ঘটা করে উদ্বোধন হয়েছিল হাসপাতালের। এক সময় খড়্গপুরের দেবলপুরে পুরসভার উদ্যোগে গড়ে ওঠা হাসপাতালে রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হত চিকিৎসকদের। প্রথম দিকে হাসপাতালে তিন জন চিকিৎসক থাকলেও পরে তা কমে দাঁড়ায় দু’জনে। তার মধ্যেও এক জন চিকিৎসক নিয়মিত হাসপাতালে আসেন না বলে অভিযোগ। ফলে হাসপাতালের বহির্বিভাগে কমেছে রোগীর সংখ্যা। ফাঁকা অন্তর্বিভাগও। ভোটের আগে হাসপাতালের এই রুগণ্ দশা নিয়ে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক তরজাও।
শহরের নাগরিকদের কাছে চিকিৎসা পরিষেবার পৌঁছে দিতে কেন্দ্রের ‘ইন্ডিয়ান পপুলেশন প্রজেক্ট’ (আইপিপি)-এর আওতায় রাজ্যের ১০টি পুরসভা এলাকায় হাসপাতাল গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এই প্রকল্পের আওতায় বিশ্ব ব্যাঙ্কের আর্থিক সহায়তায় ১৯৯৯ সালে খড়্গপুরের দেবলপুরে গড়ে ওঠে এই হাসপাতাল। দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী নাগরিকদের স্বল্প খরচে চিকিৎসারও বন্দোবস্ত রয়েছে এই (আইপিপি এইট এক্সটেনশন) হাসপাতালে।
এই প্রকল্পের আওতায় শহরের ইন্দা, মালঞ্চ, রাজগ্রাম ও আয়মা এলাকায় একটি করে স্বাস্থ্য কেন্দ্র (হেলথ পোস্ট) খোলা হয়। একইসঙ্গে, খড়্গপুর শহরের ৩০টি ওয়ার্ডে একটি করে উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে তোলা হয়। উল্লেখ্য, সেই সময় রেলশহরে ৩০টি ওয়ার্ড ছিল। ঠিক ছিল, উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রে সপ্তাহে তিন দিন চিকিৎসক বসবেন। আর স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিতে প্রতিদিনই চিকিৎসক থাকবেন। সেখানে কোনও রোগীর সমস্যা নিরাময় সম্ভব না হলে তাঁদের দেবলপুরের হাসপাতালে ‘রেফার’ করা হবে। প্রথম দিকে এই কেন্দ্রগুলিতে রোগীর ভিড় উপচে পত। এখন নিয়মিত চিকিৎসক না বসায় কেন্দ্রগুলিতে পরিষেবা অমিল।
দেবলপুরের হাসপাতালে শহরের সাধারণ নাগরিকদের স্বল্প মূল্যে চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া হয়। দারিদ্র সীমার নীচে বসবাসকারী রোগীরা চিকিৎসার খরচে ৮০ শতাংশ ছাড় পান। এ ক্ষেত্রে, এক জন সাধারণ নাগরিককে হাসপাতালের সাধারণ বেডের জন্য দিন প্রতি ১০০ টাকা ভাড়া দিতে হয়। তবে দারিদ্র সীমার নিচে বসবাসকারী রোগীদের ক্ষেত্রে সাধারণ বেডের দিন প্রতি ভাড়া ২০ টাকা। হাসপাতালের বহির্বিভাগেও নির্দিষ্ট দিনে মেডিসিন, চর্ম, শিশু, শল্য ও স্ত্রী রোগের চিকিৎসার সুবিধা রয়েছে।
উদ্বোধনের সময় হাসপাতালের অন্তর্বিভাগে ১০টি শয্যা ছিল। চিকিৎসক ছিলেন তিন জন। স্থানীয় বাসিন্দাদের কথায়, পাঁচবেড়িয়া, ইন্দা, ভবানীপুর, সুভাষপল্লি-সহ শহরের বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা ভাল চিকিৎসার আশায় আসতেন এই হাসপাতালে। প্রয়োজন বুঝে পরে হাসপাতালে আরও ৩টি শয্যা বাড়ানো হয়। এমনকী বন্ধ্যাত্ব জনিত চিকিৎসার জন্য খোলা হয়েছিল ‘ইনফার্টিলিটি বিভাগ’। সেই সময়ে একাই এই বিভাগ সামলাতেন হাসপাতালের তদানীন্তন স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ বিনোদ এস অগ্রবাল। হাসপাতালে চালু হয়েছিল ‘আল্ট্রাসোনোগ্রাফি’ ও ‘এক্স-রে ক্লিনিক’ও। ছিল ওষুধের দোকানও।
যদিও বহির্বিভাগ চালু থাকলেও এগুলির সবই এখন বন্ধ। স্থানীয় পাঁচবেড়িয়ার বাসিন্দা সাকিনা বিবি, সাবানা বিবিদের কথায়, “চার বছর আগেও এই হাসপাতালের অবস্থা ভাল ছিল। এখন বহির্বিভাগে বসে থাকলেও ঠিক সময়ে চিকিৎসক আসেন না। ওষুধ পাওয়া যায় না। আল্ট্রাসোনোগ্রাফি হয় না। তাই ওখানে যাওয়াই ছেড়ে দিয়েছি।”
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১০ সালে এই হাসপাতাল থেকে স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ বিনোদ এস আগ্রবাল অন্যত্র চলে যান। হাসপাতালের বাকি দু’জন জেনারেল ডিউটি মেডিক্যাল অফিসারের মধ্যে স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ সমীর মুখোপাধ্যায় নিয়মিত আসেন। তবে খড়্গপুরের ছত্তীসপাড়ার বাসিন্দা ওই স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ স্থানীয় নার্সিংহোমে অধিকাংশ সময় কাটান বলে অভিযোগ। অপর চিকিৎসক ডি স্যুইন শারীরিক কারণে মাঝে-মধ্যেই হাসপাতালে আসেন না। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, পরিষেবার হাল দেখে হাসপাতালের অন্তর্বিভাগেও রোগীদের ভর্তি করাতে ভয় পান পরিজনেরা।
ব্যবহার হয় না অপারেশন থিয়েটারও। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।
হাসপাতালের অদূরেই শেখ ইমরান আকতারের বাড়ি। ইমরান বলছিলেন, “বছর খানেক আগে আমার এক বোনের প্রসব যন্ত্রণা ওঠায় রাত ১০টায় বোনকে আইপিপি হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেই সময়ে হাসপাতালের নার্সরা চিকিৎসক আসতে পারবেন না বলে জানান। তারপর বোনকে মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যাই।’’ হাসপাতালের ওটি অ্যাসিস্ট্যান্ট তারা পাল, নার্স মিতা ঘোষেরা বলেন, “এক সময়ে হাসপাতালে প্রসূতিদের জায়গা দেওয়া যেত না। গমগম করত হাসপাতাল। ডাক্তার অগ্রবাল চলে যাওয়ার পর থেকেই পাঁচ বছরে চোখের সামনে হাসপাতালটা শেষ হয়ে গেল।’’ তাঁদের বক্তব্য, ‘‘আমরা বেতনভোগী কর্মী। কিন্তু এ ভাবে রোগী বিহীন হাসপাতালে বসে বেতন নিতে কি আর ভাল লাগে।”
হাসপাতাল নির্মাণের সময় থেকে রেলশহরে পুরবোর্ডের দখল ছিল কংগ্রেসের হাতে। ২০১০ সালে পুরসভায় ক্ষমতায় আসে তৃণমূল। খড়্গপুরের বিদায়ী কংগ্রেস পুরপ্রধান রবিশঙ্কর পাণ্ডে বলেন, “সাড়ে তিন বছরের তৃণমূল পুরবোর্ডের সময়েই আইপিপি হাসপাতালের এই হাল হয়েছে। সেই সময়ে বিনোদ অগ্রবালের মতো চিকিৎসককে কার্যত তাড়িয়ে দেওয়াটাই ভুল ছিল। আমাদের স্বপ্নের প্রকল্প ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছে।”
যদিও এই দাবি মানতে নারাজ তৃণমূল। তাঁদের দাবি, স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ বিনোদ অগ্রবাল অতিরিক্ত সুবিধা নিচ্ছিলেন। কোনও অনুমতি ছাড়াই তিনি ইন্দার স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ভবনে বসবাসের পাশাপাশি বাতানুকুল যন্ত্র বসিয়েছিলেন বলেও অভিযোগ। তাই পুরসভা পদক্ষেপ করেছিল। খড়্গপুরের প্রাক্তন পুরপ্রধান তৃণমূলের জহরলাল পাল বলেন, “বিনোদ অগ্রবালের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠেছিল। তাই তাঁকে চলে যেতে হয়েছে। আমাদের সময়ে হাসপাতাল ভবন তিন তলা করা, ওটি’র যন্ত্রপাতি কেনা-সহ যথেষ্ট উন্নতির চেষ্টা করা হয়েছে।’’ প্রশ্ন উঠছে, তাহলে আইপিপি হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা কমছে কেন? জহরবাবুর দাবি, রাজ্যে তৃণমূলের সরকার আসার পর মহকুমা হাসপাতালের উন্নতি হয়েছে। তাই মানুষ এখন সেখানে যাচ্ছে। তাই আইপিপি হাসপাতালে রোগীর
সংখ্যা কমেছে।’’
যদিও ভোটের আগে দু’পক্ষই আইপিপি হাসপাতালের হাল ফেরানোর প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। আদৌ এই প্রতিশ্রুতি কবে পূরণ হবে, তা অবশ্য সময়ই বলবে।