Advertisement
০২ মে ২০২৪

সুচিত্রা সেনের প্রিয় পদ রাঁধুন

শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়মহানায়িকা সুচিত্রা সেন অত্যন্ত খাদ্য রসিক ছিলেন। বাড়ির খাবার ছাড়াও বিভিন্ন হোটেল রেস্তোরাঁর বিখ্যাত খাবার পছন্দ করতেন। কলকাতার পার্কস্ট্রিটের ‘বারবিকিউ’ রেস্তোরাঁ ছিল সুচিত্রার পছন্দের রেস্তোরাঁগুলির মধ্যে অন্যতম। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে আশির দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সুচিত্রা সেন প্রায়ই ‘বারবিকিউ’-তে আসতেন।

শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

মহানায়িকা সুচিত্রা সেন অত্যন্ত খাদ্য রসিক ছিলেন। বাড়ির খাবার ছাড়াও বিভিন্ন হোটেল রেস্তোরাঁর বিখ্যাত খাবার পছন্দ করতেন। কলকাতার পার্কস্ট্রিটের ‘বারবিকিউ’ রেস্তোরাঁ ছিল সুচিত্রার পছন্দের রেস্তোরাঁগুলির মধ্যে অন্যতম। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে আশির দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সুচিত্রা সেন প্রায়ই ‘বারবিকিউ’-তে আসতেন। ‘বারবিকিউ’ রেস্তোরাঁর ৮২ বছর বয়স্ক বল্লভ ভাই আথা, ষাটোর্ধ্ব ক্যাশিয়ার অশোক কুণ্ডু ও রেস্তোরাঁ স্টিফেন হিউজের ভাণ্ডারে সুচিত্রা সেনের অনেক স্মৃতি রয়েছে। ৮২ বছরের শক্তপোক্ত ম্যানেজার বল্লভবাবু সুচিত্রা সেনের কথা উঠলেই বেশ খানিকটা আবেগ-বিহ্বল হয়ে পড়তেন। বললেন, “ম্যাডাম যখনই বারবিকিউ-তে আসতেন ওঁর দেখভাল আমাকেই করতে হত। ওঁর একটা নির্দিষ্ট টেবিল ছিল সেখানে বসেই উনি খাওয়াদাওয়া করতেন।”

বল্লভবাবু এই প্রতিবেদককে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে সুচিত্রার স্মৃতিবিজরিত সেই টেবিলটা দেখালেন। বল্লভবাবু জানালেন, ‘‘ম্যাডাম ফোনে আমায় বলে দিতেন উনি আসবেন। আমি আগে থেকেই ওঁর প্রিয় টেবিল বুক করে রাখতাম। উত্তমকুমার এলেও আমাকেই দেখভাল করতে হত। তবে যেহেতু সুচিত্রা সেন অসম্ভব রিজার্ভ ছিলেন, কারওর সঙ্গে বেশি কথা বলতেন না, তাই উনি এলেই আমি নজর রাখতাম কোনও ভাবেই কেউ যেন ওঁকে বিরক্ত না-করে। ম্যাডামের যা প্রয়োজন আমাকেই বলতেন, আমি সমস্ত ব্যবস্থা করে দিতাম। আসলে ওঁর মধ্যে এমন একটা ব্যক্তিত্ব ছিল যে ওঁর ধারে কাছে কারওর ঘেঁষার ক্ষমতা ছিল না। তবে সুচিত্রা ম্যাডাম অত্যন্ত ভদ্র ছিলেন আর ওঁর মনও ছিল খুব বড়। উত্তমকুমারের মধ্যেও একই রকম ব্যক্তিত্ব-আভিজাত্য ছিল, তবে ওঁর কাছে কেউ গেলে উনি খুবই ভাল ব্যবহার করতেন, অকাতরে অটোগ্রাফ দিতেন।”

বল্লভবাবু আরও জানালেন যে, সুচিত্রা সেন খুবই আর্লি ডিনারে আসতেন। সন্ধ্যা সাতটা থেকে সাড়ে সাতটার মধ্যে ঢুকে খেয়ে-দেয়ে সাড়ে আটটার মধ্যে চলে যেতেন। কখনওই বেশি রাত করতেন না। সুচিত্রা সেন বারবিকিউ-এর নর্থ ইন্ডিয়ান, মোগলাই ও চাইনিজ— সব ধরনের খাবারই পছন্দ করতেন। তবে তন্দুরি মিক্সড গ্রিল ননভেজ প্ল্যাটার ছিল ওঁর সবচেয়ে প্রিয়। এই ননভেজ তন্দুরি মিক্সড গ্রিল প্ল্যাটারে এক পিস করে তন্দুরি চিকেন, চিকেন মালাই কাবাব, মাটন বড়া কাবাব, ফিশ পিসৌরি কাবাব, তন্দুরি প্রন, মাটন শিক কাবাব, চিকেন হরিয়ালি কাবাব প্রভৃতি পরিবেশিত হত।

গার্লিক নান বা বাটার নান সহযোগে সুচিত্রা সেন এই কাবাবগুলি খেতে পছন্দ করতেন। এ ছাড়া ওঁর বিশেষ পছন্দের পদগুলি ছিল পালক মাশরুম, প্রন বাটার মশালা, মাটন রোগানজুস, চিকেন রেশমি বাটার, মশালা বাটার নান সহযোগে এই পদগুলি উনি খেতে পছন্দ করতেন।

বল্লভবাবু আরও জানালেন যে, সুচিত্রা সেন কখনওই একা আসতেন না, বেশির ভাগ সময়ই মেয়ে মুনমুন, কোনও নিকট আত্মীয় বা বন্ধুবান্ধবরা থাকত। পরবর্তী কালে মেয়ে মুনমুন, তাঁর হাবি, নাতনি রিমা, রাইমাদের নিয়েও এসেছেন। মুনমুন সেন, হাবি, রিয়া, রাইমারা আজও বারবিকিউ-এ নিয়মিত আসেন। তবে শেষ দিকে সুচিত্রা সেন নিজে না-এলেও মুনমুন মাঝেমধ্যেই সুচিত্রার জন্য খাবার প্যাক করে নিয়ে যেতেন। বারবিকিউ-এর ক্যাশিয়ার অশোক কুণ্ডু সত্তরের দশকের প্রথম দিকে চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর যে দিন বারবিকিউ-তে স্বচক্ষে তাঁর স্বপ্নের নায়িকাকে প্রথম দেখলেন, সে দিন ভীষণ চমৎকৃত হয়েছিলেন। গড়পারের অশোকবাবু মাথার টাকে হাত বুলিয়ে সলজ্জ হাসি হেসে বললেন, তখন বয়স কম, সবে চাকরিতে ঢুকেছি, চোখের সামনে আমাদের স্কুল-কলেজ জীবনের হার্ট থ্রব নায়িকাকে বসে খেতে দেখে স্বপ্নের মতো লাগছিল।

পরবর্তী কালে অবশ্য নিয়মিত ভারতের বিখ্যাত বহু নায়ক-নায়িকা, গায়ক-গায়িকা, খেলোয়াড়দের দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। সুচিত্রা সেন-কেও ’৮৪-’৮৫ সাল পর্যন্ত বহু বার এখানে এসে খেতে দেখেছি। তবে অসম্ভব ব্যক্তিত্ব ছিল ওঁর, বল্লভবাবু ছাড়া কারওর সঙ্গে কথা বলতেন না। চুপচাপ খেয়েদেয়ে চলে যেতেন। আমিই বিল পাঠাতাম টেবিলে। এখনও বাংলা ও হিন্দি ছবির বহু বিখ্যাত নায়িকারা এখানে খেতে আসেন তবে সুচিত্রা সেনের সঙ্গে কারওর তুলনা হয় না। উনি ছিলেন অসম্ভব ক্লাসি, ওঁর মতো কাউকে দেখিনি। উত্তম কুমার অবশ্যই ব্যতিক্রম। উত্তম সর্বোত্তম।

বারবিকিউ-এর সহকারী ম্যানেজার স্টিফেন হিউজ আশির দশকের গোড়ার দিকে সুচিত্রা সেনকে বার দুয়েক দেখেছেন এবং সার্ভিস করেছেন। বর্তমানে সুচিত্রাকন্যা মুনমুন, তাঁর বর ‘হাবি’ ও নাতনি রিয়া, রাইমার সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। ওঁরা বারবিকিউতে এলে স্টিফেন ওদের দেখভাল করেন। স্টিফেন বার দুয়েক সুচিত্রা সেনকে চাইনিজ খাবার সার্ভিস করেছেন। তিনি জানালেন, স্যুপের মধ্যে সুচিত্রার প্রিয় ছিল বারবিকিউ স্পেশাল চিমনি স্যুপ, সি-ফুড স্যুপ, স্টার্টারে ফ্রায়েড চিকেন ওয়ানটন, ফিশফিঙ্গার, ফ্রায়েড প্রন বল রেড পিপার চিকেন, ফ্রায়েড চিকেন উইংস, গোল্ডেন ফ্রায়েড প্রন, কনজি ক্রিস্পি ল্যাম্ব প্রভৃতি। মেইন কোর্সে উনি পছন্দ করতেন বারবিকিউ স্পেশাল চাওমিন বা ফ্রায়েড রাইস, ম্যান্ডারিন ফিশ, চিকেন উইথ আমন্ড অ্যান্ড ক্যাশিওনাট, চিলিচিকেন, প্রন ইন হট গার্লিক, সুইট অ্যান্ড সাওয়ার ফিশ প্রভৃতি। বল্লভ ভাই আরও জানালেন, সুচিত্রা সেনের প্রিয় খাবারগুলি আজও বারবিকিউতে পরিবেশিত হয়। সুচিত্রা-প্রেমীরা চাইলে বারবিকিউতে এসে বল্লভবাবু বা স্টিফেন হিউজের সঙ্গে যোগাযোগ করলে ওঁরা সুচিত্রা সেনের প্রিয় মেনুগুলি আপনাদের জানিয়ে দেবেন। চাইলে সেগুলি অর্ডার করতে পারেন। মুম্বই প্রবাসী সুচিত্রাপ্রেমীরা কলকাতায় এলে চলে আসতে পারেন পার্কস্ট্রিটের বারবিকিউ রেস্তোরাঁয়। মহানায়িকার স্মৃতিবিজরিত টেবিলে বসে ওঁর প্রিয় খাবারগুলির স্বাদ গ্রহণ করার দুর্লভ সুযোগ নিতে পারেন। যাঁরা কলকাতায় আসতে পারছেন না, তাঁরা মুম্বইয়ে বসে যাতে সুচিত্রা সেনের প্রিয় খাবারগুলি তৈরি করে প্রিয়জনদের সঙ্গে নিয়ে খেতে পারেন সেই উদ্দেশ্যে বল্লভ ভাই আথা ও স্টিফেন হিউজের সহায়তায় সুচিত্রা সেনের প্রিয় বারবিকিউ রেস্তোরাঁর কিছু পদের রেসিপি জানানো হল।

মুম্বইয়ে বাড়িতেও এই পদ দু’টি রাঁধতে পারেন। খুব সহজ। কলকাতায় এলে তো কথা হবে না।

ছবি: লেখক।

মুর্গ মালাই কাবাব

উপকরণ: বোনলেস চিকেন ব্রেস্ট—২৫০ গ্রাম, বোনলেস চিকেন ব্রেস্ট থেকে ধারালো ছুরির সাহায্যে খণ্ড খণ্ড করে কেটে নিন। চিকেনের খণ্ডগুলো ধুয়ে পরিষ্কার করে ন্যাকরা দিয়ে জল মুছে নিন। গ্রেট করা চিড ৭০ গ্রাম, ডাবল ক্রিম ২০০ গ্রাম, সাদামরিচের গুঁড়ো ১ চা চামচ, আদাবাটা ২৫ গ্রাম, রসুনবাটা ২৫ গ্রাম, এলাচের গুঁড়ো ১০ গ্রাম, নুন আন্দাজ মতো।

প্রণালী: একটি পাত্রে গ্রেট করা চিজ (হাত দিয়ে ঘষে গুঁড়ো করে নিন।) ডাবল ক্রিম, সাদামরিচের গুঁড়ো, আদা, রসুনবাটা, এলাচের গুঁড়ো, নুন ভাল করে মিশিয়ে একটি মিশ্রণ তৈরি করে নিন। এ বার এই মিশ্রণের মধ্যে চিকেনের খণ্ডগুলো দিয়ে মিশ্রণটা ভাল করে খণ্ডগুলোর গায়ে মাখিয়ে নিন।

মিশ্রণ মাখানো চিকেনের খণ্ডগুলো ন্যূনতম ২-৩ ঘণ্টা ফ্রিজে রেখে দিন। ফ্রিজ থেকে বার করে চিকেনের খণ্ডগুলো শিকে গেঁথে নিন। ওভেন ৩৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস উত্তাপে প্রিহিট করে শিক সমেত চিকেনের খণ্ডগুলো ওভেনে ঢুকিয়ে মিনিট দশেক সেঁকে নিন। দশ মিনিট পরে ওভেন থেকে বার করে শিক সমেত চিকেনের খণ্ডগুলো কিছুক্ষণ ঝুলিয়ে রাখুন, যাতে চিকেনের অতিরিক্ত জল ঝরে যায়। জল ঝরে গেলে পরিষ্কার ন্যাকরা বা ব্রাশের সাহায্যে চিকেনের খণ্ডগুলোর গায়ে ১ টেবিল চামচ দেশি ঘি ও মাখন ভাল করে মাখিয়ে নিন।

আবার শিক সমেত ওভেনে ঢুকিয়ে একই উত্তাপে আরও পাঁচ মিনিট সেঁকে নিন। চিকেন ভাল মতো পেকে গেলে ওভেন থেকে বার করে নিন। শিক থেকে চিকেনের খণ্ডগুলো বার করে প্লেটে রাখুন। ১চা চামচ মাখন চিকেনের খণ্ডগুলোর উপর ছড়িয়ে গরম গরম পরিবেশন করুন।

মাটন বড়া কাবাব

উপকরণ: পাঁঠার চাঁপের অংশের হাড় সমেত মাটন ৩৫০ গ্রাম। মাটনের পাঁচটা খণ্ড করে নিন। ধুয়ে পরিষ্কার করে জল মুছে নিন। গ্রেট করা কাঁচা পেপে ২০ গ্রাম। মাটনের খণ্ডগুলোর গায়ে গ্রেট করা কাঁচা পেপে খুব ভাল করে মাখিয়ে নিন।
​টক দই ২০০ গ্রাম, বিট নুন-১৫ গ্রাম, গরমমশলার গুঁড়ো ১৫ গ্রাম, ধনের গুঁড়ো ১০ গ্রাম, জিরের গুঁড়ো ১০ গ্রাম, হলুদ গুড়ো ৭ গ্রাম, কাশ্মীরি লঙ্কার গুঁড়ো ১৫ গ্রাম, সাদা মরিচের গুঁড়ো ৭ গ্রাম, কাজুবাটা ৩৫ গ্রাম, নুন আন্দাজ মতো, রিফাইন্ড ওয়েল ২৫ গ্রাম।

প্রণালী: একটি পাত্রে টক দই, বিট নুন, গরমমশলার গুঁড়ো, ধনে, জিরের গুঁড়ো, হলুদ, কাশ্মীরি লঙ্কার গুঁড়ো, সাদা মরিচের গুঁড়ো, কাজুবাটা, নুন ও রিফাইন্ড ওয়েল নিয়ে খুব ভাল ভাবে মেখে একটি মিশ্রণ তৈরি করুন। এ বার কাঁচা পেপে মাখানো মাটনের খণ্ডগুলো এই মিশ্রণের মধ্যে দিয়ে হাত দিয়ে মাটনের গায়ে ভাল করে মিশ্রণটা মাখিয়ে নিন। মিশ্রণ মাখানো মাটনের খণ্ডগুলো ফ্রিজে ঢুকিয়ে ৩-৪ ঘণ্টা রেখে দিন। ফ্রিজ থেকে বার করে মাটনের খণ্ডগুলো শিকে গেঁথে নিন। ওভেন ৩৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস উত্তাপে প্রিহিট করে শিক সমেত মাটনের খণ্ডগুলো ঢুকিয়ে মিনিট পনেরো সেঁকে নিন। এর পর ওভেন থেকে বার করে শিক সমেত মাটনগুলো কিছুক্ষণ ঝুলিয়ে রাখুন। এ বার পরিষ্কার ন্যাকরা বা ব্রাশের সাহায্যে ২০ গ্রাম দেশি ঘি ও ২০ গ্রাম মাখন মাটনের খণ্ডগুলোর গায়ে মাখিয়ে দিন। আবার শিক সমেত মাটনের খণ্ডগুলো ওভেনে ঢুকিয়ে একই উত্তাপে মিনিট দশেক সেঁকে নিন। মাটন পেকে গেলে ওভেন থেকে বার করে নিন। শিক থেকে মাটনের খণ্ডগুলো খুলে প্লেটে রাখুন। মাটনের খণ্ডগুলোর গায়ে ১ টেবিল চামচ মাখন ও ১ টেবিল চামচ দেশি ঘি মাখিয়ে গরম গরম পরিবেশন করুন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE