Advertisement
০৬ মে ২০২৪

ঝকমারি জয় করে দেশান্তরী বাংলার মিষ্টি

বেঙ্গালুরুতে বসে বাঙালি ঝোল-ঝোল সর রাবড়ির জন্য এক রাত্তিরে প্রাণটা হাঁকপাক করছিল কিংশুক মিত্রের। ওয়াট্‌স অ্যাপে কলকাতায় বোনের কাছে একটু হা-হুতাশ করার পরেই ‘চমক’!

ঋজু বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০১৫ ১৫:০৯
Share: Save:

বেঙ্গালুরুতে বসে বাঙালি ঝোল-ঝোল সর রাবড়ির জন্য এক রাত্তিরে প্রাণটা হাঁকপাক করছিল কিংশুক মিত্রের। হোয়াট্‌স অ্যাপে কলকাতায় বোনের কাছে একটু হা-হুতাশ করার পরেই ‘চমক’!

দিন তিনেকের মধ্যে বিকেলে পেল্লায় থার্মোকলের বাক্স তাঁদের আরটি নগরের ঠিকানায় এসে ‘ল্যান্ড’ করল। খুলতেই ইয়া মোটা প্লাস্টিক কনটেনারের মধ্যে ‘সিল’ করে রাখা মহার্ঘ রাবড়ি। তরতাজা, ‘ড্রাই আইসে’ মোড়া। বিমানবন্দরে নিরাপত্তার হাজারো ঝকমারিতে একফোঁটা কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। অনলাইন বরাতের ভিত্তিতে বোন অনায়াসে দাদাকে পাঠিয়ে দিয়েছে, পরম আকাঙ্ক্ষার সে-বস্তু।

কুয়ালা লামপুরে কর্মরত তরুণ ঘোষ অবশ্য বিয়ের পরে কলকাতা থেকে ফেরার সময়ে একটা কঠিন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিলেন। ও-দেশে নিজের রিসেপশনের মেনুতে খাস উত্তর কলকাতার নরমপাক জলভরা নিয়ে যাবেনই যাবেন। বিশেষ ধরনের প্লাস্টিক কনটেনারে গাদাগাদি না-করে শ’চারেক সন্দেশ প্যাক করা হল। উড়ানে বাড়তি ওজনের দাম দিয়ে নতুন বর তা কার্গোয় নিয়ে চললেন। মালয় দেশে পৌঁছে ঠিক এক দিন বাদে ‘বিয়ের রিসেপশন’-এ সন্দেশ দুর্দান্ত হিট।

বাস্তবিক, এমনটা যে ঘটতে পারে, কয়েক বছর আগেও ছিল অবিশ্বাস্য। এই অনলাইন কেনা-বেচা ও মিষ্টির যুগোপযোগী প্যাকিংয়ের দৌলতে কিন্তু অনেক অসম্ভবই সম্ভব হচ্ছে। শুধু যে কলকাতা থেকে ভিন মুলুকে মিষ্টি পাড়ি দিচ্ছে, তা-ই নয়। উল্টোটাও ঘটছে। আমেরিকা থেকে মেয়ে কলকাতার ভবানীপুরের দোকানে যোগাযোগ করে বলছেন, বারাসতে বৃদ্ধ বাবার জন্মদিনে ‘বার্থ ডে মেসেজ’ লেখা সন্দেশের কেক পাঠিয়ে দিতে হবে। কলেজের রিইউনিয়নের জন্য প্রবাসী প্রাক্তনী অনেক দূরে বসেই ঢালাও মিষ্টি পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এ-সব অর্ডারও অনলাইন সারা হচ্ছে।

বাঙালি মিষ্টির এই দেশান্তরী হওয়া অনেকটাই অনিবার্য আজকের গ্লোবাল বাঙালির জীবনে। দেশভাগের আমলের ভিটেছাড়া হওয়ার যন্ত্রণা এ যুগে ঢের ফিকে। তবু মধ্যবিত্ত গেরস্ত পরিবারে ঘর কে ঘর কেউ না কেউ এখন প্রবাসী। হয় বিদেশে নয়তো বেঙ্গালুরু-পুণে-মুম্বই-চেন্নাই-হায়দরাবাদে। তাঁদের স্বপ্নে, সন্দেশ, মিষ্টি দই, বোঁদে বা কলকাতার বিরিয়ানিরও নিত্য আনাগোনা।

কিন্তু বই বা শাড়ির মতো মিষ্টি বা বিরিয়ানি নিয়ে বিমানে যাতায়াত বা দেশে-বিদেশে তা সরবরাহ করাটা মুখের কথা নয়। রসালো চ্যাটচেটে খাবার বিমানে ‘কেবিন লাগেজ’ হিসেবে অনুমোদিত নয়। তাই কলকাতার পুরনো বিমানবন্দরে নিরাপত্তা বেষ্টনীর চৌকাঠ পেরোনর আগে রোজই গাদাগাদা মিষ্টি বাজেয়াপ্ত হতো। মিষ্টির রসে রীতিমতো চটচট করত ওই তল্লাট। এ কালেও বচ্ছরকার ছুটিতে বেঙ্গালুরু-মুম্বইয়ে মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার সময়ে তার মনপসন্দ মিষ্টি সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়াটা প্রবীণ মা-বাবার জন্য মহা ঝকমারি। বিমানবন্দরে নিরাপত্তাকর্মীরা বেঁকে বসায় মিষ্টি উড়োজাহাজে তুলতে ব্যর্থ হয়ে অনেকেরই চোখ ফেটে জল এসেছে। অনলাইন কেনা-বেচার যুগে এই ছবিটা কিছুটা হলেও পাল্টাতে চলেছে। বিরিয়ানির ক্ষেত্রে ততটা না-হলেও দেশের মধ্যে বাঙালি মিষ্টির সরবরাহ অনেকটাই সফল।

মিষ্টিকে সফরের উপযুক্ত করার উপযোগিতা অবশ্য প্রায় আট দশক আগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন বাংলার এক দূরদর্শী মিষ্টি-স্রষ্টা। কৃষ্ণচন্দ্র দাশ তথা কে সি দাশ তখনই পুত্র সারদাচরণকে ডেকে বলেন, রসগোল্লা দেশে-বিদেশে পাঠানোর প্রযুক্তি বার করতে। রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের ছাত্র সারদাচরণ মাথা খাটিয়ে রসগোল্লার টিন বার করেন, যার ভিতরে অন্তত ছ’মাস তাজা থাকবে বাঙালির প্রিয় রসের গোলক। পরে আরও কেউ কেউ রসগোল্লা টিনে ভরেছেন। এবং প্রবাসে কর্মস্থলে ফেরার সময়ে টিন-বন্দি রসগোল্লা বাঙালির ভ্রমণসঙ্গী হয়েছে।

সম্প্রতি কেসি দাশের রসগোল্লা অনলাইন অর্ডারের ভিত্তিতে আমেরিকায় পাঠাতে এগিয়ে এসেছে আমাজন সংস্থা। কিন্তু বাংলার অন্য মিষ্টির বরাতে শিকে ছেঁড়েনি। আমাজনের বিজনেস ডেভলপমেন্ট ম্যানেজার আশিক আলি বলছিলেন, ‘‘আসল সমস্যা হল, বাঙালি মিষ্টির বড্ড সুখী শরীর। মহীশূরপাক, বম্বে হালওয়া, বরফি, লাড্ডু অনেক দিন ভাল থাকে। কিন্তু একমাত্র রসগোল্লা ছাড়া, অন্য বাঙালি মিষ্টি দেশে-বিদেশে পাঠানো কঠিন। এক দিনের বদলে দু’দিন লাগলেই হয়তো মিষ্টি ট’কে গেল!’’

ঠিক এখানেই অসাধ্যসাধনের চেষ্টায় সামিল কয়েকজন একেলে মিষ্টি-স্রষ্টা। প্রথম সারির মিষ্টির দোকান ওয়েবসাইটে অনলাইন অর্ডার নিচ্ছে। কয়েকটি ক্যুরিয়র সংস্থার সঙ্গে গাঁটছড়াও বেঁধেছে। বলরাম মল্লিকের দোকানের কর্ণধার সুদীপ মল্লিকের কথায়, ‘‘এখন মাটির হাঁড়িতে দই পর্যন্ত প্যাকিংয়ের কসরতে পাঠানো সম্ভব হচ্ছে।’’ রিষড়ার ফেলু মোদকও মুম্বই-আমদাবাদে বিয়েতে পর্যন্ত বিপুল রাবড়ি পাঠিয়েছে। কর্ণধার অমিতাভ মোদকের পরিকল্পনা, ‘‘বোঁদে, ছানার মুড়কিতে দু’দিন বাদেও কী ভাবে টাটকা স্বাদ থাকে, তার চেষ্টা করছি।’’ আন্তর্জাতিক ফুড ব্র্যান্ডের ‘নাইট্রোজেন ফ্লাশড প্যাকিং’ বা দুধের তরল মিষ্টি বরফের মতো জমিয়ে পাঠানোর প্রযুক্তি রপ্ত করারও চেষ্টা চলছে।

টিনের রসগোল্লার জনক কেসি দাশের কর্তা ধীমান দাশের দাবি, অন্য মিষ্টির ‘শেল্‌ফ-লাইফ’ বাড়িয়ে প্যাকিংয়ের কিছু নতুন কৌশল নিয়ে বেঙ্গালুরুতে তাঁদের ল্যাবরেটরিতে নিরীক্ষা চলছে। নকুড়-কর্তা পার্থ নন্দীও বলছিলেন, মিষ্টি সরবরাহ করার নিজস্ব পরিকাঠামো তাঁরা ক্রমশ গড়ে তুলছেন। বিমানবন্দরে ইতিমধ্যেই ‘বিশ্ব বাংলা’-ব্র্যান্ডের ছায়ায় ‘ডিউটি ফ্রি’ মিষ্টির দোকান হয়েছে বাঞ্ছারামের। সে-সব মিষ্টি বিমানে নিয়ে যাওয়া যায়। কর্তা শুভজিত ঘোষ অনলাইন অর্ডারের মাধ্যমেও দেশি-বিদেশি বাজার ধরতে চাইছেন।

দেশ-বিদেশের বাঙালিদের চেনা বেশ কয়েকটা অনলাইন পোর্টালের কর্তারাও মানছেন, শুধু পুজো-ভাইফোঁটা নয়! কলকাতা বা বাংলার মিষ্টির খোঁজখবর প্রবাসী বাঙালিরা বছরভরই করে থাকেন। নারকোল নাড়ু থেকে ক্ষীরকদম, জয়নগরের মোয়া থেকে মরশুমি নলেন গুড়— চাহিদার শীর্ষে। বাংলা লাইভ ডটকম বা ৩৬৫ অরেঞ্জেস সংস্থা-র মতো কেউ কেউ ভিন রাজ্যে মিষ্টি পাঠায়, বিশেষ অর্ডারের ভিত্তিতে। তবে অনলাইনে এখনও ততটা সুলভ নয় বাঙালির প্রিয় কলকাত্তাইয়া বিরিয়ানি। সিরাজ-কর্তা ইশতিয়াক আহমেদের কথায়, ‘‘বিরিয়ানি ঠান্ডা করে থার্মোকল প্যাকিংয়ের কসরতে অনেক দূর পাঠানো যেতে পারে। অনেকেই নিয়ে যান। তবে অনলাইন বিক্রি এখনও চালু করা হয়নি।’’

সমস্যা আরও আছে। মোবাইলে অ্যাপ্‌স মারফত মিষ্টি বা রেস্তোরাঁর খানা কলকাতায় বাড়িতে হাজির হচ্ছে। অনলাইনে কলকাতা থেকে দেশের বড় শহরগুলোতেও মিষ্টি দিব্যি পাড়ি দিচ্ছে। কিন্তু বাংলার ভিতরে জেলায় পাঠানো এখনও কঠিন। মিষ্টি-কারবারিদের বক্তব্য, ক্যুরিয়র সংস্থাগুলো ওই তল্লাটে যেতে সময় নেয়। ততদিন মিষ্টি খাঁটি থাকার গ্যারান্টি কে দেবে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

online sweet dispatch life style
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE