Advertisement
E-Paper

মনমোহনী দূরত্ব মুছতে নেহরুর পথে মোদী

সাউথ ব্লকের প্রাচীন প্রবাদ, থিম্পুর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বিগড়োনোর জন্য প্রয়োজন প্রবল প্রতিভাসম্পন্ন কোনও শকুনির! সাম্প্রতিক কূটনৈতিক ইতিহাস বলছে, সেই আপাতঅসাধ্য কাজটিই করে দেখিয়েছে মনমোহন সরকার। রাজনৈতিক শিবিরের বক্তব্য, অর্ধশতক আগে যে সম্পর্ককে ‘একই হিমালয়-পরিবারের দুই ভাই’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, তাতে গভীর ক্ষত তৈরি করেছেন তাঁরই উত্তরসূরিরা।

অগ্নি রায়

শেষ আপডেট: ১৮ জুন ২০১৪ ০৩:৫৮
ভুটানের রাজার সঙ্গে মোদী।  ফাইল চিত্র

ভুটানের রাজার সঙ্গে মোদী। ফাইল চিত্র

সাউথ ব্লকের প্রাচীন প্রবাদ, থিম্পুর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বিগড়োনোর জন্য প্রয়োজন প্রবল প্রতিভাসম্পন্ন কোনও শকুনির!

সাম্প্রতিক কূটনৈতিক ইতিহাস বলছে, সেই আপাতঅসাধ্য কাজটিই করে দেখিয়েছে মনমোহন সরকার।

রাজনৈতিক শিবিরের বক্তব্য, অর্ধশতক আগে যে সম্পর্ককে ‘একই হিমালয়-পরিবারের দুই ভাই’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, তাতে গভীর ক্ষত তৈরি করেছেন তাঁরই উত্তরসূরিরা। সেই ক্ষতকে মেরামত করে নতুন করে ভুটানের সঙ্গে সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজটি সারলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর সদ্যসমাপ্ত থিম্পু সফরে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর প্রথম বিদেশ সফরের পর মোদীর বার্তা, ‘প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় না রেখে ভাল থাকা যায় না।’

প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসেই মোদী সার্বিক ভাবে সক্রিয় হয়েছেন প্রতিবেশী কূটনীতি নিয়ে। স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছেন বিদেশনীতিতে তাঁর অগ্রাধিকারের ক্ষেত্র। কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শুধু ভুটানই নয়, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, পাকিস্তানের মতো প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গেও সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রশ্নে গত পাঁচ বছরে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছিল কেন্দ্র।

পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কে কাশ্মীর, অনুপ্রবেশ, সন্ত্রাসের মতো অনেকগুলি কাঁটা রয়েছে। সেই কাঁটা দীর্ঘদিন ধরে জটিল হয়েছে। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে সম্পর্কেও রয়েছে তামিল আবেগের প্রেক্ষাপট। কিন্তু ভুটানের মতো একটি শান্তিপূর্ণ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কটা যে তিক্ততার জায়গায় চলে যাবে, তা কয়েক বছর আগেও অকল্পনীয় ছিল। গত বছর জুন মাসে ভোটের মুখে দাঁড়ানো ভুটানে যে অভূতপূর্ব পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে মনমোহন সরকারের সর্বাত্মক ইন্ধন ছিল বলেই অভিযোগ থিম্পুর। তখন ভুটানের কেরোসিন এবং রান্নার গ্যাস থেকে ভর্তুকি তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নয়াদিল্লি। এর ফলে ভুটানে কার্যত আগুন জ্বললেও একটি বিবৃতিও ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রকের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়নি। পরিণামে প্রথম বারের জন্য সে দেশের রাস্তাঘাটে ভারত বিরোধী মিছিলও দেখা যায়।

আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়েছিল সেই সময়ে ভুটানের অসহায় পরিস্থিতি। সে দেশের দশম যোজনা পরিকল্পনার মেয়াদ শেষ হওয়ার পনেরো দিন পর ছিল নির্বাচন। নতুন সরকারের অধীনেই একাদশ যোজনা হওয়ার কথা। কিন্তু মাঝের এই পনেরো দিনের জন্য কোনও বাজেটই তৈরি ছিল না ভুটানে। সে সময় পাশে দাঁড়ায়নি নয়াদিল্লি। বরং অর্থনৈতিক চাপ তৈরি করেছিল। অথচ এই ভারতই ২০০৮ সালে ভুটানের দশম বাজেট পরিকল্পনা হওয়ার আগেই নীতিগত ভাবে সহায়তার ঘোষণা করে দিয়েছিল।

যে ভুটানের সার্বিক সাহায্যে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জঙ্গি দমনের কাজটি নিয়মিত ভাবে করে থাকে নয়াদিল্লি, সে দেশের সঙ্গে এই ধরনের আচরণ যে খুব বিবেচকের মতো হয়নি তা ঘরোয়া ভাবে স্বীকার করছে সাউথ ব্লক। তবে সাউথ ব্লকের এক কর্তা এ কথাও জানাচ্ছেন যে এর মধ্যে রাজনীতির গন্ধ খোঁজা ভুল হবে। বিষয়টি নেহাতই ‘টেকনিক্যাল’ ছিল। তাঁরা অপেক্ষা করেছিলেন নতুন সরকার আসার জন্য। ভেবেছিলেন তার পরেই একেবারে নতুন করে ভর্তুকি-সহ বিভিন্ন আর্থিক অনুদানের সিদ্ধান্ত নেবেন। বিজেপি-র নেতারা সেই সময় অভিযোগ করেছিলেন শাক দিয়ে মাছ ঢাকার ব্যর্থ চেষ্টা করছে মনমোহন সরকার তথা কংগ্রেস। তৎকালীন বিজেপি মুখপাত্র এবং এখনকার তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর বলেছিলেন, “ভুটান তার নিজের জমিতে ভারত বিরোধী জঙ্গি ঘাঁটিগুলিকে ধংস করার জন্য সব রকমের সাহায্য করেছে। তার সঙ্গে কেন্দ্র যে ব্যবহার করছে তা বিদেশনীতির এক কালো অধ্যায়।”

কূটনৈতিক সূত্রের বক্তব্য, ভুটানের আচরণে ‘অখুশি’ হয়েই এই কাজ করা হয়েছিল। সে সময় বিদেশ মন্ত্রকের নদার্ন ডিভিশনের লেখা একটি গোপন নোট প্রকাশ্যে আসায় স্পষ্ট হয়ে যায় যে ভুটানের আচরণে অখুশি নয়াদিল্লি। সেই নোটে বলা হয়েছিল, ‘ভুটান ভারতের গুরুত্বকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনছে না। তা ছাড়া যে অর্থ দেওয়া হচ্ছে, তা তারা কী ভাবে খরচ করছে তার মধ্যে স্বচ্ছতা নেই।’ পাশাপাশি এই অভিযোগও তৎকালীন ইউপিএ সরকারের কর্তাদের মুখে শোনা গিয়েছিল যে ভুটানের সঙ্গে চিনের ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতায় অস্বস্তি তৈরি হচ্ছে। আর তাই, নিজেদের ‘গুরুত্ব’কেই আবার বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য সম্পর্ক তিক্ত করা কৌশল নিয়েছিল দিল্লি।

অথচ এ বার নরেন্দ্র মোদীর বক্তব্য, চিনের সঙ্গে ভুটানের ঘনিষ্ঠতার মোকাবিলা করতেই, আরও বেশি নিজেদের সঙ্গে থিম্পুকে সংযুক্ত করা উচিত। কেন না, ভুটান শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকেই নয়, ভারতের সীমান্ত নিরাপত্তার প্রশ্নেও গুরুত্বপূর্ণ। বিজেপি শীর্ষ সূত্রের বক্তব্য, গত দশ বছরে মাত্র এক বার ভুটানে গিয়েছেন মনমোহন সিংহ। তাঁর সঙ্গে ভুটান নেতৃত্বের বৈঠক করতে হলে অপেক্ষা করতে হত নিউ ইয়র্কে (রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ অধিবেশন) যাওয়ার জন্য! এ বারের সফরে তাই বিস্তারিত ভাবে দ্বিপাক্ষিক সমস্ত বিষয়কে টেবিলে নিয়ে এসেছেন মোদী। দু’দেশের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি থেকে যৌথ উদ্যোগে হিমালয় গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয় তৈরিসমস্ত ব্যাপারেই ইতিবাচক পদক্ষেপ করা হয়েছে। যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দু’দেশের আশু লক্ষ্য ১০ হাজার মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ উৎপাদন।

রাজনৈতিক শিবিরের বক্তব্য, ‘নেহরুভিয়ান মডেল’কে কাজে লাগিয়েই কংগ্রেসকে কোণঠাসা করার নজির গড়লেন মোদী। কেন না, ভারত-ভুটান সম্পর্কে একটি বড় বদল আসে নেহরুর উদ্যোগে। ১৯৫৮ সালে নেহরু হাতির পিঠে চড়ে এক সপ্তাহ ধরে ভুটানে পৌঁছন। পারোতে তিনি যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তা দু’দেশের সম্পর্কের কাঠামো তৈরি করে দেয়। তখন থেকেই ভারতের সঙ্গে সক্রিয় সহযোগিতার পথে হাঁটা শুরু করে ভুটান। ভুটান থেকে ফিরে সংসদে নেহরু ঘোষণা করেছিলেন, “ভুটানের উপর কোনও আগ্রাসন ভারতের উপর আক্রমণ হিসেবেই গণ্য হবে।”

মোদী তাঁর বিদেশনীতিতে সেই সাবেকি নেহরু যুগের উপযোগিতাই ফিরিয়ে আনলেন কংগ্রেসের নাকের ডগা দিয়ে!

bilateral relationship india bhutan modi
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy