Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

নতুন প্রজন্মে কি ক্রমশ বাড়ছে রক্ষণশীলতা

সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের নানা তর্ক-বিতর্কও বারবার এই প্রশ্নকেই উস্কে দিচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, ছোট ছোট বিষয়েও বড় ভাগ হয়ে যাচ্ছে। কখনও তা মাংস তো কখনও বিয়ে, কখনও সন্তান পালন, আবার কখনও নারীর অধিকার।

—প্রতীকী ছবি।

—প্রতীকী ছবি।

সুচন্দ্রা ঘটক
শেষ আপডেট: ৩০ জুলাই ২০১৭ ০০:০৭
Share: Save:

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তরুণ প্রজন্ম কি উদার হচ্ছে, না কি তাদের মধ্যে রক্ষণশীলতা ক্রমশ বাড়ছে? এ নিয়ে বিভিন্ন জমায়েতে প্রশ্ন ওঠে বারবার। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের নানা তর্ক-বিতর্কও বারবার এই প্রশ্নকেই উস্কে দিচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, ছোট ছোট বিষয়েও বড় ভাগ হয়ে যাচ্ছে। কখনও তা মাংস তো কখনও বিয়ে, কখনও সন্তান পালন, আবার কখনও নারীর অধিকার। কখনও গ্রুপের নাম হচ্ছে, ‘আমরা শুধুই মুরগি-মটন’। পাল্টা গ্রুপও তৈরি হচ্ছে ‘মাংসের নামে ভেদাভেদ চলবে না’ অথবা ‘ধর্ম মানি না আমরা’। হোয়াট্‌সঅ্যাপ, মেসেঞ্জারে ঘুরতে থাকছে ক্ষোভ-বিক্ষোভ-চুটকি-ছবি। কখনও আবার তৈরি হচ্ছে ফেসবুক পেজ। সেই পাতায় জায়গা শুধুই নির্দিষ্ট মতামতের। ভিন্ন মত মুখ খুললেই রে রে করে বাক্‌যুদ্ধে নামছেন সদস্যেরা। সহনশীলতার মাত্রা কমছে দিন দিন।

কলকাতা, দিল্লি, মুম্বই-সহ বড় শহরগুলিতে হওয়া সাম্প্রতিক এক বেসরকারি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, বহু ক্ষেত্রেই বাবা-মায়েদের তুলনায় বেশি প্রাচীনপন্থী এখনকার প্রজন্ম। ১৮-৩৪ বছর বয়সীদের মধ্যে পোশাক, খাওয়াদাওয়া থেকে শুরু করে মহিলাদের স্বাধীনতা, বিয়ে এবং ধর্ম ভাবনা— সব ক্ষেত্রেই পুরনো মতাদর্শের প্রভাব বেশি। কয়েক বছর ধরে হওয়া এই সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ধাপে ধাপে প্রতি বছরই বেড়ে চলেছে রক্ষণশীল মানুষের সংখ্যা।

সমীক্ষা বলছে, ধর্ম ভাবনা সবের উপরে। নিজের নিজের ধর্ম নিয়ে সব সময়েই সচেতন ভারতীয়দের একটা বড় অংশ। কিন্তু শহুরে তরুণ সমাজের মধ্যে আগের প্রজন্মের তুলনায় এখন অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে ধর্ম সচেতনতা। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, নিজের নিজের ধর্ম এতটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে যে, তা অন্য মানুষের সঙ্গে আচরণ-সম্পর্কেও ছাপ ফেলছে।

তালিকায় এর পরেই আসছে বিয়ে। দেখা যাচ্ছে, ধর্মের বাইরে তো দূর, অন্য জাতের মানুষের মধ্যে বিয়ের বিষয়েও বিশেষ উদার নন তাঁদের অধিকাংশ। প্রায় ৫৫% তরুণ-তরুণী মনে করেন, সুখে থাকতে নিজের সম্প্রদায়ের মধ্যেই বিয়ে হওয়া জরুরি। আর তাই, মাত্র ১২ শতাংশ নিজের জীবনসঙ্গী খুঁজে নেওয়ার ‘ঝুঁকি’ নিতে আগ্রহী। বাকিরা সে দিক থেকে বাবা-মায়ের উপরে নির্ভর করাই পছন্দ করেন।

নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এঁদের অধিকাংশই মনে করেন, স্ত্রীর অবস্থান স্বামীর নীচে এবং বাড়ির পুরুষ সদস্যদের উচিত, মহিলাদের সাজপোশাকের দিকে কড়া নজর রাখা। যাতে পথ-ঘাটে তাঁরা কোনও সমস্যায় না পড়েন। ১৮ হোক বা ৩৪, নারী-পুরুষের সমান অধিকারের প্রশ্ন তাঁদের অনেকের কাছেই অপ্রাসঙ্গিক। সকলের সামনে সে কথা বলতেও অস্বস্তির কিছু দেখেন না তাঁরা। বরং নিজের নিজের মতামত ফেসবুক, টুইটারে জানানোই দস্তুর বলে মনে করেন তাঁদের অধিকাংশ এবং তাঁরাও তেমনটাই করে থাকেন। একই সমীক্ষায় উঠে এসেছে, এই তরুণদের ৪৪ শতাংশ মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে এবং সমকামিতা অসুখ বলেই দৃঢ় মতামত অনেকের।

তবে এই সব শুনে মোটেও বিস্মিত নন সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অভিজিৎ মিত্র। তিনি বলেন, ‘‘বিশ্বায়নের জমানায় চাকা কিছুটা উল্টো দিকে ঘুরতে শুরু করেছে দুনিয়াভর। মৌলবাদের দাপট বাড়ছে। তার সঙ্গেই তাল মিলিয়ে হয়তো নিজেদের নিরাপদ রাখতে চাইছে তরুণ সমাজ।’’ অভিজিৎবাবুর বক্তব্য, এখন অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দিন দিন কমছে। ফলে স্রোতের বিপরীতে যেতে ভয় পাচ্ছেন অনেকে। আর স্রোত তো তৈরিই করে দিচ্ছে মিডিয়া। সিরিয়াল-সিনেমায় যে মূল্যবোধের কথা দেখায়, তার সঙ্গে তো যথেষ্টই মিল আছে এই রিপোর্টের। তবে তাঁর মন্তব্য, ‘‘প্রশ্নের ধরনের উপরেও নির্ভর করে উত্তর। তাই একটা সমীক্ষার রিপোর্ট দেখেই ধরে নেওয়া যায় না যে, হঠাৎ এতটা রক্ষণশীল হয়ে গিয়েছেন সকলে।’’

সমাজতত্ত্বের শিক্ষক প্রশান্ত রায়ও সে বিষয়ে একমত। তাঁরও বক্তব্য, কয়েকটা সমীক্ষার উপরে ভর করে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছনো একটু কঠিন। তবে সমাজমাধ্যমের যুগে চার পাশে ঘুরতে থাকা বার্তা চোখে পড়েছে তাঁরও। প্রশান্তবাবু বলেন, ‘‘চারপাশটা দেখে হয়তো এখন অনেকেই বুঝে নিচ্ছেন, গতানুগতিক পথে চলাই সুবিধের। অন্য পথ বাছতে গেলে যে নিজের দায়িত্ব আরও বেড়ে যায়।’’

ফলিত মনস্তত্ত্বের শিক্ষক সুব্রতা দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘রক্ষণশীলতা সব সময়েই ছিল, এখনও আছে। শুধু মাঝে একটা সময়ে তা ভদ্রতা করে চাপা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। সবার সামনে নিজের রক্ষণশীল চেহারা দেখানোটা রুচিশীল বলে মনে করা হতো না। এখন সেই তথাকথিত ভদ্রতার প্রলেপটা বুঝি উঠে যাচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE