হাসপাতাল একটা হলেও ‘ক্যাম্পাস’ দু’টি। পাশাপাশি নয়, প্রায় আড়াই কিলোমিটারের দূরত্ব। নদিয়া জেলা হাসপাতালের সদর ও শক্তিনগর ক্যাম্পাসের মধ্যে ছোটাছুটি করতে-করতে ক্লান্ত চিকিৎসকেরা। ভোগান্তির শেষ নেই রোগীদেরও। একটাই ক্যাম্পাস করা, নিদেনপক্ষে একই বিভাগের ইনডোর আর আউটডোর একত্রে রাখার জন্য বহু আন্দোলন করেছেন কৃষ্ণনাগরিক। সমস্যার কথা মেনে নিলেও সমাধানে ব্যর্থ প্রশাসন।
কৃষ্ণনগরে আজ যেখানে সদর হাসপাতাল, সেটা আগে ছিল একটা চার্চ। ইংরেজ শাসনকালে একবার মহামারী হলে কর্তৃপক্ষ চার্চকে চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করতে দেন। সেই শুরু। ১৯৫৫ সালে দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ঠিক হয় যে জেলায়-জেলায় একটি করে হাসপাতাল করা হবে। নদিয়ায় সদর হাসপাতালের পাশে কোনও উপযুক্ত জমি পাওয়া গেল না। জমির অভাবে হাসপাতাল তৈরি অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় এগিয়ে এলেন শক্তিনগরের মানুষ। ‘শক্তিমন্দির’ নামে একটি সংস্থা স্টেশন সংলগ্ন প্রায় ৫০ বিঘা জমি দান করলেন। সেখানেই ১৯৬৪ সালে তৈরি শক্তিনগর জেলা হাসপাতাল।
সেই থেকে জেলা হাসপাতালের দু’টি ক্যাম্পাস। সদর হাসপাতালে এখন ইনডোর শুধুমাত্র প্রসূতি ও সদ্যোজাতদের জন্য। প্রসূতিদের শয্যা সংখ্যা ৯৫। গড়ে অবশ্য আড়াইশো রোগী ভর্তি থাকেন। সদ্যোজাতদের এসএনসিইউ-তে ১২ ও নিওনেটাল বিভাগে ২৪টি শয্যা আছে এই ক্যাম্পাসে। জেলা হাসপাতালের বাকি সমস্ত বিভাগেরই ইনডোর শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে। আসন শয্যা সংখ্যা ৪৫০। অথচ এই ক্যাম্পাসে নাক-কান-গলা, দাঁত ও চোখের মতো কয়েকটি বিভাগের আউটডোর আছে শুধু। বাকি বিভাগগুলির আউটডোর সদর হাসপাতাল ক্যাম্পাসে।
চিকিৎসকদের বক্তব্য, মাঝে-মধ্যেই আউটডোরে রোগী দেখার সময় শক্তিনগর হাসপাতাল থেকে ‘অনকল’ ডাক আসে সেটা কোনও মুমুর্ষু রোগী ভর্তি হলেও হতে পারে আবার ওই চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকা কোনও রোগীর শারীরিক অবস্থার হঠাৎ অবনতি হলেও হতে পারে। এই রকম পরিস্থিতি হলে আউটডোরের রোগী ফেলে ছুটতে হয় শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে। সব সময় সেটা সহজ হয় না। কারণ জেলা সদর হাসপাতাল থেকে শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে যেতে গেলে যে রাস্তার উপর দিয়ে যেতে হয় সেটা বেশিরভাগ সময়ই যানজটে আটকে থাকে।
সমস্যা সমাধানের চেষ্টা যে একেবারে করা হয়নি, তা-ও নয়। কয়েক বছর আগে শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে একই ছাদের তলায় ইনডোর-আউটডোর করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। সেই মতো কিছু নির্মাণকাজও হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরিকল্পনা সফল হয়নি। সেই ঘরগুলির কোনওটা এখন অন্য কারণে ব্যবহার করা হচ্ছে, কোনওটা পড়ে আছে।
এ দিকে, দু’টো হাসপাতালেই জরুরি বিভাগ চালু থাকলেও সদর হাসপাতালে প্রসূতি ছাড়া অন্য কোনও রোগী ভর্তির সুযোগ না থাকায় যত মুমুর্ষু রোগীই হোক না কেন পাঠিয়ে দেওয়া হয় আড়াই কিলোমিটার দূরে শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে। যানজটের ভিতরে এই আড়াই কিলোমিটার দূরে সেই হাসপাতালে যাওয়ার পথে রোগীর মৃত্যুর ঘটনার সাক্ষীও এই কৃষ্ণনগর।
হাসপাতালের প্রাক্তন সুপার তথা বর্তমান রোগী কল্যাণ সমিতির সদস্য রমেন সরকার বলেন, ‘‘এই সমস্যা দীর্ঘ দিনের। দু’টি ক্যাম্পাস হওয়ার কারণে প্রতি মুহুর্তে নানান সমস্যায় পড়তে হয় রোগী থেকে শুরু করে চিকিৎসক এমনকী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকেও।” শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে প্রসূতি বিভাগ ছাড়া বাকি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগগুলো থাকলেও সুপার বসেন সদর হাসপাতালে। ফলে এত দূর থেকে শক্তিনগর জেলা হাসপাতালের উপরে নজরদারি চালানো কঠিন হয়ে পড়ে সুপারের পক্ষে। তার উপরে শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে আছে ‘স্টক রুম’। সদর হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ, স্যালাইন থেকে শুরু করে যাবতীয় জিনিসপত্র নিয়ে আসতে হয় শক্তিনগর জেলা হাসপাতাল থেকে। এ ছাড়াও দু’টি ক্যাম্পাসের জন্য দু’টি জরুরি বিভাগ খুলে রাখতে হয় ২৪ ঘণ্টার জন্য। তাই শুধু মাত্র জরুরি বিভাগের জন্য প্রতিদিন তিনটি ‘শিফটে’ ছ’জন চিকিৎসকের প্রয়োজন হয় যেখানে চিকিৎসকের সংখ্যা এমনিতেই প্রয়োজনের তুলনায় কম।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, এই জেলা হাসপাতালে সরকারি নির্দেশিকা অনুযায়ী ১৬ জন জিডিএমও চিকিৎসক থাকার কথা। আছেন মাত্র ৫ জন। সেই কারণে প্রতিদিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের দিয়ে জরুরি বিভাগ সামলানো হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, ক্যাম্পাস আলাদা হলেও আদতে একটি হাসপাতাল হওয়ায় সরকারি নির্দেশিকা অনুযায়ী একটি হাসপাতালের মতো করেই চিকিৎসক ও কর্মী নিযোগ করা হয়েছে। সেই চিকিৎসক, নার্স, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী ও সাধারণ কর্মীদের দু’টি ক্যাম্পাসে ভাগ করে দেওয়ায় সমস্যা হচ্ছে। হাসপাতালের এক কর্তার কথায়, ‘‘আসলে আমাদের যা আছে তা হয়তো খুব একটা কম নয়। কিন্তু সেটা দু’টো ক্যম্পাসের মধ্যে ভাগ করে দিতে গিয়েই কম পড়ে যাচ্ছে।’’ যেমন, নার্সের সংখ্যা এই মুহুর্তে কিছুটা বেশি। সরকারি নির্দেশিকা অনুযায়ী যেখানে ১৫৬ জন থাকার কথা সেখানে আছেন ১৬৫ জন সদর হাসপাতালে ৭৪ জন আর শক্তিনগর হাসপাতালে ৯১ জন। কিন্তু সদর হাসপাতালে ভর্তি আড়াইশোর বেশি প্রসূতির তুলনায় নার্সের সংখ্যা কম পড়ে যায় বলে দাবি কর্তৃপক্ষের।
আবার দু’জায়গাতেই প্যাথোলজি, এক্স-রে ও ইসিজি ইউনিট আছে। সেই হিসাবে দু’টি ইউনিটের জন্য কর্মী কম। দু’টি ক্যাম্পাসেই ইউএসজি ইউনিট আছে। কিন্তু চিকিৎসক আছেন মাত্র এক জন। তাঁকেই সামলাতে হয় দু’টি ইউনিট।
এই প্রেক্ষিতে শহরের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষেরও দাবি দু’টি ক্যাম্পাসকেই আলাদা করে দু’টি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল তৈরি করা হোক। তাতে আলাদা জিও বা সরকারি নির্দেশিকা অনুযায়ী আলাদা আলাদা করে চিকিৎসক থেকে শুরু করে নার্স, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী ও সাধারণ কর্মী নিয়োগ করা যাবে। আর একান্তই সেটা না করা হলে যে ক্যাম্পাসে যে বিভাগের ইনডোর আছে সেই ক্যাম্পাসেই সেই বিভাগের আউটডোর করতে হবে।
জেলা হাসপাতালের এই সব সমস্যা নিয়ে বেশ কয়েক বছর আগে নদিয়া জেলা স্বাস্থ্য উন্নয়ন কমিটি আন্দোলন শুরু করেছিলেন। সেই সংগঠনের সম্পাদক শঙ্কর সান্যাল বলেন, ‘‘সদর হাসপাতালকে যদি আলাদা করে দিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ মহকুমা হাসপাতাল করে দেওয়া হয় তাহলে কিন্তু এই সমস্যা থাকত না। তাতে শক্তিনগর জেলা হাসপাতালের উপরেও চাপ কমত। আমাদের এই সব পরামর্শ কেউ শোনেনি।” কৃষ্ণনগর পুরসভার পুরপ্রধান তৃণমূলের অসীম সাহা সমস্যার গভীরতা মেনে নিয়ে বলেন, ‘‘জেলা হাসপাতালের দু’টি ক্যাম্পাস হওয়ায় সকলেরই সমস্যা। বিশেষ করে রোগীদের চরম হয়রানি হয়। আমি একাধিকবার রোগী কল্যাণ সমিতির সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। লাভ হয়নি।” চিকিৎসকদের একাংশেরও শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে যেতে অনিচ্ছা আছে বলে দাবি পুরপ্রধানের। যদিও হাসপাতালের সুপার হিমাদ্রী হালদার বলেন, ‘‘এখানে চিকিৎসকরা সকলেই একই ক্যাম্পাসে ইনডোর আর আউটডোর চান। সেই মতো বিভিন্ন জায়গায় দরবার করা হয়েছে। আশা করছি কাজ হবে তাতে।’’
নদিয়া জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক নিতাইচন্দ্র মণ্ডল বলেন, “শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে শুধু মাত্র বর্হিবিভাগের জন্য আলাদা করে একটি ভবন তৈরি করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সেখানে শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে যে যে অন্তর্বিভাগ আছে সেই সেই বিভাগের বর্হিবিভাগও ওই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে। তাহলেই সমস্যার অনেকটা সমাধান হয়ে যাবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy