Advertisement
০৩ মে ২০২৪

সংরক্ষণে গলদ, ক্ষমতা খুইয়ে অকেজো ওষুধ

অমৃতই বিষ কি না, সংশয়-পীড়িত প্রশ্ন তুলেছিলেন কবি। নিছক সংরক্ষণের গাফিলতিতে রোগ নিরাময়ের ওষুধও যে কখনও কখনও বিষবৎ হয়ে ওঠে, বাংলার স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে তার প্রমাণ মিলছে হামেশাই। এবং তার মাসুল গুনতে হচ্ছে সাধারণ রোগীদের।

সোমা মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ মে ২০১৫ ০৩:১৫
Share: Save:

অমৃতই বিষ কি না, সংশয়-পীড়িত প্রশ্ন তুলেছিলেন কবি।

নিছক সংরক্ষণের গাফিলতিতে রোগ নিরাময়ের ওষুধও যে কখনও কখনও বিষবৎ হয়ে ওঠে, বাংলার স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে তার প্রমাণ মিলছে হামেশাই। এবং তার মাসুল গুনতে হচ্ছে সাধারণ রোগীদের।

সরকারি হাসপাতালে সরবরাহ করা ওষুধের মান নিয়ে আগে নানা অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু মান তো অনেক পরের কথা। দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন হাসপাতালে যে-ভাবে ওষুধ রাখা হয়, সেই প্রক্রিয়াতেই নানা গোলমাল রয়েছে। কোন ওষুধ কত তাপমাত্রায় কী ভাবে রাখতে হবে, সেটুকু নিয়ম মেনে চলারও তোয়াক্কা করা হচ্ছে না বহু ক্ষেত্রে। সেই উদাসীনতা আর অবহেলায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ওষুধের দ্রব্যগুণ। কখনও তা ফেলে দেওয়া হচ্ছে। সেটা তবু মন্দের ভাল। কারণ, ওই সব ক্ষেত্রে তবু টাকার উপর দিয়ে ব্যাপারটা মিটে যায়। কিন্তু বিপজ্জনক ব্যাপার হল, কখনও কখনও সেই নষ্ট হয়ে যাওয়া ওষুধই নির্বিচারে খাইয়ে দেওয়া হচ্ছে রোগীদের। অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে দেখা দিচ্ছে নানা বিপত্তি। প্রতিষেধক টিকার ক্ষেত্রেও একই অভিযোগ।

শুধু জেলা বা মহকুমা হাসপাতাল নয়, শহর কলকাতারও বহু সরকারি হাসপাতালে যে ‘কোল্ড চেন’ ঠিকমতো কাজ করে না, তা মেনে নিয়েছেন স্বাস্থ্যকর্তাদের একাংশ। ‘কোল্ড চেন’ মানে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় ওষুধ সংরক্ষণ, যাতে তা নষ্ট না-হয় এবং তার কার্যকারিতা ঠিক থাকে।

কিছু দিন আগেই রাজ্যের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে পরপর প্রসূতি-মৃত্যু নিয়ে তোলপাড় হয়েছিল। তার তদন্তে গড়া কমিটির রিপোর্টে প্রসূতিদের মৃত্যুর কারণ হিসেবে বেশ কিছু কারণের কথা বলা হয়। সেই সব কারণের মধ্যে ‘কোল্ড চেন’-এর বিষয়টিও যে রয়েছে, তা মেনে নিয়েছেন প্রসূতি ও নবজাতকদের মৃত্যু ঠেকাতে গড়া টাস্ক ফোর্সের চেয়ারম্যান ত্রিদিব বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘‘কিছু ত্রুটি ছিল। সেগুলো দূর করার ব্যবস্থা হয়েছে।’’

কিন্তু ওষুধ সংরক্ষণে দীর্ঘদিন ধরে যে-সমস্যা চলে আসছে, এত দ্রুত কি তার সমাধান করা সম্ভব?

সমস্যাটির স্বরূপ ব্যাখ্যা করে স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তা জানান, বেশির ভাগ ওষুধই দুই থেকে আট ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার মধ্যে রাখা উচিত। তার বেশি হলেও সমস্যা, কম হলেও সমস্যা। অনেক হাসপাতালেই বিভিন্ন ওয়ার্ডে যে-সব ফ্রিজে ওষুধ রাখা হয়, তার তাপমাত্রা ঠিকঠাক থাকে না। আর ঠিক যে নেই, সেটা জানাও থাকে না সেখানকার কর্মীদের। সব মিলিয়ে প্রক্রিয়াটাই ধাক্কা খায়। ‘‘তাই নিয়মিত নজরদারি জরুরি। সেই সঙ্গে কর্মীদের সচেতন করার জন্য প্রয়োজন যথাযথ প্রশিক্ষণেরও। তা না-হলে শুধু ওষুধ নয়, নষ্ট হবে প্রতিষেধক টিকাও,’’ বললেন ওই স্বাস্থ্যকর্তা। অর্থাৎ প্রশিক্ষণ ও কর্মীদের সচেতনতা ছাড়া সমস্যাটির সুরাহা সম্ভব নয়।

তবে টিকার ক্ষেত্রে কোনও সমস্যা নেই বলে দাবি করেছেন স্বাস্থ্য ভবনে এই বিষয়টির দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক শিখা অধিকারী। তিনি বলেন, ‘‘একটি সংস্থার সঙ্গে বার্ষিক রক্ষণাবেক্ষণের চুক্তি রয়েছে। তারাই এগুলো দেখাশোনা করে। এই নিয়ে কোনও সমস্যা হচ্ছে না।’’

এটা তো স্বাস্থ্যকর্তাদের দাবি। বাস্তব ছবিটা আসলে ঠিক কেমন?

ফার্মাসি ম্যানেজমেন্ট সংক্রান্ত একটি সংগঠনের সম্পাদক অলোক দে বলেন, ‘‘কিছু দিন আগে পোলিও টিকা নিয়ে একটি সমীক্ষার কাজ করেছিলাম। তাতে দেখা গিয়েছিল, যে-ভাবে পোলিও টিকা রাখা হয়, তা খুবই অবৈজ্ঞানিক। রোদ লেগে টিকা খারাপ হয়ে যায় বহু ক্ষেত্রেই। অথচ সেই টিকার মেয়াদ ফুরোতে তখনও হয়তো দু’বছর বাকি। সেই তারিখ দেখেই নিশ্চিন্ত হয়ে বাচ্চাদের টিকা দেওয়া হয়। যেটা খুবই ঝুঁকির।’’ এই সমস্যা এড়ানোর জন্য টিকার মোড়কে ‘ফোটো সেনসিটিভ’ লেবেল লাগিয়ে রাখা জরুরি বলে জানান অলোকবাবু। তাঁর বক্তব্য, সূর্যের আলো পড়লে ওই লেবেলের রং বদলে যায়। তাতেই ধরা পড়ে, টিকা ঠিক আছে কি না। এতে খরচ সামান্য বেশি পড়বে ঠিকই। কিন্তু নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হবে।

কলকাতার একটি মেডিক্যাল কলেজের এক শিক্ষক-চিকিৎসক বলেন, ‘‘জলাতঙ্কের প্রতিষেধক এমন ভাবে তৈরি হয় যে, ডিপ ফ্রিজে ঢোকালেই তা নষ্ট হয়ে যায়। এখানে একাধিক বার সেই ভুল হয়েছে। সেই টিকা কুকুরে কামড়ানো কোনও মানুষকে দিলে সেটা তো কোনও কাজেই আসবে না।’’ আসলে ‘কোল্ড চেন’-এর ব্যাপারে যথাযথ ধারণাই নেই হাসপাতালের অধিকাংশ কর্মীর, মন্তব্য ওই শিক্ষক-চিকিৎসকের।

কিছু দিন আগেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) এ দেশের ১০টি রাজ্যে সমীক্ষা চালিয়ে কোল্ড চেনের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে কিছু সুপারিশ করেছিল। ওই সব রাজ্যের মধ্যে আছে পশ্চিমবঙ্গও। সুপারিশের মধ্যে রয়েছে:

• ডিজিটাল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাপমাত্রার দিকে নজর রাখা।

• তাপমাত্রা ঠিকমতো মাপা হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য কর্মী নিয়োগ।

• কর্মীদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া। ফ্রিজ নিয়মিত ডিফ্রস্ট করা।

• গাড়িতে প্রতিষেধক টিকা সরবরাহের সময় ‘আইস প্যাক’ ঠিকঠাক রাখা ইত্যাদি।

টাস্ক ফোর্সের কর্তার দাবি, ত্রুটি দূর করার বন্দোবস্ত হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওই সব সুপারিশ আদৌ মানা হয়েছে কি?

‘‘ওই সব সুপারিশের কিছু কিছু অবশ্যই মানা হচ্ছে।
কিন্তু কর্মীদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়ার দিক থেকে আমরা এখনও অনেকটাই পিছিয়ে আছি,’’ স্বীকার করে নিয়েছেন স্বাস্থ্য দফতরেরই এক কর্তা। তিনি জানান, কী ভাবে ‘কোল্ড চেন’ বজায় রাখা উচিত, বজায় না-রাখলে কী কী সমস্যা হতে পারে, সেই ব্যাপারে স্বাস্থ্যকর্মীদের একটা বড় অংশের কোনও ধারণাই নেই। এবং সেটা খুবই বিপজ্জনক। এ ব্যাপারে শীঘ্রই কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার বন্দোবস্ত হচ্ছে বলে তিনি জানান।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE