‘শকিং ভিডিও হ্যাজ গন ভাইরাল’— এই শিরোনামে নজর কা়ড়ে তারা। কয়েক মিনিটে দেখে ফেলেন হাজার খানেক দর্শক। ঝড় বয়ে যায় মন্তব্যের। সোশ্যাল মিডিয়ার পাতা স্ক্রল করার অভ্যেস থাকলে এই ছবি বেশ চেনা। আঙুলের ক্লিকে সে ভিডিও খুললেই চমকে উঠতে হয়।
ঘটনা এক: রাস্তার ধার ঘেঁষে হাঁটছেন তরুণী। চকিতে ছুটে এল দুষ্কৃতী, হাতে ধারালো অস্ত্র। প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে খুন করা হল তাঁকে। সিনেমার দৃশ্যের শ্যুটিং নয়, সত্যিই ঘটল এমনটা। সেই দৃশ্য রেকর্ডেড হল একাধিক পথচারীর মোবাইল ফোনে। ছড়িয়েও পড়ল সোশ্যাল মিডিয়ায়। মাস কয়েক আগে দিল্লির ঘটনা।
ঘটনা দুই: রাস্তার পাশে কিছু গাছ, সেই গাছের পাশে ফেলে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে তরুণীকে। চড়াও হয়েছে ধর্ষক। ভরা রাস্তায়, দিনের আলোয় চলছে ধর্ষণ। মেয়েটি চিৎকার করছেন, পথচারীরা পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছেন। না, সকলে চলে যাচ্ছেন না। কেউ কেউ অতি যত্নে সেই ঘটনা বন্দি করছেন মোবাইল ফোনে। আর সেটাই ছড়িয়ে পড়ছে সোশ্যাল মিডিয়ার পাতায় পাতায়। দিন দশেক আগে, বিশাখাপত্তনমের ঘটনা।
ঘটনা তিন: লাঠি আর পাথর দিয়ে বেধড়ক পেটানো হচ্ছে এক বিদেশি যুগলকে। যুবকের মাথা থেকে গলগল করে রক্ত পড়ছে। হাতের যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন তরুণী। এলোপাথাড়ি মার চলছেই। এ দৃশ্যও মোবাইলের ভিডিও ক্যামেরায় বন্দি করলেন আশপাশে উপস্থিত মানুষেরা। মিনিটের মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়া জেনে গেল সুইস যুগলের হেনস্থার কথা। ছিছিক্কারে ভরে গেল নেট-দুনিয়া। অথচ ঘটনা ঘটার সময়ে ওই যুগলকে বাঁচাতে আসতে দেখা গেল না কাউকেই। সম্প্রতি ফতেপুর সিক্রির ঘটনা।
তিনটি ঘটনার স্থান-কাল-পাত্র বিচ্ছিন্ন হলেও, মিল এক জায়গাতেই। ঘটনার ধরনে এবং তাকে নিয়ে মানুষের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায়। তিন ক্ষেত্রেই ঘটনা ঘটেছে প্রকাশ্যে, জনবহুল এলাকায়। তিন ক্ষেত্রেই উপস্থিত মানুষ প্রতিবাদে চিৎকার করে ওঠার বদলে, ঝাঁপিয়ে পড়ে আক্রান্তকে উদ্ধার করার বদলে, নিজেদের ফোনে ঘটনাগুলি রেকর্ড করতে উদ্যোগী হয়েছেন। ধরে নেওয়া যেতে পারে, চোখের সামনে ঘটা অন্যায়ের প্রমাণ রাখতে চেয়েছেন তাঁরা। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, তা হলে পুলিশ বা প্রশাসনের কাছে সেই প্রমাণ জমা না দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়ার কারণ কী? এমন আচরণই কি সুশীল সমাজের নাগরিকদের কাছ থেকে প্রাপ্য আক্রান্তদের?
বিশিষ্ট জনেরা বলছেন, সামাজিক দায়বদ্ধতা এক দিকে, আর সামাজিক খ্যাতির আকাঙ্ক্ষা আর এক দিকে। দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে যে প্রতিবাদের প্রত্যাশা থাকে, খ্যাতির আকাঙ্ক্ষায় তাই-ই বদলে যায় ফেসবুক-প্রতিবাদে।
সমাজতত্ত্বের শিক্ষক প্রশান্ত রায় যেমন বলছেন, ‘‘চোখের সামনে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ কোনও দিনই খুব বড় আকারে হয়নি। হলেও দৃষ্টান্ত থেকে গিয়েছে একাধিক প্রতিবাদীর নিগৃহীত হওয়ার ঘটনা। কিন্তু প্রতিবাদ এড়িয়ে যাওয়া এক জিনিস আর ঘটনাকে চাক্ষুষ করে, ভিডিও করে ছড়িয়ে দেওয়া অন্য জিনিস।’’ তাঁর মতে, ভাইরাল ভিডিও পোস্টকারী হিসেবে নিজেকে জাহির করাটা একটা দিক। এ সব ক্ষেত্রে ভিডিওকারীদের খুঁজে বার করে তাঁদের সরাসরি প্রশ্নের মুখে ফেলা উচিত। প্রতিবাদ না করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ না হতে পারে, কিন্তু সমালোচনার যোগ্য তো বটেই!
আইনজীবী কল্লোল মণ্ডল আবার বলছেন, এ সব ক্ষেত্রে আক্রান্ত পক্ষ যদি সরাসরি অভিযোগ দায়ের করেন ভিডিওকারীদের বিরুদ্ধে, তা হলে আইটি অ্যাক্টে মামলা রুজু করা যেতে পারে। ‘‘কিন্তু ব্যক্তিগত শিক্ষা, রুচি, মূল্যবোধের জায়গা থেকে এই মানসিকতার বদল দরকার। আইনগত ভাবে শাস্তি দেওয়া যায়, নিয়ম করা যায়। কিন্তু মানসিকতা বদলানো যায় না,’’ বলেন তিনি। তাঁর মতে, যৌন হেনস্থার ক্ষেত্রে সামাজিক সম্মানের কথা ভেবে আক্রান্তের নাম বিচারে পর্যন্ত উল্লেখ করা হয় না। সেখানে তাঁর অসম্মানের ভিডিও ভাইরাল করা নিয়ে সুনির্দিষ্ট আইন থাকা উচিত, যাতে অভিযোগ-নির্বিশেষে পদক্ষেপ করা যায় আইনগত ভাবে।
মনোবিদেরা বলছেন, এটা সময়ের অসুখ। হাতে হাতে স্মার্টফোন এবং সোশ্যাল মিডিয়ার সহজলভ্যতা মানুষকে শিখিয়ে দিয়েছে সুপরিচিত হওয়ার সহজ উপায়। স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে ছবি তুলে পোস্ট করা এখন ফ্যাশন। সেই ফ্যাশনেই গজিয়ে উঠছে গভীর অসুখ। মানুষকে আর নাড়া দিচ্ছে না চোখের সামনে ঘটা নৃশংসতা। বরং সেই নৃশংসতাকে নিজের খ্যাতির সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করার কথা আগে মাথায় আসছে। মনোরোগের চিকিৎসক অনিরুদ্ধ দেবের কথায়, ‘‘যে কোনও খারাপ ঘটনা, অন্যায়, অপরাধ বা কুৎসার প্রতি মানুষের আকর্ষণ বরাবরই। এই ঘটনাগুলোর মাধ্যমে মানুষ সেই খারাপের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করে ফেলার চেষ্টা করে। আর পাঁচটা ঘটনার চেয়ে এই ঘটনাটি তার কাছে বিশেষ, ফলে সেটা সে ধরে রাখতে চায়।’’
এক পুলিশকর্তা আবার বলছেন, ‘‘প্রতিবাদ না-করার অভিযোগেও যদি পুলিশকে ছুটতে হয় অপরাধী ধরতে, তবে তা সুশীল সমাজের পক্ষে লজ্জার।’’