Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

চিকিৎসক নেই, সামান্য কারণেও প্রসূতিদের রেফার

কবিতা পাত্র। বয়স ২২ বছর। বেলদার বাসিন্দা কবিতা ভর্তি হয়েছিলেন খড়্গপুর মহকুমা হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগে। তাঁর গর্ভস্থ শিশুর ওজন কম হওয়ায় জটিল অস্ত্রোপচার প্রয়োজন। হাসপাতালের দু’জন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ চাপ সামলে কবিতাকে দেখতে পারেননি। অতএব মেদিনীপুর মেডিক্যালে ‘রেফার’।

খড়্গপুর হাসপাতাল। —নিজস্ব চিত্র।

খড়্গপুর হাসপাতাল। —নিজস্ব চিত্র।

দেবমাল্য বাগচী
খড়্গপুর শেষ আপডেট: ২৭ মে ২০১৫ ০২:১১
Share: Save:

কবিতা পাত্র। বয়স ২২ বছর। বেলদার বাসিন্দা কবিতা ভর্তি হয়েছিলেন খড়্গপুর মহকুমা হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগে। তাঁর গর্ভস্থ শিশুর ওজন কম হওয়ায় জটিল অস্ত্রোপচার প্রয়োজন। হাসপাতালের দু’জন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ চাপ সামলে কবিতাকে দেখতে পারেননি। অতএব মেদিনীপুর মেডিক্যালে ‘রেফার’।

বছর কুড়ির গীতা পাত্রের বাড়ি কেশিয়াড়ি। প্রবল রক্তচাপের সমস্যায় ভুগতে থাকা এই প্রসূতি খড়্গপুরে হাসপাতালে এসেছিলেন অনেক আশা নিয়ে। কিন্তু তাঁকেও মেদিনীপুর মেডিক্যালে রেফার করা হয়েছে। কারণ দেখানো হয়েছে, অস্ত্রোপচারে ত্রুটি হলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতিতে জোর দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অথচ গত একমাস ধরে এ ভাবেই প্রতিদিন খড়্গপুর মহকুমা হাসপাতালে আসা অধিকাংশ প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের রোহিণীকে স্থানান্তর করা হচ্ছে বলে অভিযোগ। বন্ধ হয়ে গিয়েছে স্ত্রীরোগের ‘কোল্ড অপারেশন’। চারদিনের বদলে দু’দিন চলছে বহির্বিভাগ। দুর্ভোগে ক্ষোভ বাড়ছে রোগী ও তাঁদের পরিজনদের মধ্যে।

মাস খানেক ধরে হাসপাতালের তিনজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের বদলে দু’জন থাকাতেই এই সঙ্কট বলে দাবি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। বিভাগের অস্থায়ী পদে আসা মেদিনীপুর মেডিক্যালের রেসিডেন্সিয়াল মেডিক্যাল অফিসার হিমাদ্রি নায়েক গত ২১ এপ্রিল থেকে ছেলের অসুস্থতার কারণে ছুটি নিয়েছেন। গত ১৩ মে অবিলম্বে চিকিৎসক নিয়োগের দাবিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চিঠি দেওয়ার পরেও হোলদোল নেই স্বাস্থ্য কর্তাদের। ফলে, ৬০০ রোগীর চাপ সামলানো মহকুমা হাসপাতালের স্ত্রীরোগ বিভাগ এখন প্রায় বিপন্ন।

অথচ এই হাসপাতালের উপর পিংলা, সবং, দাঁতন, কেশিয়াড়ি-সহ ১০টি ব্লকের বাসিন্দারা নির্ভরশীল। বিভিন্ন ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও গ্রামীণ হাসপাতালের বহু জটিল রোগী রেফারের পরে আসেন এই মহকুমা হাসপাতালে। এই মুহূর্তে হাসপাতালের অন্তর্বিভাগে মাসে গড়ে প্রায় ৬০০ স্ত্রীরোগী ভর্তি হন। এঁদের মধ্যে গড়ে ৩৭০ জন প্রসূতি। স্বাভাবিক প্রসবের বাইরে এখন প্রায় ৩০ শতাংশ প্রসূতিরই সিজার করতে হচ্ছে। এছাড়াও বহির্বিভাগে স্ত্রীরোগের চিকিৎসা জন্য প্রতি সপ্তাহে প্রায় ১৮০ জন আসেন। নিয়ম অনুযায়ী, তিন জন চিকিৎসকের সপ্তাহে ছ’দিন স্ত্রীরোগের বহির্বিভাগ চালানোর কথা। সেই নিরিখে দীর্ঘ দাবির পরে তিনজন মেডিক্যাল অফিসার পাওয়া সম্ভব হয়েছিল। কারণ, দু’জনের পক্ষে সমগ্র বিভাগের চাপ সামলানো কঠিন। তবে এখনও সপ্তাহের চারদিন (সোম, বুধ, বৃহস্পতি ও শনিবার) স্ত্রীরোগের বহির্বিভাগ চলে। কিন্তু হিমাদ্রিবাবু ছুটি নেওয়ায় বাকি দু’জন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ বিভাগ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। আর সেই মাশুল দিতে হচ্ছে রোগীদের।

এখন শুধুমাত্র বুধ ও শনিবার চলছে স্ত্রীরোগের বহির্বিভাগ। বন্ধ হয়েছে জরায়ু বাদ দেওয়া, জরায়ুর টিউমার, ওভারিয়ান সিস্টের মতো কোল্ড অপারেশন। সব থেকে বেশি সমস্যা প্রসূতি বিভাগের সিজার নিয়ে। এ ক্ষেত্রে সামন্য জটিলতা হলেই ‘রেফার’ করা হচ্ছে মেদিনীপুরে। চারদিনের বদলে দু’দিন বহির্বিভাগ খোলা থাকায় রোগীর সংখ্যা যেমন বেড়েছে তেমনই উঠছে দায়সারা চিকিৎসার অভিযোগ। চিকিৎসাধীন রোগিণীদেরও সঠিক চিকিৎসা হচ্ছে না বলে অভিযোগ। এক প্রসূতির স্বামীর কথায়, “দু’দিন হল স্ত্রীকে ভর্তি করেছি। কিন্তু চিকিৎসকেরা রোগীকে ছুঁয়েও দেখছেন না। কিছু বলতে গেলে নার্সরা মেজাজ নিয়ে বলছেন রোগীকে মেদিনীপুরে নিয়ে যেতে।”

হাসপাতাল সূত্রে খবর, দীর্ঘদিন ধরেই হাসপাতালের স্ত্রীরোগ বিভাগের পরিষেবা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। মহকুমা হাসপাতালের নিয়ম অনুযায়ী বিভাগের দু’জন চিকিৎসকের পদ থাকলেও তা এই হাসপাতালের ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। কারণ, বিভাগে ৬০টি শয্যা থাকলেও অতিরিক্ত ৬০শতাংশ রোগী থাকছে। তাই দীর্ঘ দিনের চাহিদার মেনে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ হিমাদ্রিবাবুকে এই হাসপাতালে নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু গত ৩১ অক্টোবর হিমাদ্রীবাবুকে ফের মেদিনীপুর মেডিক্যালে স্থানান্তর করা হয়। তখন খড়্গপুরে সঙ্কট বাড়লে তড়িঘড়ি অস্থায়ী পদে ফিরিয়ে আনা হিমাদ্রিবাবু। ছেলের অসুস্থতার জন্য তিন একমাস ছুটিতে থাকায় ফের সমস্যা বেড়েছে। দুই স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ অর্কপ্রভ গোস্বামী ও সৌরভ সেনাপতি সপ্তাহে তিন দিন পালা করে ‘অন-কল ডিউটি’ করছেন। অর্কপ্রভবাবুর কথায়, “রেফার’ করতে আমরাও চাই না। তবে দু’জনের পক্ষে অন-কল ডিউটির পরে সব দিক সামলানো কঠিন। বাধ্য হয়ে রেফার করতে হচ্ছে।”

এই পরিস্থিতিতে আর একজন চিকিৎসক কোনও কারণে ছুটিতে গেলে কী হবে, সেই প্রশ্ন উঠছে। রাজ্য সরকারি কর্মচারী ফেডারেশনের খড়্গপুর মহকুমা হাসপাতালের উপদেষ্টা দিলীপ সরখেল বলেন, “এই পরিস্থিতিতে রোগীর পরিজনেরা চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীদের উপর ক্ষোভ উগরে দিচ্ছে। এখানে চারজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন। তাই অন্তত একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ অবিলম্বে প্রয়োজন বলে কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি করেছি।”

কী বলছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ? খড়্গপুর মহকুমা হাসপাতালের সুপার কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেন, “স্ত্রীরোগ বিভাগে আমাদের ন্যূনতম তিনজন প্রয়োজন। একজন ছুটি নেওয়ায় বিভাগের সব কাজ সমান তালে চলছে না ঠিকই। তবে আমরা পরিষেবা দিতে আপ্রাণ চেষ্টা করছি। স্বাস্থ্য অধিকর্তার কাছে বিশেষজ্ঞের দাবিতে চিঠিও দিয়েছি।” যদিও এই বিষয়ে জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক গিরীশচন্দ্র বেরার বক্তব্য, “এই মুহূর্তে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ সংখ্যায় কম থাকায় নিয়োগ সম্ভব নয়। একজন ছুটি নিলে বাকি দু’জনকে বাড়তি চাপ নিতে হবে এটাই নিয়ম। আমি সুপারকে একটু অন্তর্বিভাগ ও বহির্বিভাগ সামলাতে বলেছি। পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা চলছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE