্ন্যাসী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর যে রাষ্ট্রের এবং রাজনীতির আরও বড় দায়িত্ব পালন করার ক্ষমতা আছে, সেটা সে দিন মহারাজেরা বুঝতে পেরেছিলেন।” সেই জন্যই তাঁকে সন্ন্যাসে দীক্ষা দেওয়া হয়নি। কিন্তু মোদীর কাছে রামকৃষ্ণ মিশনের একটা আলাদা জায়গা থেকেই গিয়েছে। মিশনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কও রয়ে গিয়েছে। গত বছরই ১০ এপ্রিল বেলুড় মঠে গিয়ে স্বামী আত্মস্থানন্দের সঙ্গে দেখা করেন মোদী। সকালবেলা মঠে গিয়ে ঠাকুরকে প্রণাম করেছিলেন। স্বামী আত্মস্থানন্দের আবাসগৃহে গিয়ে আশীর্বাদ নিয়েছিলেন।

রামকৃষ্ণ মিশন যে তাঁর কাছে কতটা গুরুত্ব পায়, সেটা মোদী নিজে অকুণ্ঠ ভাবে স্বীকার করেন। মোদীর সঙ্গে সর্বক্ষণ থাকেন, এমন এক জন সহকারী সচিব বলছিলেন, মোদী ব্যক্তিগত জীবনে কুসংস্কার মানেন না। জ্যোতিষ নিয়ে অন্য অনেক বিজেপি নেতার মতো বাড়াবাড়িও করেন না। খুব ঘটা করে যজ্ঞ বা পুজো করেন, তা-ও নয়। তবে রোজ সকালে যোগাসন ও ধ্যান করেন। “আর মিশনের বিষয়ে উনি ভীষণ সংবেদনশীল।” মোদীর নিজের কথায়, “আমি মিশনের সন্ন্যাসী হতে গিয়েছিলাম, সে কথা ঠিক। সে সব গল্প করার দিন আজ নয়। তবে মনে মনে ভেবে রেখেছি, রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে আমার দিনগুলোর কথা কিছু লিখে রাখব। ভবিষ্যতে সেগুলো মানুষকে জানানোর ইচ্ছে আছে।”

মঠের কাছেও মোদীর জায়গাটা একেবারে আলাদা। রামকৃষ্ণ মিশন মোদীর রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে মেলাতে চায় না। কোনও রকম দলীয় রাজনীতির ভিতরেই ঢুকতে চায় না। প্রবীণ সন্ন্যাসীরা বলছেন, স্বামীজি দেশ গঠন এবং আর্ত মানুষের সেবায় নিযুক্ত হতে বলেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী যেমন রাজ্যের অভিভাবক, প্রধানমন্ত্রী তেমন দেশের অভিভাবক। কোনও দলের নয়, এখানে তিনি মানুষের প্রধানমন্ত্রী। স্বামী সুবীরানন্দের কথায়, “গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী যাতে মানুষের জন্য কাজ করতে পারেন, তার জন্য রামকৃষ্ণ মিশন নিশ্চয়ই তাঁকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে।” কিন্তু তার মানে এই নয় যে, বেলুড় মঠ রাজনীতি আর আধ্যাত্মিকতাকে মেলাবে। ভবিষ্যতে তৃণমূল ও বিজেপির রাজনৈতিক সংঘাত যদি বাড়ে, এমন নয় যে তার প্রভাব মঠের ভিতর প্রবেশ করবে। মঠের অগ্রাধিকার শুধুমাত্র আধ্যাত্মিকতাই থাকবে।

এমনকী সামাজিক কর্মসূচির উৎসাহও যাতে মঠের আধ্যাত্মিক অগ্রাধিকারকে লঘু করে না দেয়, সেটা খেয়াল রাখেন সন্ন্যাসীরা। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান চালানোর পাশাপাশি আর্ত মানুষের সেবা করাটাও মিশনের ঘোষিত কর্মসূচি। কিন্তু আধ্যাত্মিকতাকে খর্ব না করার জন্যই বারাণসীর অদ্বৈত আশ্রম ও হাসপাতাল এবং মিশনকে দু’টি পৃথক সংস্থা করে রাখা হয়েছে, মেলানো হয়নি। এ বিষয়ে ভগিনী নিবেদিতার ক্ষেত্রে যে নীতি নেওয়া হয়েছিল, বেলুড় মঠ তা থেকে সরেনি। নরেন্দ্র মোদীর ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হবে না বলেই জানাচ্ছেন সন্ন্যাসীরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE