Advertisement
০৩ মে ২০২৪
Gender Equality

গাহি সাম্যের জয়গান...

লিঙ্গসাম্যের পাঠ শুরু হওয়া উচিত খুদে বয়স থেকে। তবেই শিশু বড় হয়ে লিঙ্গের নিরিখে নয়, মানুষকে শুধুই মানুষ হিসেবে দেখবে।

An image of a family

—প্রতীকী চিত্র।

শ্রেয়া ঠাকুর
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ জুলাই ২০২৩ ০৯:৩০
Share: Save:

এলাটিং, বেলাটিং, সই লো...

আমেরিকার বিখ্যাত সাংবাদিক গ্লোরিয়া মারিয়া স্টাইনেমের কথায়, কন্যাসন্তানকে এখন আমরা অনেক ক্ষেত্রেই ছেলের মতো মানুষ করি। তবে, যত দিন না পুত্রসন্তানকে মেয়ের মতো মানুষ করব, লিঙ্গসাম্যে পৌঁছনো যাবে না।

একটি ঘটনা দিয়ে শুরু করা যাক, এক বাবা-মায়ের দুই সন্তান। মেয়েটি শ্যামলা, ছেলেটি টকটকে ফরসা। ছেলে জন্মানো ইস্তক আত্মীয়স্বজনের মুখে পরিচিত বুলি, ‘আহা, বোনকে একটু রংটা দিতে পারতিস। বড় হলে মাঠে-ঘাটে ঘুরে, চাকরি করে তো এই রং থাকবে না তোর। দিদি তো ঘরেই থাকবে।’ শ্যামবর্ণা বোনের যাতে মন খারাপ না হয় তার জন্য অবশ্য আত্মীয়দের নয়া সংযোজন, ‘দিদির মুখটা সুন্দর।’ অর্থাৎ, কালো সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ। কেউ খেয়ালও করছেন না, দু’টি শিশুর মনে কী ভাবে প্রবেশ করছে লিঙ্গবৈষম্যের বিষ।

এ কথা স্বীকার করতে বাধা নেই যে জন্মের সময় থেকেই অধিকাংশ শিশুর সঙ্গে লিঙ্গ ভেদে ভিন্ন আচরণ শুরু হয়। ছেলে ও মেয়ের জন্য থাকে সাজ-পোশাক, খেলা, কাজ ও আচার-আচরণের আলাদা নিদান। আর একটু বড় হলে এর সঙ্গে যুক্ত হয় বহির্জগতের প্রভাব, অর্থাৎ পড়ার বই, সিনেমা, কার্টুন, বিজ্ঞাপন এবং সমাজমাধ্যম। এতগুলো কারণের সঙ্গে শক্ত হাতে না লড়াই করলে অনেক ক্ষেত্রেই শিশুরা আধিপত্যশীল অথবা আধিপত্য মেনে নেওয়া এক জন মানুষ হিসেবে তৈরি হয়। যেহেতু বাবা-মায়েরা নিজেরাই এই বৈষম্যমূলক পরিবেশে বড় হয়েছেন, ইচ্ছে থাকলেও এই লড়াই হয়ে ওঠে অনেকটাই কঠিন।

‘সাইকল ব্রেকার’ হয়ে ওঠা...

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জয়রঞ্জন রামের মতে, শিশু প্রথম শিক্ষা পায় বাড়ির ভিতর থেকেই, বাবা-মা ও অন্য পরিজনকে দেখে। সুতরাং বাবা-মায়ের আচরণে ও কাজে যদি লিঙ্গ সাম্যের প্রভাব থাকে, শিশু সেটাই শিখবে। অন্তত সে ভাবে ভাবতে চেষ্টা করবে। এর পরেও যদি তার বৈষম্যমূলক আচরণ দেখা যায়, যদি সে বিশ্বাস করতে শুরু করে যে ‘মেয়েদের মতো কাঁদতে নেই’, ‘পুরুষ মানেই বীরপুরুষ’ তা হলে তার সঙ্গে আলোচনা করা দরকার। বাবা-মাকে জানতে হবে, ঠিক কোথা থেকে তার মনে এই ধারণা প্রবেশ করেছে। স্কুল, বাড়ির অন্য পরিজন, বন্ধু-বান্ধব, টিভি, সমাজমাধ্যম প্রভৃতি থেকেই এই ধারণা আসতে পারে। ধীরে ধীরে সে ভুল ভাঙাতে হবে। পাশাপাশি, শিশুকে পাঠ দিতে হবে সহমর্মিতা তথা এমপ্যাথির। নিজের বৃত্তের বাইরের জগতের প্রতি শিশুর আগ্রহ তৈরি করতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন হলে সাহায্য নিতে হবে সাহিত্য ও সিনেমার।

অর্থাৎ, পরিবারে লিঙ্গ সাম্য বজায় রাখতে এবং শিশুকে তার পাঠ দিতে বাবা-মায়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এবং সেটা উভয়তই। শিশু যেন দেখে, মা মানেই রান্না, ঘর গোছানো, ঘরকন্নার সব কাজ করার প্রতিমূর্তি যেমন নয়, তেমনই বাবা মানেই মাসের শেষের সমস্ত বিলের টাকা দেওয়া, সব সময় বাজার করে নিয়ে আসা, রেস্তরাঁয় খেতে গেলে টাকা দেওয়ারও প্রতিমূর্তি নয়। বরং, শিশুকে এটা বোঝানো ভাল যে নিজের নিজের সামর্থ্য অনুসারে বাবা-মা দু’জন মিলে সংসার চালাচ্ছে। সেখানে আলাদা করে কোনও শ্রমবিভাজন নেই, আলাদা কোনও রকম লিঙ্গ-ভিত্তিক তকমা নেই। আর তা ভাল মতো বোঝাতে গেলে প্রথমে নিজেদের মধ্যে থেকে লিঙ্গবৈষম্যের ভূত তাড়াতে হবে। মা ও বাবাকে নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে, মুখে সাম্যের জয়গান গাইলেও সেই একই বৈষম্য চক্রে তাঁরাও ঢুকে পড়ছেন কি না। যদি উত্তর হয় ‘হ্যাঁ’, ভাঙতে হবে সে চক্র। নিজের ইচ্ছে, পারস্পরিক সাহচর্য ও ক্রমাগত আলোচনার মাধ্যমে তা সম্ভব।

এক পা এক পা করে এগিয়ে যাওয়া...

শিশুকে লিঙ্গসাম্যের পাঠ দেওয়ার উপায় বাতলে দিলেন পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষ। তাঁর কথায়,

প্রথমত, শিশুদের, বিশেষ করে ভাই বোনদের ক্ষেত্রে বাড়ির বয়স্ক আত্মীয়রা অনেক সময়েই বলেন, ‘ভাইকে মা বেশি ভালবাসবে।’ এই ধরনের হালকা চালে বলা কথা কিন্তু বৈষম্যের বীজ। বারবার এই ধরনের কথা হলে তার প্রতিবাদ করাটা প্রয়োজন। লিঙ্গ সংক্রান্ত মন্তব্য খণ্ডন করার দায়িত্ব কিন্তু প্রাইমারি কেয়ারগিভার অর্থাৎ বাবা-মায়ের।

দ্বিতীয়ত, ছেলে-মেয়েদের অ্যাকটিভিটি অর্থাৎ খেলা নিয়েও সতর্ক হতে হবে। মেয়ে মানেই পুতুল বা রান্নাবাড়ি নয়, আর ছেলে মানেই ক্রিকেট বা ফুটবল নয়। এই মানসিকতা কিন্তু বৈষম্য থেকেই আসে। বরং ফুটবলের কোচের কাছে মেয়েও শিখুক। ছেলেও জানুক রান্নাবাড়ি মানে মেয়েদের খেলা নয়, বরং সংসারের ছোট্ট প্রতিরূপ।

তৃতীয়ত, শিশুদের স্কুলে যাওয়ার সময় থেকে সচেতন হতে হবে। গণপরিবহনে সন্তানকে স্কুল নিয়ে যাতায়াতের সময়ে অনেক মায়েরাই মেয়েদের নিয়ে পুরুষদের জন্য সংরক্ষিত আসনে বসেন। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ তো দূরস্থান, একটি সেভেন-এইটের ছাত্রও কি অত সহজে মহিলাদের আসনে বসতে পারে? নিজেদের মধ্য থেকে এই বিভাজনের ধারণা আগে দূর করতে হবে। স্কুলে লিঙ্গসাম্য কতটা বজায় থাকে, সে দিকে নজর রাখা জরুরি। এ বিষয়ে আলোকপাত করলেন ন্যাশনাল ইংলিশ স্কুলের ফাউন্ডার প্রিন্সিপাল মৌসুমী সাহা। তাঁর কথায়, “কো-এড স্কুলে যেহেতু এরা ছোট থেকেই একসঙ্গে বড় হয়, তাই সমস্যাটা কম। পাশাপাশি বসেই ছেলেমেয়েরা ক্লাস করে। কিন্তু অনেক সময়ে একটু উঁচু ক্লাসে আমরা অভিভাবকদের কাছ থেকে অনুরোধ পেয়েছি মেয়েদের আলাদা বসানোর জন্য। সে ক্ষেত্রে আমরা দুটো ছেলে, দু’জন মেয়ে এ ভাবে বসানোর চেষ্টা করি। আর স্কুল অ্যাক্টিভিটি, পিটি ওরা সকলে একসঙ্গেই করে। কোনও পৃথকীকরণ করা হয় না।” জিডি গোয়েঙ্কা পাবলিক স্কুল দক্ষিণেশ্বর শাখার প্রিন্সিপাল সুজাতা চট্টোপাধ্যায় আবার বললেন, “আমাদের স্কুলে ছেলে-মেয়ে বলে কোনও বিভেদ নেই। আমাদের স্কুলে মার্শাল আর্ট ছেলে-মেয়ে দু’জনকেই শেখানো হয়। আমাদের স্কুলে মেয়েদের ফুটবল টিমও আছে। আর সত্যি কথা বলতে ওরা ছেলেদের টিমের তুলনায় অনেক ভাল খেলে। এ ছাড়াও ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে কিকবক্সিং, ক্যারাটে শেখানো হয়।”

ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে এমন ধারণাও দেখা যায় যে ‘কোনও কিছু গোছানো মেয়েদের কাজ’, ‘ছেলেরা কাঁদে না, তারা বীর’। এই ধারণার কথা বাড়িতে শুনলে সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করতে হবে, কেন তারা এমন ভাবছে। কোথায় শুনেছে তারা এই কথা। বরং সন্তানকে প্রশ্ন করতে শেখান, শিশুপাঠ্য বইয়ে কেন সব সময় রাজকন্যাকে উদ্ধার করে রাজকুমার? তবে ছেলে-মেয়েকে শেখানোর আগে অবশ্যই বাবা-মাকেও লিঙ্গসাম্য বজায় রাখতে হবে। সন্তান যখন বড় হচ্ছে তখন প্রয়োজন হলে বাবা-মায়ের মধ্যে শ্রম বিভাজন নিয়ে আলোচনা করে নেওয়া ভাল। তা হলে, বাড়িতে লিঙ্গসাম্যের পরিবেশ তৈরি করা আরও সহজ হয়।

প্রায় একই কথা শোনা গেল বছর ৩৫-এর প্রযুক্তিবিদের মুখেও। তিনি জানালেন, সন্তানকে যদি বোঝানো যায় যে ছেলেদের কাজ, মেয়েদের কাজ বলে আলাদা কিছু হয় না, তা হলে বিষয়টি অনেক সহজ হয়। নিজের উদাহরণ দিয়ে তিনি জানান, অনেক সময়েই তাঁর বাবা তাঁকে খাইয়ে দিতেন। স্কুলের জন্য তৈরিও করে দিয়েছেন। তিনি নিজেও এখন এ ভাবেই ভাবেন।

আলো-আঁধারি নয়...

পায়েলের মতে, সন্তান কৈশোরে পৌঁছলে তাকে শারীরবৃত্তীয় ব্যাপার সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দিতে হবে। মেয়েদের ঋতুচক্র যে অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার সেটা বোঝাতে হবে পুত্র ও কন্যাসন্তান দু’জনকেই। পারিবারিক আলোচনায় যখন এই কথা হবে তখন সামনে থাকবেন বাবা, দাদা, ও বাড়ির বড়রা। মেয়েদের ঋতুচক্র যে গোপন কিছু নয়, স্যানিটারি ন্যাপকিন বা ট্যামপন যে লুকোনোর জিনিস নয় বরং আদতে স্বাভাবিক ব্যাপার, এটা বোঝানো জরুরি। তা হলেই ছেলেদের মনে এই বিষয় নিয়ে আলো-আঁধারি কৌতূহল দূর হবে। বরং প্রয়োজন হলে নিজের দিদি, বোন ও সহপাঠিনীদের দিকে তারা বাড়িয়ে দেবে সাহায্যের হাত।

ছেলে ও মেয়ের শারীরিক গঠন, হরমোন আলাদা হবেই, কিন্তু তা যেন লিঙ্গসাম্যের পথে বাধা না হয়ে দাঁড়ায়। নাইজিরিয়ার সাহিত্যিক চিমামান্দা ন্‌গোজ়ি আদিচের কথায়, বায়োলজি একটি আগ্রহ জাগানোর বিষয়। তবে, তার দোহাই দিয়ে লিঙ্গভিত্তিক কোনও সামাজিক নিদান মেনে না নেওয়াই ভাল। সামাজিক নিয়ম তৈরি করে মানুষ, আর এমন কোনও নিয়ম নেই যা পরিবর্তন করা যায় না। লিঙ্গসাম্যের লড়াইয়ে এইটুকুই যা আশার কথা...

মডেল: ঐন্দ্রিলা খান, ভাস্বর চট্টোপাধ্যায়, অনুমেঘা কাহালি, আরুষ দে, ছবি: অমিত দাস, মেকআপ: অভিজিৎ কয়াল, হেয়ার: বিশাল আদক, পোশাক: ভবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়, লোকেশন: সিদ্ধা সবর্বিয়া স্কাইওয়াক, ফুড পার্টনার: চাওম্যান

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

gender equality Children
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE