Advertisement
০৩ মে ২০২৪
Cancer Caregiver Day

ক্যানসার বাসা বাঁধে মনেও, জরুরি কাউন্সেলিং

ক্যানসার কোনও এক জনের লড়াই নয়। একটা গোটা পরিবারের কাছে জীবনের থেকে বড় সত্যি হয়ে ওঠা মৃত্যু। আর তার পর... এক অদ্ভুত শূন্যতা।

representational image

—প্রতীকী ছবি।

সায়ন্তনী ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০২৩ ০৭:৫৫
Share: Save:

বেশ কয়েক বছর আগের কথা। সংবাদপত্রে অসংখ্য খবরের ভিড়ে একফালি জায়গা করে নিয়েছিল ‘আত্মঘাতী যুবক’। নিজের ঘরে গলায় দড়ি দিয়েছিলেন তিনি। জানা যায়, কিছু দিন আগেই ক্যানসার ধরা পড়েছিল তাঁর। ছোটবেলায় খুব কাছের মানুষকে ওই অসুখেই মরতে দেখেছিলেন তিনি। শুধু মৃত্যু তো নয়, মধ্যবিত্ত পরিবারে অনটন দেখেছিলেন। একটু একটু করে আলো নিভে যেতে দেখেছিলেন। সেই অন্ধকারেই ফের ডুব দিতে হবে... এই বাস্তব মেনে নিতে পারেননি। তাই মরণ আসার আগেই নিজে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন।

ক্যানসার কোনও এক জনের লড়াই নয়। একটা গোটা পরিবারের কাছে জীবনের থেকে বড় সত্যি হয়ে ওঠা মৃত্যু। আর তার পর... এক অদ্ভুত শূন্যতা। একুশ বছরের এক তরুণী পড়াশোনা ছেড়ে মায়ের পাশে বসে রয়েছেন। মায়ের ক্যানসার। এক-এক সময়ে তিক্ততা গ্রাস করে। কেন তাঁর এমন অবস্থা। বন্ধুরা কলেজে যাচ্ছে, সিনেমা দেখতে যাচ্ছে, গেট টুগেদার করছে, তিনি যেন বিচ্ছিন্ন দ্বীপ, শুধু হাসপাতাল-রাইলস টিউব, ক্যাথিটার...। ওষুধের ‘দুর্গন্ধ’ যেন তাঁরই সারা শরীর জুড়ে। তার পর কখন যেন নিজের মনের গহীন অতলে ডুবে যান তিনি, ‘‘মা না আমার... আমি এমন ভাবছি।’’ অপরাধ বোধ গ্রাস করে।

এমন অসংখ্য মনে বাসা বাঁধে ‘ক্যানসার’। ক্যানসার-সাইকোলজিস্ট অরুণিমা দত্ত বলেন, ‘‘এ লড়াই অনেক রকম। বাচ্চাদের ক্যানসার হলে মায়েদের লড়াই ভিন্ন। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও চোখের জল লুকিয়ে রাখা, যেন কিছুই হয়নি...। সন্তান যেন টের না পায়।’’ বলছিলেন, ‘‘অজ গাঁ থেকে এক মা কিশোরী মেয়েকে নিয়ে এসেছেন শহরে। গ্রামের সবাই বলেছিল, এত করার কী আছে, সেই তো মরেই যাবে। মা সে সব শুনতে নারাজ। কেমোথেরাপি চলছে। চুল আঁচড়াতেই মেয়ের মাথা থেকে গোছা গোছা চুল উঠছে। পাড়াগাঁয়ের সেই মাকে দেখেছি, চুলগুলো লুকিয়ে রাখতে। মেয়ে যেন দেখতে না পায়।’’

মনোবিদেরা জানাচ্ছেন, এমন ঘটনাও দেখা যায়, অন্তঃসত্ত্বা তরুণী। তাঁর বড় সন্তানটি ক্যানসার নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি। মা হয়েও অসুস্থ সন্তানের কাছে যেতে পারছেন না, কারণ ডাক্তারদের নিষেধ। উল্টো দিকে আর এক পরিবারে, মা-বাবা দু’জনেই অসুস্থ সন্তানের কাছে বসে। কিন্তু তাঁদের হয়তো আরও একটি সন্তান রয়েছে। সে হয়তো বা দাদু-ঠাকুমার কাছে। অনেকে আবার মামা-মাসির কাছেও পাঠিয়ে দেন। এক দিকে মা-বাবার সঙ্গ হারানো একাকিত্ব, অন্য দিকে তার ছোট্ট জীবনে বহু ‘অভাব’। ক্যানসারের চিকিৎসার খরচের ভারে ভাল জামাকাপড় কিনে দেওয়ার ক্ষমতা নেই বাবা-মায়ের। খেলনা নেই। বন্ধুদের মতো জন্মদিনের পার্টি নেই। সারা দিন জুড়ে ‘ভাল লাগে না’ মন, রাগ, জেদ।

কলেজ স্ট্রিট এলাকার বাসিন্দা অর্পিতা বসু মল্লিক বলছিলেন তাঁর মায়ের গল্প। ট্রিপল নেগেটিভ ব্রেস্ট ক্যানসার। স্তন ক্যানসারের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ এটি, কোনও চিকিৎসাই কাজ দেয় না। তিনি জানালেন, অস্ত্রোপচার, কেমোথেরাপি, এ সব বাদ দিয়েও কত বার যে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল মাকে, তার হিসেব নেই। ২০১১ সালে ধরা পড়েছিল ক্যানসার, ২০১৩-য় চলে যাওয়া। অর্পিতা বলেন, ‘‘শেষে মনে হত, এই কষ্ট আর দেখতে পারছি না। চলে যাক এ বার। চামচে করে মুখে খাবার দিয়ে দিলে সেটা যে চিবোতে হবে, তা-ও বুঝত না।’’ শেষ দিন পর্যন্ত মাকে যত্ন করে আগলে রেখেছিলেন অর্পিতা।

অন্য এক ভালবাসার গল্প বলছিলেন ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়। ‘‘একটি খ্রিস্টান মেয়ের প্রেমে পড়েছিলেন এক মুসলিম ছেলে। প্রেমিকার মারণরোগ। শেষের সেই দিন আসন্ন। ছেলে বলল, ওকে বিয়ে করব। বিয়ে করেছিল। মেয়েটি বাঁচেনি...।’’

অরুণিমা বলেন, ‘‘যে কোনও ‘অ-সুখে’ দুঃখ চেপে না রেখে কথা বলাটা জরুরি। অনেক বাবা-মা সন্তানের থেকে লুকিয়ে রাখেন। এটা ঠিক নয়। ‘মায়ের শরীর খারাপ, বিরক্ত কোরো না’, এ কথা না বলে বাচ্চাকে বলুন, মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দাও। তাতে তার শিশু-মন বোঝে, সে আলাদা নয়, সে-ও পরিবারের অংশ। উল্টো দিকে, কোনও রোগীকে হঠাৎ করে ‘তুমি এটা কোরো না, ওটা কোরো না’, এমন না বলে তাঁকে ছোট ছোট কাজের মধ্যে সংসারের সঙ্গে জুড়ে রাখা। এতে তিনি নিজেকে বোঝা মনে করবেন না।’’

ক্যানসার চিকিৎসকদেরও পরামর্শ, কাউন্সেলিং করা জরুরি। রোগীর জন্যেও, রোগীর সেবা যাঁরা করছেন, তাঁদের জন্যেও। এমনই এক ঘটনা— খুব কাশি হয়েছিল। পাড়ার ডাক্তার দেখিয়েছিলেন প্রৌঢ়। এক্স-রে করাতে দেন তিনি। সামান্য সর্দিকাশিই তো, রিপোর্ট নিজে আনতে গিয়েছিলেন রোগী। এক্স-রে প্লেট দেখে নিজেই বুঝে গিয়েছিলেন, ক্যানসার বাসা বেঁধেছে বুকে। তাঁর মেয়ে জানাচ্ছেন, তিনি স্নানে ঢুকলে বাবা বাইরে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকতেন। মুখে শুধু একটাই কথা, ‘‘বাবি, আমার ভয় করছে।’’ বাবাকে হাত ধরে শুধু একটাই কথা বলে যেত মেয়ে, ‘‘আমি আছি। ভয় পেও না।’’ মনোবিদের পরামর্শ নিয়েছিলেন। তাতে অনেকটা উপকার হয়েছিল।

একটা বছর পরে শেষ দিন এগিয়ে এল। হাসপাতালের বিছানায় বাবা। মেয়ে তাঁর হাত ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে। বাবা বললেন, ‘‘কাল আর কথা বলতে পারব না।’’ পরের দিনও হাত ধরে ছিল মেয়ে। বাবার চোখে জল। আর কথা বলা হয়নি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Cancer
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE