সহকর্মীর দেহ সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন জওয়ানরা। শনিবার দরভায়। —নিজস্ব চিত্র
ভোট মিটেছে দু’দিন আগে। বস্তার থেকে বাসে করে ফিরছিলেন ভোটকর্মীরা। বিজাপুরের কাছে হঠাৎই বিস্ফোরণ। আর তার পর কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ঝাঁঝরা করে দিল কর্মীদের দেহ। নিহত ৭ জন। আহত বহু।
মুহূর্তের ব্যবধানে পরের হামলা দরভায়। নিশানায় জওয়ানরা। ৫ সেনার সঙ্গে মৃত্যু হয় আরও দু’জনের।
সব মিলিয়ে জোড়া মাওবাদী হামলায় এখন আতঙ্কের পরিবেশ ছত্তীসগঢ়ে। ২০০৯-এর লোকসভা ভোটে ঠিক যেমনটা ঘটেছিল পশ্চিমবঙ্গে। জঙ্গলমহলের ভোট শেষে মাওবাদী অধ্যুষিত দহিজুড়ি থেকে জামবনির পথে জঙ্গি-গুলিতে নিহত হন গাড়ির চালক-সহ ৩ ভোটকর্মী।
গত ১০ এপ্রিল ভোট ছিল বস্তারে। নির্বাচন ঘিরে জঙ্গি হানার আতঙ্ক ছিলই। ভোটের আগের দিন মাওবাদীদের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন তিন কোবরা জওয়ান। কিন্তু ভোটটা মোটামুটি শান্তিতেই মিটেছিল। আজকের ঘটনায় ফের নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। পুলিশের এডিজি আর কে বিজ জানালেন, বাসে ফিরছিলেন কর্মীরা। দুপুর ১১টা নাগাদ গুড়মা পেরিয়ে কেতুলনার গ্রামের কাছে পৌঁছতেই ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণ। আর তার পর ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি। এডিজি-র কথায়, “ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় ছয় কর্মীর। অন্য এক কর্মীর মৃত্যু হয়েছে হাসপাতালে।” বিজাপুরের হাসপাতালে ভর্তি আহতেরা। তবে জঙ্গল থেকে দেহগুলি উদ্ধার করা যায়নি এখনও। পুলিশের এক কর্তা জানালেন, ৭৫ থেকে ১০০ সশস্ত্র জঙ্গি ঘিরে ফেলেছিল বাসটিকে। নিরাপত্তাকর্মীরা যত ক্ষণে পাল্টা গুলি চালাতে শুরু করেন, তত ক্ষণে গভীর জঙ্গলে গা ঢাকা দিয়েছে মাওবাদীরা।
এর পর এক ঘণ্টাও কাটেনি। পুলিশ-প্রশাসন-সিআরপিএফ যখন বিজাপুরের পরিস্থিতি সামলাতে ব্যস্ত, মাওবাদী হানার খবর এল ১০০ কিলোমিটার দূরের দরভা থেকে।
তাড়াতাড়ি জগদলপুরে পৌঁছে যাওয়া যাবে ভেবে প্রায় ফাঁকা অ্যাম্বুল্যান্সে চড়ে বসেন সিআরপিএফ-এর ৮০ নম্বর ব্যাটেলিয়নের ১০ জওয়ান। ভোটকর্মীরা ওই পথে ফিরবেন। তাই দরভার কাছে নিরাপত্তা ব্যবস্থা খতিয়ে দেখতে গিয়েছিলেন তাঁরা। অ্যাম্বুল্যান্স কামানার গ্রামের কাছে আসতেই বিস্ফোরণ। সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যু হয় অ্যাম্বুল্যান্সের চালক-সহ ৫ জওয়ানের। অ্যাম্বুল্যান্সে থাকা এক স্বাস্থ্যকর্মীও জখম হন। হাসপাতালে নিয়ে গেলে মৃত্যু হয় তাঁর।
এই জওয়ানদের নেতৃত্বে ছিলেন ইনস্পেক্টর এম কে রাই। তিনিই হাত নেড়ে অ্যাম্বুল্যান্সটিকে থামিয়ে ছিলেন। ভেবেছিলেন, অ্যাম্বুল্যান্সে থাকলে তাঁদের কেউ চিনতে পারবে না। কিন্তু এক কিলোমিটার যাওয়ার পরই কামানারের কাছে আইইডি বিস্ফোরণ ঘটে। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় ছ’জনের। মারা যান ইনস্পেক্টর রাই-ও।
এ দিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের মুখপাত্র বলেন, “গরিব শিক্ষক ভোটের কাজে গিয়েছিলেন, তাঁদের মেরে ফেলল মাওবাদীরা। এ থেকেই পরিষ্কার, ওরা সন্ত্রাসবাদী। দেশের গণতন্ত্র রক্ষার কাজে গিয়েছিলেন ওই জওয়ানরা। ওঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যাবে না।” প্রায় একই কথা শোনা গেল মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ভি এস সম্পতের মুখেও। তাঁর কথায়, “ছত্তীসগঢ়, ঝাড়খণ্ডের মতো রাজ্যগুলোতে ভোটকর্মীদের সুরক্ষার জন্য সাবধানতা অবলম্বন করা হয়েছিল। তার পরেও এই ঘটনা দুর্ভাগ্যজনক।” নিহতদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দেন তিনি।
পুলিশ-সিআরপিএফ অবশ্য দরভার ঘটনায় কাঠগড়ায় তুলেছে জওয়ানদেরই। প্রশাসনের একাংশের মতে, দরভার মতো মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকায় ‘শর্ট কাট’ পথ ধরতে গিয়েই এই কাণ্ড। সাধারণত মাওবাদী দমন অভিযানে যে সাবধানতা নেওয়া হয়, তা মানেননি জওয়ানরা। দল বেঁধে একটা গাড়িতে ওঠা নিয়মবিরুদ্ধ। এক শীর্ষ কর্তা বললেন, “মাওবাদীরা যা করেছে, তা নিন্দ্যনীয়। কিন্তু দোষ ছিল জওয়ানদেরও। তাড়াতাড়ি পৌঁছতে অ্যাম্বুল্যান্সে চড়া উচিত হয়নি তাঁদেরও।” ছত্তীসগঢ়ে পরবর্তী ভোট ১৭ এপ্রিল। দিনের শেষে মাওবাদী হানা ঘিরে তাই উত্তেজনা তুঙ্গে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy