রাতপথে দূষণ ছড়াচ্ছে এই সব ট্রাক। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
শনিবার রাত সাড়ে ১২টা। শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড় দিয়ে যাচ্ছে বড় বড় পাঁচটি ট্রাক। তাদের কালো ধোঁয়ায় চোখে জ্বালা ধরার জোগাড়। শুধু শ্যামবাজারই নয়, দ্বিতীয় হুগলি সেতু, হাওড়া ব্রিজ থেকে শুরু করে গড়িয়া কিংবা ই এম বাইপাস সর্বত্রই ট্রাকের বিষ-ধোঁয়ার সামনে পড়লে প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম।
রাত বাড়লে রাস্তায় গাড়ি কমে। সরল হিসেবে তাই রাতের শহরে দূষণের মাত্রা কমার কথা। রাজ্যের দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের হিসেব কিন্তু অন্য কথা বলছে। ওই পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দৈত্যাকার ওই সমস্ত ট্রাকের হাত ধরে শহরে গভীর রাতে বা শেষ রাতে কখনও কখনও দূষণের মাত্রা ছাপিয়ে যাচ্ছে দিনের বায়ুদূষণের মাপকেও।
গত ১৭ ডিসেম্বরের হিসেবই ধরা যাক। রাজ্য পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের কর্তারা জানাচ্ছেন, ওই দিন দুপুর বারোটায় কলকাতায় দূষণের মাত্রা ছিল প্রতি ঘনমিটারে প্রায় ১০৮ মাইক্রন। অথচ, ওই দিনই রাত দুটোয় দূষণের মাত্রা বেড়ে গিয়ে হয়েছে প্রতি ঘনমিটারে ৩৩৯ মাইক্রন। ওই কর্তারা বলেন, “শহরের বেশির ভাগ বায়ুদূষণই হয় গাড়ির ধোঁয়া থেকে। রাতে দিনের তুলনায় যানবাহন অনেক কম চলে। তাই দূষণও কম হওয়ার কথা। কিন্তু রাতে কলকাতার যে সব রাস্তায় ট্রাক চলে, সেখানে দিনের দূষণকেও অনেক সময়ে ছাপিয়ে যায়।” কলকাতা পুলিশের হিসেব বলছে, রাতে গড়ে হাজার দশেক ট্রাক চলে। পরিবেশবিদদের দাবি, ওই ট্রাকের বেশির ভাগই দূষণ-বিধির তোয়াক্কা করে না। ফলে সেগুলি থেকে নির্গত ধোঁয়া অনেক বেশি দূষণ ছড়ায়। বিশেষত, বাইরের জেলা কিংবা শহর থেকে আসা ট্রাকগুলিই দূষণ বৃদ্ধিতে বেশি দায়ী বলে তাঁরা মনে করেন।
কিন্তু কেনই বা এমন দূষণ-দৈত্য রাতের ট্রাক?
২০০৫ সালে পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত কলকাতায় রাতের দূষণ নিয়ে একটি মামলা করেছিলেন। তাঁর অভিযোগ ছিল, বাইরে থাকা আসা ট্রাকগুলি অতিরিক্ত ভার বহন করে। তার ফলে স্বাভাবিক মাত্রার তুলনায় অনেক বেশি ধোঁয়া ছাড়ে তারা। সুভাষবাবুর কথায়, “ট্রাকগুলির জ্বালানির মান নিয়েও সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।”
সুভাষবাবুর সঙ্গে একমত রাজ্য পরিবহণ দফতরের কর্তারাও। এক কর্তার মতে, “শুধু বেশি মাত্রায় মাল তোলার কারণে দূষণ বাড়ে, এমনটাই নয়। কিন্তু দূষণ বাড়ার পিছনে তা অন্যতম বড় কারণ।” ওই কর্তা বলেন, ট্রাকের ক্ষমতার তুলনায় দ্বিগুণ বা তিন গুণ পর্যন্ত মাল তোলা হয়। ফলে ওই ট্রাকের ইঞ্জিনের উপরে চাপ পড়ে। তার উপরে অতিরিক্ত ভার বহনের কারণে বেশির ভাগ সময়েই দ্বিতীয় বা প্রথম গিয়ারে ট্রাকটি চালাতে হয়। গাড়ি যত কম গিয়ারে চলে, দূষণের মাত্রাও তত বাড়ে। সে কারণেই বাড়তি মাল বহনকারী ট্রাক থেকে দূষণের মাত্রা বাড়ে। বিশেষত, বালি-পাথরের ট্রাক থেকে এ ধরনের দূষণ বেশি ছড়ায় বলে দাবি পরিবহণ-কর্তাদের। তা ছাড়া, বালি-পাথরের ট্রাক থেকে প্রচুর পরিমাণে ধুলোও ওড়ে। তা আটকানোর জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না নিয়েই ওই সব ট্রাক শহরে ঢোকে।
পরিবহণ-কর্তারা জানাচ্ছেন, এখনকার নিয়ম অনুযায়ী, কলকাতার মধ্যে বিএস-৪ ইঞ্জিন ছাড়া কোনও ট্রাকের রেজিস্ট্রেশন হয় না। কিন্তু কলকাতার বাইরে থেকে আসা ট্রাকের ক্ষেত্রে এমন কোনও নিয়ম নেই। এমনকী, কলকাতায় ঢোকার মুখে ভিন্ রাজ্য থেকে আসা ট্রাকগুলির দূষণের মাত্রা পরীক্ষা করার কোনও ব্যবস্থাও নেই। ট্রাক-মালিক সংগঠন ‘ফেডারেশন অব ট্রাক অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর সম্পাদক সত্যজিৎ মজুমদার বলেন, “প্রতিটি ট্রাকের দূষণ-শংসাপত্র দেখিয়েই শহরে ঢোকার কথা। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পুলিশ সেগুলি ঠিকমতো পরীক্ষা করে না। তার উপরে বহু বছর ধরে শহরে ঢোকার মুখে দূষণ পরীক্ষা কেন্দ্র বসানোর কথা থাকলেও এখনও তা হয়নি। ফলে, ট্রাকচালকদের দেখানো দূষণ-শংসাপত্রের উপরেই ভরসা করতে হয়।”
ট্রাকের বেনিয়ম রুখতে শহরে ঢোকার মুখগুলিতে পর্যাপ্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা করা উচিত বলে মনে করেন পরিবহণ দফতরের কর্তারাও। কিন্তু পরিবহণ দফতরের কর্তাদের মতে, ইচ্ছে থাকলেও এখনই এ ধরনের পরীক্ষাকেন্দ্র তৈরি করা সম্ভব নয়। কারণ সেই পরিকাঠামোই পরিবহণ দফতরের কাছে নেই।
অতএব, রাতের দূষণ-দৈত্যদের আটকানোর জন্য এখনই কোনও রাস্তা দেখাতে পারছে না সরকার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy