Advertisement
E-Paper

বদলার আবর্তে দুধের ঋণ চোকাবেন ঘরছাড়ারা

আদিগন্ত আখ খেতের মধ্যে ঋজু ও সবুজ পপলার গাছে মোড়া ফ্রেমে যে ছবিটির সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছি, তা বাইরের দুনিয়ায় নিঃসন্দেহে উত্তরপ্রদেশের সব চেয়ে বিতর্কিত এবং নিকৃষ্ট বিজ্ঞাপন। যদিও ভোটবাজারে তা যথেষ্ট কাযর্করী! মুজফ্ফরনগর থেকে বেরিয়ে পানিপথের হাইওয়ে বরাবর গিয়ে সুঁড়িপথে নেমে ১৫ কিলোমিটার দূরে এই মালাখপুরা গ্রাম। গ্রাম নয়, আপাতত হাজার চারেক নিঃসম্বল মানুষের শিবির। যদিও শিবির বলতে যা বোঝায় তার সঙ্গে এই ‘মেক শিফট’ বস্তির সম্পর্ক নেই।

অগ্নি রায়

শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০১৪ ০২:৪৬

আদিগন্ত আখ খেতের মধ্যে ঋজু ও সবুজ পপলার গাছে মোড়া ফ্রেমে যে ছবিটির সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছি, তা বাইরের দুনিয়ায় নিঃসন্দেহে উত্তরপ্রদেশের সব চেয়ে বিতর্কিত এবং নিকৃষ্ট বিজ্ঞাপন। যদিও ভোটবাজারে তা যথেষ্ট কাযর্করী!

মুজফ্ফরনগর থেকে বেরিয়ে পানিপথের হাইওয়ে বরাবর গিয়ে সুঁড়িপথে নেমে ১৫ কিলোমিটার দূরে এই মালাখপুরা গ্রাম। গ্রাম নয়, আপাতত হাজার চারেক নিঃসম্বল মানুষের শিবির। যদিও শিবির বলতে যা বোঝায় তার সঙ্গে এই ‘মেক শিফট’ বস্তির সম্পর্ক নেই। লাঠি, বাঁশ, লগি খাড়া করে পুরনো চট, কাপড়, কম্বল এমনকী ন্যাকড়া পর্যন্ত টাঙিয়ে কোনও ক্রমে আকাশ ঢাকার চেষ্টা। গত অগস্টে মুজফ্ফরনগরে সাম্প্রদায়িক অশান্তির জেরে বিভিন্ন গ্রাম থেকে প্রায় একবস্ত্রে মধ্যরাতে পালিয়ে হাজারো মানুষ এসে জুটেছিলেন এখানে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত এটাই আস্তানা।

কাল এখানে যে নির্বাচন হতে চলেছে সেখানে কিন্তু এঁরা ব্রাত্য নন। বরং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বোড়ে। শুধু এঁরাই নন। অশান্তির জেরে ক্ষতিগ্রস্ত জাঠ, বানিয়া, মুসলিম সমাজের প্রত্যেকটি গ্রামই হয়ে উঠেছে গুরুত্বপূর্ণ। কেন না সম্ভবত এ বার আর জাতপাত নয়, সামনে চলে এসেছে ধর্মের নিরিখে ভোটদানের উন্মাদনা। আর তাই হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়কে ঘিরেই মেরুকরণের চেষ্টা প্রবল। অঙ্গে যথেষ্ট লজ্জাবস্ত্র থাক বা না-থাক, প্রবল শীতে আচ্ছাদনহীনতায় অন্তত ৩৫টি শিশু চোখের সামনে মারা যাক, বা কায়ক্লেশে বেঁচে থাক (এটা শুধু এই শিবিরটিরই পরিসংখ্যান, এমন আরও খান পনেরো শিবির এখনও চালু রয়েছে), মেরুকরণের ভোটযুদ্ধে দুর্গতরাই এ বার তুরুপের তাস। গত মাসে ভোটার কার্ড তৈরির কাজ শেষ হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের বিশেষ প্রতিনিধি দলের উপস্থিতিতে শিবিরেরই একফালি জায়গায় কাল ভোটের সারিতে দাঁড়াবেন পাঁজরসর্বস্ব এই মানুষেরা।

কিন্তু এমন কি ছিল মুজফ্ফরনগর?

ইতিহাস বলছে, না। এখানকার সব চেয়ে বড় দুই সম্প্রদায় জাঠ ও মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন লোক দল নেতা চৌধুরি চরণ সিংহ, যা ৭৯ সালে তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হতে সাহায্য করে। এমনকী ২০০৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনেও বহুজন সমাজ পার্টির নেত্রী মায়াবতী এই দুই সম্প্রদায়কে কিছুটা হলেও এক করতে পেরেছিলেন। কিন্তু গত দু’বছরে সব ভেঙে খানখান। নরেন্দ্র মোদীর ঘনিষ্ঠ নেতা অমিত শাহের গত সপ্তাহের ‘বদলা’র ভাষা তারই একটা সংকেত।

এত মাছি ভনভন করছে যে মুখোমুখি বসে কথা বলাই দুষ্কর। সামনে তাঁবুর খন্ডহর, যার এককোণে ভাঙাচোরা চেহারার মাঝবয়েসী ইরফান। বলেন, “খেলাটা শুরু হয়েছিল এক বছর আগেই।” কাপড়ের ছোট ব্যবসা ছিল খুরগাঁওয়ে। সেই অভিশপ্ত রাতের যুথবদ্ধ আক্রমণ সামলে কী ভাবে খিড়কির দরজা দিয়ে পালিয়ে এসেছিলেন, তা এখনও রহস্য তাঁর কাছে। কিন্তু বাঁচেননি আম্মা, আব্বা আর ভাইজান। বলছেন, “কোনও সাম্প্রদায়িক অসদ্ভাব মুজফ্ফরনগরে ছিল না কোনও দিন। যা ঘটেছে পুরোপুরি রাজনৈতিক মতলববাজি। আজ কেন হুকুম সিংহকে বিজেপি কৈরানা থেকে দাঁড় করিয়েছে? এটা ওর পুরস্কার! অগস্টে অশান্তি লাগানোর কৌশল ছিল ওর তৈরি করা। চোখের সামনে সব দেখেছি।”

আগে মজদুরি করতেন, মার খেয়ে এখন কোমর ভেঙে এখানে পড়ে রয়েছেন মইনুদ্দিন। বললেন, “ফিরব কী ভাবে? আমাদের বংশীকালান গ্রামে যদি ১০ ঘর মুসলমান থাকে, ৭০ ঘর জাঠ। আবার যে উস্কানি আসবে না, কে বলতে পারে? এখানে এক বেলা দুধ তো পাচ্ছি। সঙ্গে ওষুধ-কম্বল।”

হ্যাঁ, গো-বলয়ের এই প্রান্তে দুধের কারবারি মুলায়ম সিংহ যাদব! সাম্প্রদায়িক অশান্তির সময় তিনি চোখ বুজে ছিলেন, মেরুকরণের স্বার্থে হিংসাকে প্রশ্রয় দিয়েছেন এমন অভিযোগ তো বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছেই। কিন্তু দুর্গতদের ‘গ্রাউন্ড জিরো’য় মুলায়ম কিন্তু আবার সেই সংখ্যালঘুর মসিহা অবতারটি ফিরে পেতে চলেছেন। বিজেপি নেতৃত্ব জাঠ, গুজ্জর, বানিয়া, ব্রাহ্মণ, হরিজনকে এক মঞ্চে এনে যতই হিন্দুত্বের পতাকা ওড়াচ্ছেন, সংখ্যালঘুদের একজোট করতে শেষ পর্বে ততটাই সুযোগ পাচ্ছেন মুলায়ম। তিন দিন আগেও তিনি বলে গিয়েছেন, “এখানে আমরা ত্রাণের কাজে ১১৫ কোটি টাকা ঢেলেছি। গুজরাতে কিন্তু তা হয়নি।” এখানকার মুদাস্সর, রেহানা নঈমরাও একবাক্যে জানাচ্ছেন, গত আট মাসে নিয়মিত সাহায্য যদি কোনও রাজনৈতিক দল করে থাকে, তা হলে সেটা সপা-ই। মায়াবতী মুসলিমদের উদ্দেশে বক্তৃতা দিচ্ছেন, কিন্তু দশ মিনিটের জন্যও কোনও শিবিরে আসেননি। রাহুল গাঁধী এসেছিলেন, বসে নাস্তাও করেছেন। কিন্তু প্রতিশ্রুতি ছাড়া কিছুই দিতে পারেননি। বিজেপি বা রাষ্ট্রীয় লোকদল নেতাদের সহায়তার তো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু মুলায়ম গত একমাস ধরে রোজ পরিবার পিছু আধ লিটার দুধের ব্যবস্থা করেছেন, যা এঁদের বেঁচে থাকার প্রধান রসদ।

“ভোটের জন্য কিন্তু ওদের শিবিরকে জিইয়ে রাখা হচ্ছে। বলা হচ্ছে সব একজোট হয়ে ভোট দিলে ভাল টাকা দেওয়া হবে। এখন তো কোনও অশান্তি নেই কোথাও। কেন এরা নিজেদের গ্রামে ফিরছে না?” প্রশ্ন তুললেন কৈরানা কেন্দ্রের বিজেপি নেতা গৌরীশঙ্কর জিন্দাল। তাঁর বক্তব্য, “শেরনগর, সোরাম, কাকেরার মতো গ্রামগুলিতে জাঠদের কত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার খবর কে রাখে? অথচ হিন্দুদের নামে মিথ্যা রিপোর্ট লেখা হচ্ছে। জাঠেরা অপমানিত।”

অশান্তির জেরে জাঠেরাও যে ভুক্তভোগী, সে কথা সত্য। ঘুরে দেখেছি ছবির মত সুন্দর গ্রাম শিশোলিগাঁও, শেরনগর। সাম্প্রদায়িক অশান্তির শিকার জাঠেরা এখানে রয়েছেন। দেখলাম মাস্টারজি নামে পরিচিত সর্বজনশ্রদ্ধেয় এক প্রবীণকে, চোখের সামনে সন্তানকে খুন হতে দেখে যিনি বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু জাঠেরা অনেকটাই গুছিয়ে নিয়েছেন। সবার জমি রয়েছে, আছে গরু-মোষ। সেই সূত্রে রয়েছে নেতা-বাহুবলীদের সঙ্গে আঁতাঁতের রসদও। কোনও জাঠ শরণার্থী শিবির নেই মুজফ্ফরনগর বা আশেপাশে। অথচ ভোটার হিসাবে এঁদের গুরুত্ব এখন তুঙ্গে।

মহিষ-শোভিত প্রকান্ড দালানে বসে ব্যাখ্যা করলেন জাঠ নেতা মহেন্দ্র সিংহ টিকায়েতের বড় ছেলে নরেশ টিকায়েত। বাবার গড়া সংগঠন কৃষক ইউনিয়নের এখনকার অধ্যক্ষ এ বার বিজেপির দিকে ঝুঁকে রয়েছেন। ঘি-এর গন্ধে ম-ম হালুয়া খেতে খেতে বললেন, “সাম্প্রদায়িক অশান্তির ধাক্কায় চোট পেয়েছে হিন্দুদের আত্মসম্মান। তাই এ বারে হিন্দুরা সবাই মোদীর নামে ভোট দেবেন।” মুজাফ্ফরনগরের ৪০০টি জাঠ গ্রামে টিকায়েতের প্রভাব প্রশ্নাতীত। বলছেন, বিজেপির ‘অপমানের বদলা নেওয়ার ডাক’ জাঠ-সহ সব হিন্দুকে একজোট করতে পারছে।

মেরুকরণের এই জটিল রাজনৈতিক আবর্তে উত্তরপ্রদেশের ভোটের ঢাকে কাঠি পড়ছে কাল। সেই উত্তরপ্রদেশ ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যে রাজ্যের ৮০টি আসনকে পাখির চোখ করেছেন নরেন্দ্র মোদী।

agni roy muzaffarnagar homeless
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy