চুপ করে ক্যালেন্ডারের পাতা ওল্টাচ্ছিলেন কাশীনাথ পণ্ডিত। এ বারের মতো শেষ হতে চলেছে যাত্রা। পরের যাত্রার জন্য অপেক্ষা এক বছরের। অমরনাথজির গুহার দরজার চাবি তত দিন থাকবে তাঁরই জিম্মায়।
নামেই দরজা। গুহার মধ্যে এক হাত উঁচু রেলিং, তার মাথায় তারের জাল। সেই রেলিংয়েই রবিবার এক বছরের জন্য তালা ঝোলাবেন আদতে কাশীর বাসিন্দা পণ্ডিতজি অমরনাথ ধামের পুরোহিত। চাবির গোছা উড়নির খুঁটে বাঁধতে বাঁধতে আনমনে বলেন, “উনি তো নিজেই নিজেকে রক্ষা করেন! মনকে সান্ত্বনা দিতে আমরা তালা ঝোলাই।”
সেটা কেমন? বুঝিয়ে দিলেন পণ্ডিতজি এখন তো রাস্তা আর গুহা ঘিরে মোতায়েন কত রকমের বাহিনী। সেনা-পুলিশ। লাখো মানুষের লাখো জোড়া চোখের নজরদারি। কিন্তু ১০ অগস্ট যাত্রা সাঙ্গ হওয়ার পর? কে কোথায় তখন? বরফ পাহাড়ের ঘেরাটোপে একলা পড়ে থাকে এই পূণ্য-গুহা। জনমানব থাকে না ত্রিসীমানায়। তখন সব আগলে রাখে কে, অমরনাথজি ছাড়া? তিনি নিজেই তো তখন নিজের পাহারাদার!
আকাশচুম্বী পাহাড়ের সারি। পাথরের গা চুঁইয়ে নেমে আসতে আসতে জলের ধারা জমে বরফ। পাহাড়ের চুড়োয় বরফ-চাদর। মাঝখানে একফালি সমতলের ধার ঘেঁষে বয়ে চলেছে নদীঅমরাবতী। এই হল পঞ্চতরণী। পাঁচ পাহাড়ের গা বেয়ে পাঁচটি ধারা মিশেছে অমরাবতীতে। সেনা, সিআরপি, বিএসএফ, আইবি আর জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের কড়া নজরদারি অমরনাথ যাত্রার বেস ক্যাম্প এই পঞ্চতরণীতে।
হেলিপ্যাডের পাশে কাঁটাতারের বেড়া। বেড়ার ও ধারে এক ঝাঁক দেহাতি পুরুষ, পরনে জোব্বা, গালে গালপাট্টা। সার দিয়ে রাখা বাঁশ বাঁধা প্লাস্টিক বা হাল্কা স্টিলের চেয়ার ডুলির আধুনিক সংস্করণ। কারও হাত ঘোড়ার লাগামে। ও পার থেকে হাত বাড়িয়ে কে আগে নিজের সচিত্র পরিচয়পত্র যাত্রীর হাতে ধরাবে, চলছে তার লড়াই। যাত্রার বরাত নেওয়ার এটাই দস্তুর এখানে।
লক্ষ লক্ষ মানুষের অমরনাথ দর্শন হয় যাঁদের কাঁধে চড়ে সেই রিয়াজ আহমেদ, তৌসিফ আহমেদ, সুলতান বেগ, আরমান শরিফদের মুখেও ‘জয় অমরনাথ’, ‘ব্যোম শঙ্কর’ ধ্বনি। রিয়াজ বলেন, “অমরনাথজিই আমাদের রুটি-রুজি। তিনি আছেন বলেই এই দেড় মাস উপার্জন হয়। তাই দিয়েই সারা বছর সংসারটা চলে।” প্রায় সাতশো ডুলিওয়ালা আর বারোশো ঘোড়াওয়ালার সংসার চালানোর দায়িত্বও অমরনাথের কাঁধে। অমরনাথ পাহাড়ের আশপাশের পাহাড়ি গ্রামে ছোট ছোট বসতি। আইবি ও সেনা-গোয়েন্দাদের নজরদারি থাকে এই গ্রামগুলোয়। গ্রামবাসীদের কাছে তাই সব সময় সরকারের দেওয়া সচিত্র পরিচয়পত্র থাকা বাধ্যতামূলক। পঞ্চতরণী থেকে খাড়া পাহাড় বেয়ে ওঠার মুখে সিআরপি-র কমান্ড্যান্ট বিজয় সিংহ দেখান, “ওই যে সামনে লে, লাদাখ আর কার্গিল। বাঁ দিকেই এলওসি।” বিজয় জানান, দুর্গম পাহাড়ে সব জায়গায় নজরদারি রাখা সম্ভব নয়। যেটুকু নজরদারি তা এই যাত্রার সময়টুকুই। তার পর? সিআরপি-র গলাতেও পণ্ডিতজির সুর তার পরে আর কী, অমরনাথজিই ভরসা।
ছ’কিলোমিটার উঠলে সঙ্গম। খরস্রোতা সিন্ধু নদ নেমে আসছে হিমবাহের তলা দিয়ে। এখানেই ঘোড়া বা ডুলির যাত্রা শেষ। এর পর একান্ত অথর্ব হলে তবেই ডুলি ভাড়া মিলবে, নইলে হাঁটতে হবে বরফ ভেঙে। সিন্ধুর ধার বরাবর নীল, হলুদ প্লাস্টিকের ছাউনিতে কয়েক’শ লঙ্গরখানা, যাত্রিনিবাস। সোনমার্গ থেকে অমরনাথ যাওয়ার পথে বারারিটপ, টালিমাটা, কোকরনাগের মতো ৩০-৩৫ ঘরের পাহাড়ি গ্রামগুলোয় গুর্জরদের বাস। রোজ সকালে সেখানে রোলকলের মতো বাসিন্দাদের পরিচয় যাচাই শুরু করে বাহিনী। আইবি-র এক কর্তা বলেন, “পাকিস্তানের চর বা জঙ্গিদের আশ্রয় নেওয়ার আদর্শ জায়গা এই ছোট ছোট বসতিগুলো। আফগানিস্তান ও পাকিস্তান থেকেই এই গুর্জররা এখানে এসেছিল। এদের নিত্য যোগাযোগ থাকে ওই দুই দেশে।” এই কারণেই বাড়তি নজরদারি! তবে সে-ও তো এই দেড় মাস, যাত্রার ক’দিনই।
৩৬০টি সিঁড়ি ভেঙে অমরনাথ দর্শন। গুহার সামনে মোতায়েন সিআরপি জওয়ান অমিত মিশ্রের বাড়ি পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটালে। অমরনাথজির বরফের লিঙ্গ এখন পাঁচ ফুটের। গুহার আর এক কোণে বরফ-গৌরী, উচ্চতা সাড়ে তিন ফুট।
বালতালের পথে ঘোড়ায় চেপে নামার সময় ঘোড়ার সহিস আজমল আনসারি গুর্জরি ভাষায় কথা বলছিলেন ডুলিওয়ালা সাদিকের সঙ্গে। কথা শেষে দু’জনেই বলে উঠলেন, ‘জয় অমরনাথজি কী!’ জানতে চাইলাম, কি বলছিলেন? আজমল গম্ভীর মুখে জানান, কড়াকড়ি বাড়ছে। গুহা পর্যন্ত সওয়ারি নিয়ে যাওয়া বন্ধ হয়েছে এ বার থেকে। পাকিস্তান নাকি যাত্রা ভণ্ডুল করার সুযোগ খোঁজে। আর পাকিস্তানে থাকে গুর্জরদের আত্মীয়-স্বজন। তাই রক্ষীদের চোখ রাঙানিতে তাঁদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। আজমলের পাল্টা প্রশ্ন, “কিন্তু আমরা কেন যাত্রা ভণ্ডুল করব বলতে পারেন? যাত্রাই যে আমাদের রুটি জোগায়। অমরনাথজিই যে আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছেন।” সহিস জানালেন, সে জন্যই তাঁরা নাড়া লাগালেন, ‘জয় আমরনাথজি কী!’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy