Advertisement
০৭ মে ২০২৪
মানসিক হাসপাতাল

অশান্তি বাড়ার পিছনে রোগীর চাপ

এক রোগিণীর মৃত্যুতেও ‘শিক্ষা’ হল না এ রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তাদের। পাভলভ মানসিক হাসপাতালের ওয়ার্ডে বেধড়ক মার খেয়ে দিন কয়েক আগে মৃত্যু হয়েছিল বৃদ্ধা কমলা মজুমদারের। হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষের বক্তব্য ছিল, রোগীদের নিজেদের মধ্যে মারপিটের জেরে মারা গিয়েছেন তিনি। কিন্তু কেন রোগীদের মধ্যে মারপিট বাধল? হাসপাতালকর্মী এবং রোগীদের সঙ্গে কথা বলে প্রাথমিক ভাবে জানা গিয়েছে, শয্যার চেয়ে বেশি সংখ্যক রোগী থাকার ফলে হাসপাতালের নানা খাতে টান পড়ছে।

সোমা মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০৪
Share: Save:

এক রোগিণীর মৃত্যুতেও ‘শিক্ষা’ হল না এ রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তাদের।

পাভলভ মানসিক হাসপাতালের ওয়ার্ডে বেধড়ক মার খেয়ে দিন কয়েক আগে মৃত্যু হয়েছিল বৃদ্ধা কমলা মজুমদারের। হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষের বক্তব্য ছিল, রোগীদের নিজেদের মধ্যে মারপিটের জেরে মারা গিয়েছেন তিনি। কিন্তু কেন রোগীদের মধ্যে মারপিট বাধল? হাসপাতালকর্মী এবং রোগীদের সঙ্গে কথা বলে প্রাথমিক ভাবে জানা গিয়েছে, শয্যার চেয়ে বেশি সংখ্যক রোগী থাকার ফলে হাসপাতালের নানা খাতে টান পড়ছে। শোয়ার জায়গা নেই। পোশাক কম পড়ছে। খাবারেও টান। ফলে রোগীদের মধ্যে দানা বাঁধছে ক্ষোভ। চিকিৎসকদের একটা বড় অংশ মনে করছেন, যত দিন না এই উপচে পড়া ভিড় সামলানো যাবে, তত দিন রোগীদের মধ্যে বিক্ষোভ সামাল দেওয়া কোনও মতেই সম্ভব নয়।

কেন রোগীর এত ভিড়? এর অন্যতম কারণ হল সুস্থ হওয়ার পরে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হাসপাতাল থেকে রোগীকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয় না। অন্য কারণও রয়েছে। তা হল লাল ফিতের ফাঁস। যেখানে পরিজনেরা আসছেন রোগীকে বাড়ি নেবেন বলে, সেখানেও নানা কারণ দেখিয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়তে টালবাহানা করা হচ্ছে। শুক্রবার বহরমপুর মানসিক হাসপাতালের বিরুদ্ধে এমন একটি অভিযোগ জমা পড়েছে। বৃহস্পতিবার সেখান থেকে বাড়ি ফিরেছেন জলেশ্বরী মাল নামে এক মহিলা। অভিযোগ, টানা তিন মাস তাঁর বাড়ির লোককে ঘুরিয়ে অবশেষে জলেশ্বরীকে বাড়ি ফেরার ছাড়পত্র দিয়েছে হাসপাতাল। শুক্রবারও রানাঘাটের বাসিন্দা সবিতা ভৌমিক নামে এক রোগিণীকে ফিরিয়ে নিতে এসে নাজেহাল হয় তাঁর পরিবার।

হাসপাতাল সূত্রে খবর, সিউড়ির গোবিন্দপুরের বাসিন্দা, দুই সন্তানের মা জলেশ্বরীর মানসিক সমস্যা ধরা পড়ে ন’বছর আগে। তার পরে এক দিন আচমকাই নিরুদ্দেশ হয়ে যান তিনি। কোনও ভাবে পৌঁছন কেরল। চার বছর তিরুঅনন্তপুরমে ছিলেন তিনি। তার পরে কোনও ভাবে এ রাজ্যে ফেরেন। তাঁর হদিস মেলে বর্ধমানে। বর্ধমান আদালতের নির্দেশে জলেশ্বরীর ঠাঁই হয় বহরমপুর মানসিক হাসপাতালে। গত চার বছর সেখানেই রয়েছেন তিনি। এ বার দুর্গাপুজোয় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ওই হাসপাতালের রোগীদের নিয়ে এক দিন ঠাকুর দেখার ব্যবস্থা করেছিল। একটি টিভি চ্যানেলে সেই খবর সম্প্রচারিত হওয়ার সময়ে রোগীদের ভিড়ে স্ত্রীকে দেখেন জলেশ্বরীর স্বামী প্রফুল্ল মাল। তখনই তিনি জানতে পারেন, স্ত্রী বহরমপুর হাসপাতালে ভর্তি। তড়িঘড়ি বহরমপুর ছোটেন তিনি। কিন্তু হাসপাতালের সুপার জানিয়ে দেন, আদালতের নির্দেশ ছাড়া জলেশ্বরীকে ছাড়বেন না। নিরক্ষর, দরিদ্র পরিবার আইন-আদালতের মারপ্যাঁচ বোঝেনি। ফলে আদালতের সবুজ সঙ্কেত পেতে চলে গিয়েছে তিনটে মাস। শেষে বৃহস্পতিবার স্ত্রীকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছেন প্রফুল্ল।

কেন আদালতের নির্দেশ ছাড়া ছুটি হল না জলেশ্বরীর? সুপার পবিত্র সরকার জানান, তাঁদের কিছু নিয়ম মানতে হয়। আদালতের নির্দেশে ভর্তি হলে ছাড়া পেতেও আদালতের নির্দেশ প্রয়োজন। তিনি বলেন, “রোগীকে এক বার ছাড়ার পরে ফের যদি কেউ এসে আত্মীয় বলে দাবি করেন, তখন কী করব? আমাদের সতর্ক থাকতেই হয়। বহু ক্ষেত্রেই স্থানীয় জনপ্রতিনিধির চিঠি আনলে আমরা বাড়ি যাওয়ার অনুমতি দিই।” হাসপাতাল-কর্মীদের একাংশের অবশ্য অভিযোগ, হাসপাতাল থেকে ছুটি পাওয়া নিয়ে হয়রানি বহরমপুরে প্রায় নিত্য ঘটনা।

স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “এই মনোভাব অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। কোনও ক্ষেত্রেই স্থানীয় জনপ্রতিনিধির চিঠি নিয়ে এলে না ছাড়ার যুক্তি নেই। যেখানে বাড়ির লোককে ফিরিয়ে না নেওয়ার নজির অজস্র, সেখানে ইচ্ছুক পরিবারকে এ ভাবে হয়রান করার কোনও অর্থই নেই। এই লাল ফিতের ফাঁসেই আমাদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে।”

মানসিক হাসপাতালে কাজ করা একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের তরফে রত্নাবলী রায় বলেন, “মানসিক রোগীদের হাসপাতাল থেকে ছাড়ার ব্যাপারে রাজ্য সরকারকে অবিলম্বে নির্দিষ্ট নীতি নিতে হবে। তা না হলে পুনর্বাসনের সব উদ্যোগ ধাক্কা খাবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

mental hospital soma mukhopadhyay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE