Advertisement
E-Paper

স্বাধীন হয়ে বাঁচতে চাইলেও বার্ধক্যজনিত পরাধীনতা

পয়লা অক্টোবর ‘ইন্টারন্যাশনাল সিনিয়র সিটিজেন ডে’। ১৯৯১ সালে এই দিন বয়স্কদের সম্মানে ছুটি পালিত হয়। কেমন আছেন ওঁরা? বৃদ্ধাশ্রম ঘুরে এসে লিখছেন অনির্বাণ জানাবৃদ্ধাশ্রম। ঘরের বাইরে ঘর।  মানুষগুলোর মধ্যে রক্তের কোনও বন্ধন নেই। তবু যেন জন্মান্তরের আত্মীয়তায় বাঁধা পড়ে আছেন সবাই। এখানে আসার গল্প সবার ক্ষেত্রে এক রকম নয়।

অনির্বাণ জানা

শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০১৮ ০২:৪১

অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো/ ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।”— এই শ্লোকটি যেন এখানকার হাওয়ায় ভেসে থাকে। জগতের পরম সত্যির পথ চেয়ে দিন কাটায় অনেক ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে আসা মানুষগুলো। শরীর নামের পোশাকটি খুলে রাখা শুধু সময়ের অপেক্ষা এঁদের কাছে। অভিজ্ঞতার আঁকিবুঁকি মুখে, জীবনের বোঝা বইতে বইতে অনেকের কোমর হয়েছে ন্যুব্জ। যে কোনও দিন কেউ খুঁজতে আসবেন। সব কিছু, এমনকি আজন্ম বয়ে বেড়ানো শরীরটা, তার ভাললাগা, খারাপলাগা, কষ্ট-ব্যথা-বেদনা সব এক নিমেষে ফেলে রেখে বেরিয়ে পড়তে হবে অজানা সফরে।

বৃদ্ধাশ্রম। ঘরের বাইরে ঘর। মানুষগুলোর মধ্যে রক্তের কোনও বন্ধন নেই। তবু যেন জন্মান্তরের আত্মীয়তায় বাঁধা পড়ে আছেন সবাই। এখানে আসার গল্প সবার ক্ষেত্রে এক রকম নয়। কেউ এসেছেন নিজের পেনশনের টাকায় স্বাধীন ভাবে বাঁচবেন বলে, কেউ এসেছেন দেখভাল করার কেউ নেই বলে, কেউ বা নিজেকে নতুন প্রজন্মের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছিলেন না বলে। আবার কেউ সত্যি সত্যি সন্তানদের অবহেলার শিকার হয়ে “আমার ঠিকানা আজ বৃদ্ধাশ্রম”। কেমন আছেন তাঁরা? কেমন ভাবে দিন কাটে তাঁদের? ফেলে আসা জীবনের কথা কতটা মনে পড়ে? বাঙালির সব চেয়ে বড় উৎসব এসে গেল, ওঁরা পুজোয় কী করবেন?

কৃষ্ণনগর শহরের সীমানা ঘেঁষা এক বৃদ্ধাশ্রম। জলঙ্গির কিনারায় একতলা একটা বাড়ি। সাকুল্যে বারো জনের থাকার ব্যবস্থা আছে। এখন রয়েছেন পাঁচ জন। এক জন স্বাধীনতা সংগ্রামীর কন্যা। স্বামী বিয়োগের পর দশ বছর পরিবারের সঙ্গে থেকেছেন। মনে হচ্ছিল, ‘কারও বোঝা হয়ে যাচ্ছি না তো?’ বাবার যোগ্য মেয়ের মতোই সিদ্ধান্ত নেন স্বাধীন ভাবে থাকবেন। আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ এখনও বজায় রয়েছে। মাঝেমধ্যে বাড়ি যান। তবে, ইদানীং আর তেমন করে বাড়ির জন্য উতলা হন না। হেসে ফেলে জানালেন, বরং বেশি দিন বাইরে থাকলে এখানে ফেরার জন্য ভিতরে ভিতরে অস্থির হয়ে পড়েন। চোখ টিপে পাশের বৃদ্ধার দিকে ইশারা করে জানালেন ওঁর জন্য মনখারাপ করে।

আর মনখারাপ করবে নাই-বা কেন? উনি যে একেবারে সহোদরার মতো হাতের কাছে ওষুধগুলো এগিয়ে দেন। একেবারে ঘড়ি ধরে। জীবন কাটিয়েছেন উচ্চপদস্থ সরকারি চাকুরে হিসেবে। বিয়ে-থা করেননি। খুব সুনাম ছিল সময়মতো কাজ শেষ করার ব্যাপারে। অবসর গ্রহণের পর সুযোগ ছিল ভাইপো ভাইঝি নাতিপুতিদের সঙ্গে দিন কাটানোর। কিন্তু ক্ষণিকের সিদ্ধান্তে এখানে চলে আসেন।

ভালই আছেন। সবার ওষুধপাতি খাওয়ার ব্যাপারে পুরো সরকারি নজরদারি বজায় রাখেন। ফেলে আসা দিনের কথা মনে পড়ে। সবারই। তবে ইচ্ছা করেই ভাল স্মৃতি ভাবার জন্য বেছে নেন।

স্মৃতি সততই সুখের, জানেন ওঁরা। খুব অল্পভাষী এক বৃদ্ধ বলছিলেন সে কথা। তাঁর মেয়ে ওঁকে এই বৃদ্ধাশ্রমে রেখে গিয়েছেন। মেয়ে জামাই অনেক দূরে থাকে। ন’মাসে- ছ’মাসে দেখা হলেও ফোনে নিয়মিত যোগাযোগ থাকে বাবা-মেয়ের।

মেয়ের জন্য মন কেমন করে না?— প্রশ্নটা আলগোছে সরিয়ে দিলেন। বললেন, ‘‘ধুর, প্রতি দিনই তো বাপ-বেটিতে হাত ধরাধরি করে হাঁটতে বেরোই।’’ দূরত্ব আর অক্ষমতার শূন্যতাকে কী সুন্দর ভাবে ভদ্রলোক কল্পনা দিয়ে ভরিয়ে নিয়েছেন নিজের মতো করে।

শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে অবশ্য প্রত্যেককেই অল্পবিস্তর টানাপড়েনে থাকতে হয়। নিয়ম করে প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু ওষুধ চলে। এক জন ডাক্তারবাবু মাসে দু’বার করে সবাইকে পরীক্ষা করে যান। তিনি কোনও সপ্তাহে না আসতে পারলে আবাসিকেরা চিন্তিত হয়ে পড়েন। ওঁর আবার নিজেরই শরীর খারাপ হল না তো? ওঁরাই ডাক্তারবাবুকে পরামর্শ দেন, ঠিকঠাক বিশ্রাম যেন নেওয়া হয়। বৃদ্ধাশ্রমের ডাক্তারবাবু ক’দিন আগেই ষাট পেরিয়েছেন।

আশ্রমের সম্পাদিকা আড়ালে ডেকে জানালেন, এখানে ওঁরা দুঃখ-কষ্টের কথা আলোচনা করতে উৎসাহ দেন না। প্রায় প্রতি দিনই সন্ধেবেলায় সবার সঙ্গে গল্প করতে আসেন তিনি। মাঝে-মধ্যে গান করেন। রান্নার দিদির গলা নাকি খুব ভাল। কী গান শোনেন? কীর্তন? এক বয়স্কা হেসে উঠে জানালেন, লতা-সন্ধ্যার গান বেশি হয়।

ডাইনিং হলের মাঝামাঝি রাখা একটা বড় টিভি। আগে নিয়ম করে সিরিয়াল দেখা হত। জীবনকে নাকি বড্ড জটিল করে দেখানো হয় সিরিয়ালগুলোয়। তাই কেউ খুব একটা টিভি দেখেন না এখন। বরং বৃদ্ধাশ্রমের সাত জন কর্মচারী মাঝেমধ্যে টিভি খোলে। তখন আলগা ভাবে খবরে চোখ রাখেন।

পুজোর সময় সপ্তমীর দুপুরবেলায় সবাইকে নিয়ে ঠাকুর দেখতে বেরনো হয়। একটা নির্দিষ্ট পুজোমণ্ডপে অষ্টমীর পুষ্পাঞ্জলিও দেওয়া হয়। বিসর্জন তো একদম বৃদ্ধাশ্রম থেকে দেখা যায়। লাগোয়া ঘাটটি বিসর্জনের জন্য নির্দিষ্ট। বিসর্জনের কথা বলে সবাই যেন একসঙ্গে হঠাৎ করে চুপ করে যান। বৃদ্ধাশ্রমও কি বিসর্জনের এক মন্দির? একটা অস্বাভাবিক নৈঃশব্দ্য অনেক কথা বলতে শুরু করে।

অবশ্য সম্পাদিকা হই হই করে কথা ঘুরিয়ে দেন। এখানে মাঝেমাঝেই বিভিন্ন অনুষ্ঠান করা হয়। যেমন, আজ। ১ অক্টোবর ‘ইন্টারন্যাশনাল সিনিয়র সিটিজেন ডে’ পালন করা হবে। ১ অক্টোবর একটা বিশেষ দিন। ১৯৯১ সালের এই দিন বয়স্ক মানুষদের সম্মানে প্রথম বার ছুটি পালিত হয়েছিল। ১৯৯০ সালে ‘ইউনাইটেড নেশন্‌স জেনেরাল অ্যাসেম্বলি’ ১ অক্টোবরকে ‘ইন্টারন্যাশনাল ডে অব ওল্ডার পার্সনস’ বলে চিহ্নিত করে। এর আগে আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগন ১৯৮৮ সালে ২১ অগস্টকে ‘ইন্টারন্যাশনাল ডে ফর সিনিয়র সিটিজেন’ ঘোষণা করেন। প্রতি বছর ওই দিনটি বয়স্কদের সম্মান ও স্বাধীনতার সঙ্গে বেঁচে থাকার কথা ঘোষণার মাধ্যমে পালিত হয়।

“আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে। তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।”— আশ্রমিকেরা দুঃখ, মৃত্যুর মাঝেই শান্তি, আনন্দ খুঁজে নিতে শিখে গিয়েছেন। ওঁদের জীবন নিজের মতো করে বয়ে চলে। কর্মক্ষমতা হারানোর সঙ্গে সঙ্গে জীবনযাত্রার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা হয়ে পড়ে কঠিন। যতই স্বাধীন ভাবে বাঁচার কথা বলা হোক না কেন, বার্ধক্যজনিত একটা পরাধীনতা তো আসেই। জলঙ্গির তীর ঘেঁষে কাশফুল যখন হালকা হাওয়ায় মাথা দুলিয়ে বলে ‘পুজো আসছে’, তখন এই মানুষগুলোর বুকের ভিতর কোথাও যেন বিসর্জনের বাজনা বাজে। কোথাও যেন আগমনীতেই বাজে বিজয়ার সুর— “ওরে আয়/ আমায় নিয়ে যাবি কেরে/ দিন শেষের শেষ খেয়ায়।”

লেখক শক্তিনগর জেলা হাসপাতালের চিকিৎসক

Senior Citizen International Senior Citizen Day
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy