Advertisement
১১ মে ২০২৪
আতঙ্কিত বরাক

বরাক উপত্যকায় খোঁজ মিলল নতুন জঙ্গিদলের

ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক লিবারেশন আর্মি, বরাক ভ্যালি টাইগার ফোর্সের পাশাপাশি বরাক উপত্যকায় একটি নতুন জঙ্গি দলের খোঁজ মিলল। করিমগঞ্জ জেলায় সক্রিয় রয়েছে ওই সংগঠনটি। তবে, সেটির নাম এখনও জানা যায়নি। শুধু জঙ্গিদলের শীর্ষ নেতার পরিচয় জেনেছে পুলিশ। গত সপ্তাহে এক দল সশস্ত্র দুষ্কৃতী চেরাগি বিরজাপুরের ব্যবসায়ী প্রবীর দাসকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়।

শীর্ষেন্দু শী
করিমগঞ্জ শেষ আপডেট: ২৫ মার্চ ২০১৫ ০৩:৪৪
Share: Save:

ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক লিবারেশন আর্মি, বরাক ভ্যালি টাইগার ফোর্সের পাশাপাশি বরাক উপত্যকায় একটি নতুন জঙ্গি দলের খোঁজ মিলল। করিমগঞ্জ জেলায় সক্রিয় রয়েছে ওই সংগঠনটি। তবে, সেটির নাম এখনও জানা যায়নি। শুধু জঙ্গিদলের শীর্ষ নেতার পরিচয় জেনেছে পুলিশ।

গত সপ্তাহে এক দল সশস্ত্র দুষ্কৃতী চেরাগি বিরজাপুরের ব্যবসায়ী প্রবীর দাসকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। তাঁর খোঁজে তল্লাশি শুরুর পরই নতুন জঙ্গি সংগঠনটির বিষয়ে জানতে পারে পুলিশ। করিমগঞ্জ জেলার অতিরিক্ত এসপি নবীন সিংহ জানান, ওই দলের নেতৃত্ব দিচ্ছে রাজেশ চরকি নামে এক যুবক। তাদের হাতে এ কে রাইফেলও রয়েছে। প্রবীরবাবুকে অপহরণের পর ওই রাইফেল থেকে গুলিও ছুঁড়েছিল জঙ্গিরা। নবীনবাবু জানান, এখনও জঙ্গিরা কোনও মুক্তিপণ দাবি করেনি। সম্ভবত ত্রিপুরা বা মিজোরামে লুকিয়ে রাখা হয়েছে প্রবীরবাবুকে। তাঁকে উদ্ধারের জন্য পুলিশি অভিযান চলছে।

অতিরিক্ত এসপি-র কথায়, “ওই দলের সদস্যদের ধরতে পুলিশ তৎপর। অপহৃতকে উদ্ধারের পাশাপাশি জঙ্গি সংগঠনটিকে একেবারে গুঁড়িয়ে দিতে চাই। খুব তাড়াতাড়িই তা করা হবে।”

গোয়েন্দা সূত্রে খবর, ওই দলের জঙ্গিরা এখন বরাকের অন্য জায়গায় ছড়াতে চাইছে না। তারা শুধু করিমগঞ্জ জেলার নিভিয়া, চেরাগি, রংপুরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে চায়। আপাতত অপহরণেই গুরুত্ব দিচ্ছে। সে কারণে প্রবীরবাবুকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।

বরাক উপত্যকার পুরনো জঙ্গি দলগুলি অপহরণের পর মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ দাবি করে। তার পর চলে দর কষাকষি। রাজেশের দলটিও একই কৌশল নিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু এক সপ্তাহেও মুক্তিপণের ফোন না পেয়ে আশঙ্কিত পুলিশ ও প্রবীরবাবুর পরিজনরা। সেই সঙ্গে আরও একটি প্রশ্ন পুলিশকে ভাবিয়ে তুলছে। বরাকে দু’টি জঙ্গিদল সক্রিয় থাকার পরও, কী ভাবে নতুন একটি দলের জন্ম হল?

পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, মিজোরাম থেকে রিয়াংদের উৎখাত করার পর ১৯৯৮ সালে হাইলাকান্দি-করিমগঞ্জে জঙ্গি কার্যকলাপ শুরু হয়। দক্ষিণ রাতাবাড়ির বাসিন্দা মিলন ভট্টাচার্যকে অপহরণ করে বরাক উপত্যকায় জঙ্গিরা প্রথম নিজেদের অস্তিত্বের কথা জানিয়েছিল। সে বারও গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে অপহৃতকে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রবীরবাবুর ক্ষেত্রেও একই ভাবে নিজেদের অস্তিত্ব জানায় নতুন দলটি। সে বার মিলনবাবুকে অপহরণের কয়েক দিনের মধ্যেই রিয়াং জঙ্গিরা উপত্যকার অনেক এলাকায় সন্ত্রাস ছড়ায়। স্থানীয় মানুষের আশঙ্কা, নতুন দলটিও কি একই পথে এগোবে!

মিলনবাবুর পর ওই সময় অপহৃত হন মুকুলমণি নাথ, বাবুল বিশ্বাস, রাজেশ সিংহ। গম্ভীরা চা বাগানের ঠিকাদার রাজেশ সিংহের কাছে ৩০ লক্ষ টাকা দাবি করেছিল জঙ্গিরা। তাঁকে অপহরণের পর এলোপাথাড়ি গুলি চালায় বন্দুকধারীরা। পথে অনেকের কাছ থেকে মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়েছিল তারা। পরে রাজেশ ও তাঁর ভাইয়ের বাড়িতে হানা দিয়েছিল। মূল্যবান অনেক জিনিস লুট করে নিয়ে যায়। একই ভাবে হানা দেওয়া হয় প্রভাত কৈরি, শ্যামা কৈরির বাড়িতে। ব্যাঙ্ককর্মী মনোরঞ্জন দাসকে অপহরণ করা হয়। আতঙ্ক ছড়িয়েছিল রাতাবাড়িতে। অনেকে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যান।

জঙ্গিদের দৌরাত্ম্য রুখতে ২০১১ সালে চরগোলায় সেনাবাহিনীর অস্থায়ী শিবির তৈরি করা হয়। সে বছর ১৯ অগস্ট জওয়ানদের সঙ্গে সংঘর্ষে ৭ জঙ্গির মৃত্যু হয়। কিছু অস্ত্রশস্ত্রও উদ্ধার করা হয়। সেনারা নিয়মিত টহল দেওয়ায় জঙ্গিরা এলাকা বদলে নেয়। রাতাবাড়ি থেকে চলে যায় পাথারকান্দি থানার বাজারিছড়ায়। ওই প্রত্যন্ত এলাকার সঙ্গে যেমন রাতাবাড়ির সীমানা জড়িয়ে, তেমনই তা ত্রিপুরা, মিজোরাম, হাইলাকান্দির কাছাকাছি। মিজোরাম সীমানা লাগোয়া রিয়াং গ্রামগুলি থেকেই নাশকতার কাজকর্ম নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে। জঙ্গিরা এতটাই সাহস পেয়ে গিয়েছিল যে ট্রেন থামিয়ে একের পর এক চালক, জঙ্গল থেকে বনকর্তাকে অপহরণ করা হয়। করিমগঞ্জে দিনেদুপুরে ব্যাঙ্কে হানার ঘটনাও ঘটে।

তবে কি আবার পুরনো দিন ফিরে আসছে? আশঙ্কা লুকোননি পুলিশ সুপার বিষ্ণুপ্রসাদ রাভা। তিনি বলেন, “জঙ্গলঘেরা এলাকায় যাতায়াতের রাস্তা নেই। জঙ্গিরা এমন ভাবে উঁচু টিলার উপর ঘাঁটি তৈরি করে, যাতে পুলিশ গেলে দূর থেকে দেখতে পাওয়া যায়। তাতে সহজেই তারা সেখান থেকে পালায়।” পাশাপাশি, পুলিশকর্মীর অভাবের কথাও উল্লেখ করেন এসপি। তিনি জানান, নিভিয়া-চেরাগি অঞ্চলে দুই কোম্পানি সশস্ত্র বাহিনী রয়েছে। রংপুরে এক সেকশন। জেলার অন্য জায়গায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য পুলিশ মজুত রাখতে হয়। তার উপর জঙ্গিরা অপহৃতকে নিয়ে মিজোরাম বা ত্রিপুরার জঙ্গলে চলে যায়। তখন যৌথ অভিযানের ব্যবস্থা করতে হয়। দু’টি রাজ্যের বিষয় বলে প্রক্রিয়াগত কাজকর্ম সারতেই অনেক সময় লাগে।

তবে, প্রবীর দাসকে জঙ্গি ডেরা থেকে নিরাপদে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আশাবাদী এসপি। তিনি বলেন, “সব রকম ভাবে চেষ্টা চলছে। কয়েক দিনের মধ্যেই তাঁকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। সঙ্গে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে নাম না জানা জঙ্গিদলটিকেও।”

তারই অপেক্ষায় রয়েছে বরাক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE