Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

কর্তাদের প্রচার-দ্বিধার মধ্যেই আজ বৈঠক মমতার

সতর্ক ও সচেতন করার জন্য প্রচার নেই এবং সেই উদাসীনতার ফাঁকেই সোয়াইন ফ্লু নিয়ে আতঙ্কের থাবা চেপে বসছে। অথচ এই মারণ রোগ নিয়ে প্রচার কতটা জরুরি এবং কাদের মধ্যে প্রচার চালানো জরুরি, সেই বিষয়ে কিছুটা দ্বিধাবিভক্ত রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তারাই। রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিব মলয় দে রবিবারেই জানান, তাঁরা সোয়াইন ফ্লু নিয়ে বেশি প্রচার বা সচেতনতা অভিযান চাইছেন না। কারণ, পরিস্থিতি মোটেই ততটা খারাপ হয়নি। বরং এই অবস্থায় সরকারি তরফে প্রচার চালালে মানুষ আরও বেশি আতঙ্কিত হয়ে পড়বেন।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:০৭
Share: Save:

সতর্ক ও সচেতন করার জন্য প্রচার নেই এবং সেই উদাসীনতার ফাঁকেই সোয়াইন ফ্লু নিয়ে আতঙ্কের থাবা চেপে বসছে। অথচ এই মারণ রোগ নিয়ে প্রচার কতটা জরুরি এবং কাদের মধ্যে প্রচার চালানো জরুরি, সেই বিষয়ে কিছুটা দ্বিধাবিভক্ত রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তারাই।

রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিব মলয় দে রবিবারেই জানান, তাঁরা সোয়াইন ফ্লু নিয়ে বেশি প্রচার বা সচেতনতা অভিযান চাইছেন না। কারণ, পরিস্থিতি মোটেই ততটা খারাপ হয়নি। বরং এই অবস্থায় সরকারি তরফে প্রচার চালালে মানুষ আরও বেশি আতঙ্কিত হয়ে পড়বেন। আমজনতার পরিবর্তে রোগের উপসর্গের ব্যাপারে চিকিৎসকদের সচেতনতা বাড়ানোর উপরে জোর দেন তিনি। সোমবার বিধানসভায় স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য অবশ্য মানুষকে সচেতন করার উপরেই জোর দিয়েছেন বেশি। নিজের নিজের এলাকায় সচেতনতার প্রচার চালাতে উদ্যোগী হওয়ার জন্য বিধায়কদের উদ্দেশেও আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

সন্ধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বিবৃতি দিয়ে সোয়াইন ফ্লু নিয়ে তাঁর উদ্বেগের কথা জানান। তিনি বলেন, “সোয়াইন ফ্লুয়ে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। এই ধরনের রোগ চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে আতঙ্কিত হওয়ার বদলে রোগ প্রতিরোধে কী করা উচিত, সেই ব্যাপারে আমাদের যতটা সম্ভব সচেতনতার প্রসার ঘটাতে হবে।” শুধু তা-ই নয়, রাজ্য সরকার যে বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েই দেখছে, তা বোঝাতে আজ, মঙ্গলবার নবান্নে স্বাস্থ্যকর্তাদের জরুরি বৈঠকে ডেকেছেন মুখ্যমন্ত্রী। স্বাস্থ্যসচিব, জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের অধিকর্তাও ওই বৈঠকে উপস্থিত থাকবেন। সেখানে সোয়াইন ফ্লু মোকাবিলায় মুখ্যমন্ত্রী নির্দিষ্ট নির্দেশ দিতে পারেন বলে স্বাস্থ্য ভবনের কর্তারা মনে করছেন।

গত বছর উত্তরবঙ্গে এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গ থাকা একটি রোগে ঠিক এ ভাবেই হস্তক্ষেপ করেছিলেন মমতা। ওই রোগ নিয়ে স্বাস্থ্য ভবনে এবং তাঁর দফতরে ঠিক তথ্য না-পাঠানো এবং কাজে গাফিলতির অভিযোগে বেশ কয়েক জন স্বাস্থ্যকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী। শুয়োর বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশও দেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে মুখ্যমন্ত্রী মঙ্গলবার হঠাৎ জরুরি বৈঠক ডাকায় স্বাস্থ্য ভবন উদ্বিগ্ন।

রবিবার স্বাস্থ্যসচিব প্রচারের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে চাননি কেন?

মলয়বাবু বলেন, “আমরা ট্রিটমেন্ট প্রোটোকল নিয়ে প্রচার চাইছি। কী কী উপসর্গ দেখে সোয়াইন ফ্লু চেনা যাবে, কোন ওষুধে চিকিৎসা হবে সবই ওয়েবসাইটে দিয়েছি। এই সচেতনতাটা মূলত চিকিৎসকদের জন্য। তাঁরা যদি উপসর্গ না-বোঝেন, তা হলে সমস্যা অনেক বেশি।”

উপসর্গ না-বুঝে অবশ্য শুধু চিকিৎসক নয়, বিভ্রান্তি বাড়ছে নানা মহলেই। মানুষ কোথায় গিয়ে জীবাণু পরীক্ষা করাবেন, কী কী উপসর্গ দেখে রোগ চিনবেন, সেই ব্যাপারে স্বাস্থ্য দফতর কোনও হাসপাতালেই কোনও নির্দেশিকা জারি করেনি। তাই মানুষের মধ্যে রোগটি নিয়ে নানা প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে। এক শ্রেণির ব্যবসায়ী বিভ্রান্ত মানুষের কাছে নিম্ন মানের মাস্ক বিক্রি করছেন বলে অভিযোগ। কলকাতার একটি পরীক্ষা কেন্দ্রে এ দিন তৃণমূল ছাত্র পরিষদ বা টিএমসিপি-র তরফে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের মধ্যে মাস্ক বিলি করতেও দেখা গিয়েছে।

রোগটি নিয়ে বিভ্রান্তি চরমে ওঠায় মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে স্বাস্থ্য দফতর এ দিন সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছে। সোয়াইন ফ্লু-র চিকিৎসা বিধি না-মানায় বেশ কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালকে শো-কজ করেছে তারা। ই এম বাইপাস, সল্টলেক, কাদাপাড়া এবং টিটাগড়ের ওই হাসপাতালগুলির বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেখানে ভর্তি একাধিক রোগীর সোয়াইন ফ্লু পরীক্ষার রিপোর্ট পজিটিভ হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের হাসপাতাল ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করানো হয়েছে। এই বিষয়ে স্বাস্থ্য দফতরকেও অন্ধকারে রেখেছে ওই সব হাসপাতাল।

“বেসরকারি হাসপাতালগুলো কখনওই এটা করতে পারে না। আইনত এবং নীতিগত ভাবে এটা সম্পূর্ণ অবৈধ। তাই ওদের শো-কজ করা হয়েছে,” বলেছেন স্বাস্থ্যসচিব। পরবর্তী সময়ে যেখানে পরীক্ষা করা হয়েছিল, সেই ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কলেরা অ্যান্ড এন্টেরিক ডিজিজেস (নাইসেড)-এ পাওয়া ঠিকানা ধরে ওই রোগীদের খুঁজে বার করেছে স্বাস্থ্য দফতর। তাঁদের মধ্যে এক জন ছাড়া বাকি সকলকে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে বলে স্বাস্থ্য দফতরের দাবি। স্বাস্থ্যসচিব জানিয়েছেন, এক রোগী চিকিৎসার জন্য স্বেচ্ছায় ভিন্ রাজ্যে গিয়েছেন।

অরুণকুমার দত্তগুপ্ত নামে বছর পঁচাত্তরের এক বৃদ্ধের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে মিন্টো পার্কের একটি নার্সিংহোমের বিরুদ্ধে কর্তব্যে গাফিলতির অভিযোগ উঠেছে। অরুণবাবুর আত্মীয় দেবব্রত দাশগুপ্ত জানান, ২১ ফেব্রুয়ারি বিকেলে তাঁদের আপত্তি সত্ত্বেও অরুণবাবুকে ওই নার্সিংহোম জোর করে অ্যাম্বুল্যান্সে তুলে আইডি-তে পাঠানোর ব্যবস্থা করছিল। সেই সময় অ্যাম্বুল্যান্সেই তাঁর মৃত্যু হয়। কেন ওখানেই চিকিৎসা না-করে তাঁকে আইডি-তে পাঠানো হচ্ছিল, সেই প্রশ্ন উঠেছে। যদিও দেবব্রতবাবুরা স্বাস্থ্য দফতরের কাছে লিখিত ভাবে কোনও অভিযোগ দায়ের করেননি।

বাংলায় সোয়াইন ফ্লু পরিস্থিতি নিয়ে তিনি জরুরি বৈঠক ডেকেছেন ঠিকই। তবে অন্যান্য রাজ্যে রোগটি যে-মারাত্মক চেহারা নিয়েছে, তার তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা অনেক ভাল বলে নিজের বিবৃতিতে মন্তব্য করেছেন মুখ্যমন্ত্রী।

মমতা জানান, চলতি বছর গোটা দেশে এখনও পর্যন্ত সোয়াইন ফ্লুয়ে ৮৩৩ জন মারা গিয়েছেন। এর মধ্যে রাজস্থানে ২১৪, গুজরাতে ২০৭, মধ্যপ্রদেশে ১১২, মহারাষ্ট্রে ৯৯, তেলঙ্গানায় ৫১, কর্নাটকে ৩৩, হরিয়ানায় ২০, অন্ধ্রে ১০ এবং দিল্লিতে আট জন মারা গিয়েছেন। “সব চেষ্টা এবং ওষুধের ব্যবস্থা করা সত্ত্বেও আমাদের রাজ্যে পাঁচ জন মারা গিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে এক জন মুম্বইয়ের বাসিন্দা। এই সময় কেন্দ্র, রাজ্য, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলিকে একসঙ্গে প্রয়োজনীয় সব রকম ব্যবস্থা নিতে হবে,” বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী।

এ দিন শহরে থুতু পরীক্ষা করে আরও দু’জনের সোয়াইন ফ্লু ভাইরাস ধরা পড়েছে। দু’জনেই শহরের দু’টি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি। রাজ্যে এই নিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ৬৯। এর মধ্যে ৩৯ জনকে ইতিমধ্যেই চিকিৎসার পরে ছুটি দেওয়া হয়েছে।

সোয়াইন ফ্লু নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ও স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর উদ্বেগের পরেও কলকাতা পুরসভায় কিন্তু হেলদোল দেখা যাচ্ছে না। “কলকাতায় সোয়াইন ফ্লু নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কোনও কারণ নেই,” বলছেন মেয়র-পারিষদ (স্বাস্থ্য) অতীন ঘোষ।

সোয়াইন ফ্লু নিয়ে আগাম সতর্কতা ত্রিপুরায়

ত্রিপুরায় এখনও পর্যন্ত সোয়াইন ফ্লু আক্রান্ত রোগীর সন্ধান না পাওয়া গেলেও, রাজ্যে এই রোগের সংক্রমণ রোধে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বাদল চৌধুরী জানান, ‘‘সোয়াইন ফ্লু-আক্রান্ত কোনও রোগীর সন্ধান এখনও এখানে পাওয়া যায়নি। কিন্তু বাইরের রাজ্য থেকে, বিশেষ করে উত্তর-পূর্বের অন্য রাজ্য বা দিল্লি, পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা মানুষের উপরে নজর রাখা হচ্ছে।’’ নজরদারির জন্য আগরতলা বিমানবন্দর এবং চুড়াইবাড়িতে দু’টি মেডিক্যাল টিম রাখা হয়েছে। বাইরে থেকে আসা সম্ভাব্য রোগীদের তারা চিহ্নিত করবে। এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এ ছাড়াও, সোয়াইন ফ্লু আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য চিকিৎসক ও চিকিৎসা-কর্মীদের বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে স্বাস্থ্য দফতর। জেলার সব হাসপাতালে প্রয়োজনীয় নির্দেশিকাও পাঠানো হয়েছে বলে বাদলবাবু জানান। প্রয়োজনী ওষুধও মজুত করা হয়েছে। সোয়াইন ফ্লু-র চিকিৎসার জন্য ‘নোডাল হাসপাতাল’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে আগরতলার সরকারি জিবি হাসপাতালকে। পড়শি রাষ্ট্র বাংলাদেশের ৮৫৬ কিমি সীমান্ত দিয়ে ঘেরা ত্রিপুরা। স্বভাবতই যাঁরা এ রাজ্যে ঢুকছেন, তাঁদের উপরও নজর রাখা হবে বলে মন্ত্রী জানান। কেন্দ্রের হিসেব অনুযায়ী, সারা দেশে সোয়াইনফ্লুয়ে আরও ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে। রবিবার পর্যন্ত পাওয়া হিসেবে এইচ১এন১ ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ১৪ হাজারের গণ্ডি ছাড়িয়েছে। এই মারণ-জ্বরের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি রাজস্থানে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE