Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪

এমডি-এমএসে বাড়তি আসনের দাবি নামঞ্জুর

পরিকাঠামোর ঘাটতি ঢাকতে কনে সাজানোর রেওয়াজ দীর্ঘ দিনের। পরিদর্শকদের চোখে ধুলো দিতে মেডিক্যাল কলেজগুলোয় ডাক্তার-নার্স-চিকিৎসাকর্মী থেকে শুরু করে যন্ত্র, যন্ত্রী, মায় টেবিল-চেয়ার-আলমারিও ধার করে আনা হয় বলে অভিযোগ। এবং সে অভিযোগ যে উড়িয়ে দেওয়ার নয়, মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া (এমসিআই)-র সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তে তার ইঙ্গিত। পশ্চিমবঙ্গে মেডিক্যাল পঠনপাঠনের স্নাতকোত্তর স্তরে আসনবৃদ্ধির সিংহভাগ সরকারি আর্জি খারিজ করে দিয়েছে এমসিআই।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ মার্চ ২০১৪ ০২:৩৭
Share: Save:

পরিকাঠামোর ঘাটতি ঢাকতে কনে সাজানোর রেওয়াজ দীর্ঘ দিনের। পরিদর্শকদের চোখে ধুলো দিতে মেডিক্যাল কলেজগুলোয় ডাক্তার-নার্স-চিকিৎসাকর্মী থেকে শুরু করে যন্ত্র, যন্ত্রী, মায় টেবিল-চেয়ার-আলমারিও ধার করে আনা হয় বলে অভিযোগ। এবং সে অভিযোগ যে উড়িয়ে দেওয়ার নয়, মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া (এমসিআই)-র সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তে তার ইঙ্গিত। পশ্চিমবঙ্গে মেডিক্যাল পঠনপাঠনের স্নাতকোত্তর স্তরে আসনবৃদ্ধির সিংহভাগ সরকারি আর্জি খারিজ করে দিয়েছে এমসিআই।

এ রাজ্যে মেডিক্যালে স্নাতকোত্তরে মোট আসন ৭৭৫। বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে সব মিলিয়ে আরও শ’খানেক আসন চালু করতে চেয়ে রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর এমসিআইয়ের কাছে দফায় দফায় আবেদন পেশ করেছিল। কিন্তু হাসপাতাল পরিদর্শন করে এর তিন-চতুর্থাংশই খারিজ করেছে কাউন্সিল। ৭৬টি’র আবেদন বাতিল হয়েছে, অনুমোদন মিলেছে সাকুল্যে গোটা ২৪ বাড়তি আসনের। এর বাইরে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে স্নাতকোত্তর শল্যচিকিৎসার (এমএস) যে পনেরোটি চালু আসন, তারও তিনটে ছেঁটে ফেলতে এমসিআই নোটিস ধরিয়েছে স্বাস্থ্য দফতরকে। এ হেন কড়া পদক্ষেপের পিছনে যুক্তি কী?

রাজ্যের স্বাস্থ্য-কর্তারা জানিয়েছেন, আবেদন খারিজের কারণ হিসেবে মূলত পরিকাঠামোর অভাবের দিকেই আঙুল তুলেছে এমসিআই। প্রফেসরের অভাব ও মেডিক্যাল জার্নালে বিভাগীয় চিকিৎসকদের গবেষণাপত্র প্রকাশের ‘স্বল্পতা’র উল্লেখ করা হয়েছে। পাশাপাশি এমসিআয়ের বক্তব্য: রাজ্যের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের লাইব্রেরি-ল্যাবরেটরি মাঝারি মানের। শৌচাগারেরও সমস্যা। উপরন্তু অনেক চিকিৎসকের স্বীকৃত ডিগ্রি নেই।

এ সবই স্নাতকোত্তরে বাড়তি আসনলাভের পথে অন্তরায় বলে মনে করছে এমসিআই। শুনে রাজ্য সরকার কী বলছে? কাউন্সিলের সিদ্ধান্তে রাজ্যের স্বাস্থ্য-কর্তারা স্বভাবতই ক্ষুব্ধ। তাঁদের দাবি, এমসিআই ‘তুচ্ছ কারণে’ আবেদন খারিজ করেছে, যা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বঞ্চনা ছাড়া কিছু নয়। দফতরের অভিযোগ, রাজ্যে শিক্ষক-চিকিৎসকের অভাব দূর করতে কাউন্সিলই পরামর্শ দিয়েছিল বাড়তি আসনের আবেদন জানাতে। স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “এ কেন্দ্রের নতুন কায়দা। ওরা বিলক্ষণ জানে, পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষক-চিকিৎসক প্রয়োজনের তুলনায় কম। অন্যান্য পরিকাঠামো কোথাও একশো শতাংশ ঠিকঠাক থাকতে পারে না। এ সব জেনেই ওরা আমাদের বলেছিল বাড়তি আসনের আবেদন করতে। বলা হয়েছিল, পরিকাঠামো ধীরে ধীরে বাড়ালেই চলবে। কিন্তু কোথায় কী!”

কাউন্সিলের কী অভিমত?

সিদ্ধান্তের মধ্যে এমসিআই অবশ্য কোনও ভুল দেখছে না। “এমসিআই দুর্নীতিগ্রস্ত, তারা টাকা নিয়ে অনুমোদন দেয় এই অভিযোগ অনেক দিনের। ফলে আমাদের ভাবমূর্তি রক্ষার তাগিদ রয়েছে,” মন্তব্য কাউন্সিলের এক শীর্ষ কর্তার। এমসিআইয়ে রাজ্য সরকার মনোনীত সদস্য, চিকিৎসক সুদীপ্ত রায় বলেন, “একটা বার্তা দেওয়া দরকার ছিল যে, অন্য হাসপাতাল থেকে ধার করে ডাক্তার-নার্স-কর্মী-যন্ত্র-আসবাব এনে এমসিআই পরিদর্শকদের চোখে ধুলো দেওয়া যাবে না।”

বস্তুত পরিকাঠামোয় টান ধরলে যে এমডি-এমএসে বাঞ্ছিত মানের পঠনপাঠন কঠিন, রাজ্য স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অমিত বন্দ্যোপাধ্যায়ও তা মানছেন। “পরিকাঠামো, বিশেষত শিক্ষক-চিকিৎসকের অভাব থাকলে স্নাতকোত্তরে পড়ুয়াদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া যায় না।” বলছেন তিনি। তবে অমিতবাবু জানান, দিল্লিতে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য-কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক হবে। সেখানে রাজ্যের প্রতিনিধিরা নিজের বক্তব্য পেশ করতে পারবেন।

তা সত্ত্বেও স্বাস্থ্য দফতর বিশেষ স্বস্তিতে নেই। বরং কলকাতা মেডিক্যালে এমএসের চালু আসন বাতিলের দৃষ্টান্ত তাঁদের ভাবনা বাড়িয়েছে। কী রকম? রাজ্যের স্বাস্থ্য-কর্তারা বলছেন, মেডিক্যাল কলেজগুলোয় চিকিৎসক-শিক্ষকের ঘাটতি তুঙ্গে। যেমন বাঁকুড়ায় মেডিসিন বিভাগে কোনও প্রফেসর নেই। উত্তরবঙ্গে ইএনটি, ফার্মাকোলজি, ফরেন্সিক মেডিসিনের পাঠ চলছে প্রফেসর ছাড়া, উপরন্তু সেখানকার গাইনির দুই প্রফেসর আপাতত কলকাতায় কর্মরত। মেদিনীপুরে অ্যানাটমির প্রফেসর নেই। এসএসকেএম ধুঁকছে গাইনি ও অ্যানেস্থেশিয়ার শিক্ষকের অভাবে। কলকাতা মেডিক্যালে আবার মেডিসিনের শিক্ষক বাড়ন্ত। এমতাবস্থায় এমসিআই যদি ফের পরিদর্শনে এসে স্নাতকোত্তরের আরও চালু আসন ছেঁটে দেয়, তা হলে সে ধাক্কা সামলানো যাবে না বলে মনে করছেন ওঁরা। এখন কী করণীয়, স্বাস্থ্য-কর্তারা আপাতত তারই উত্তর হাতড়াচ্ছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

md ms parijat bandyopadhyay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE