Advertisement
০৪ মে ২০২৪

ঠেলা দিল্লির, যক্ষ্মা রোগিণীর চিকিৎসায় নড়ে বসল রাজ্য

ই-মেলে আসা একটি অভিযোগ এবং এক ঘণ্টার মধ্যে তার সমাধান! পশ্চিমবঙ্গের এক যক্ষ্মা রোগিণীর চিকিৎসায় এমনই তৎপরতা দেখাল দিল্লির স্বাস্থ্য মন্ত্রক। কারণ, যে ধরনের যক্ষ্মা নিয়ে অভিযোগ, সেই ‘মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট’ (এমডিআর) যক্ষ্মায় বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট করলে ওই রোগের সংক্রমণ ঘটতে পারে আরও অনেকের মধ্যে। প্রচলিত কোনও ওষুধে এই যক্ষ্মা সারানোও যাবে না। অথচ দিল্লি তৎপর হয়ে ওঠার আগে পর্যন্ত রাজ্যের সরকারি হাসপাতালে ওই রোগিণীর পরিবারকে চূড়ান্ত অসহযোগিতার মুখে পড়তে হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ মার্চ ২০১৫ ০৩:২৪
Share: Save:

ই-মেলে আসা একটি অভিযোগ এবং এক ঘণ্টার মধ্যে তার সমাধান!

পশ্চিমবঙ্গের এক যক্ষ্মা রোগিণীর চিকিৎসায় এমনই তৎপরতা দেখাল দিল্লির স্বাস্থ্য মন্ত্রক। কারণ, যে ধরনের যক্ষ্মা নিয়ে অভিযোগ, সেই ‘মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট’ (এমডিআর) যক্ষ্মায় বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট করলে ওই রোগের সংক্রমণ ঘটতে পারে আরও অনেকের মধ্যে। প্রচলিত কোনও ওষুধে এই যক্ষ্মা সারানোও যাবে না। অথচ দিল্লি তৎপর হয়ে ওঠার আগে পর্যন্ত রাজ্যের সরকারি হাসপাতালে ওই রোগিণীর পরিবারকে চূড়ান্ত অসহযোগিতার মুখে পড়তে হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

বছর চব্বিশের ওই রোগিণীর নাম জুলি কুমারী। বাড়ি আসানসোলের ধাদকা অঞ্চলে। তাঁর দাদা অনিলকুমার বর্মা জানান, গত নভেম্বরে যক্ষ্মা ধরা পড়েছিল জুলির। আসানসোল হাসপাতালের চিকিৎসক শুভজিৎ দত্তের প্রাইভেট চেম্বারে তাঁর চিকিৎসা চলছিল। অবস্থার অবনতি হওয়ায় গত ১৭ ফেব্রুয়ারি জুলিকে আসানসোল জেলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ওই হাসপাতালে জুলির কফ পরীক্ষা না করেই তাঁর ‘মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট যক্ষ্মা’ হয়েছে বলে মৌখিক ভাবে জানিয়ে দেন চিকিৎসকেরা। বলা হয়, এর চিকিৎসা আসানসোলে হবে না। তাই ১৮ ফেব্রুয়ারি জুলিকে লিখিত ভাবে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে রেফার করা হয়। কিন্তু বর্ধমানও জুলিকে ভর্তি নেয় না। রোগিণীকে নিয়ে তাঁরা কোথায় যাবেন, তাঁকে ভর্তি করা আদৌ কতটা জরুরি, কোথায় কফ পরীক্ষা করা যাবে এ সব ব্যাপারে জানতে চাইলে বর্ধমান মেডিক্যালের চিকিৎসকেরা সহযোগিতার বদলে তাঁদের বিভ্রান্তই করেছেন বলে অভিযোগ অনিলবাবুর।

দিশেহারা হয়ে ১৯ ফেব্রুয়ারি দিল্লিতে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের যক্ষ্মা বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল রাধেশ্যাম গুপ্তকে ই-মেল করেন অনিলবাবু। এর এক ঘণ্টার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করে জুলির চিকিৎসার সমস্ত ব্যবস্থা করে দিল্লি। স্পষ্ট হয়ে যায় দিল্লি ও পশ্চিমবঙ্গে স্বাস্থ্যক্ষেত্রের কর্মসংস্কৃতির দুই ভিন্ন চিত্র।

অনিলবাবুর অভিযোগের ই-মেলটি দিল্লিতে রাধেশ্যাম গুপ্তর কাছে পৌঁছেছিল ১৯ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৪টে বেজে ৪ মিনিটে। আর ওই দিনই বিকেল ৫টা বেজে ৬ মিনিটে স্বাস্থ্য মন্ত্রকের যক্ষ্মা বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেলের কাছ থেকে ই-মেল চলে আসে সল্টলেকের স্বাস্থ্য ভবনে স্টেট টিউবারকিউলোসিস অফিসার শান্তনু হালদারের কাছে। মেল-এ বলা ছিল কেন কফ পরীক্ষা ছাড়াই রোগিণীর এমডিআর যক্ষ্মা হয়েছে বলে জানানো হল? যদি তা-ই হয়ে থাকে, তা হলে কেন রোগিণীকে বর্ধমান মেডিক্যালে ভর্তি নেওয়া হল না? যদি ভর্তির দরকারই না থাকে, তা হলে কেন আসানসোল থেকে রেফার করা হল? রোগিণী কোথায় কফ পরীক্ষা করাবেন, সেটা কেন কেউ যথাযথ ভাবে জানালেন না? সেই সঙ্গে চিঠিতে নির্দেশ দেওয়া হয়, রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর যেন এই রোগিণী ও তাঁর পরিবারকে সব রকম সহযোগিতা করে।

দিল্লির ই-মেল পাওয়ার পরেই স্বাস্থ্য ভবনের যক্ষ্মা বিভাগে শোরগোল পড়ে যায়। অফিসারেরা তখন বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। সব মাথায় ওঠে। আসানসোল ও বর্ধমানে ফোন শুরু হয়। জুলির এমডিআর যক্ষ্মা আছে কি না, তা জানতে আসানসোল হাসপাতালেই তাঁর কফের নমুনা সংগ্রহ করে কলকাতায় পাঠানো হয়। নমুনা পাঠানোর ২২ দিন বাদে রিপোর্ট আসবে। আপাতত বাড়িতেই রয়েছেন জুলি। হাসপাতাল থেকে তাঁর ওষুধের ব্যবস্থা হয়েছে। তাঁর দাদা অনিল জানিয়েছেন, আগে যতটা খারাপ ব্যবহার তাঁদের সঙ্গে করা হয়েছিল, এখন ততটাই ভাল ব্যবহার করা হচ্ছে!

রাধেশ্যাম গুপ্তের কথায়, “আমাদের হাতে নষ্ট করার মতো সময় নেই। ভারতে নতুন যক্ষ্মা রোগীদের ২ থেকে ৩ শতাংশ এমডিআর যক্ষ্মায় আক্রান্ত। আর যত যক্ষ্মা রোগী দ্বিতীয় বার রোগাক্রান্ত হয়ে ফিরছেন, তাঁদের ১৫ শতাংশের দেহে এমডিআর যক্ষ্মা পাওয়া যাচ্ছে। এই অবস্থায় কোনও গড়িমসি, অবহেলা বরদাস্ত করা হবে না। তা হলে আরও বেশি করে এমডিআর যক্ষ্মা ছড়ানোর পথ প্রশস্ত হবে। রাজ্যগুলিকে আমরা সেই বার্তাই দিচ্ছি।”

প্রশ্ন উঠেছে, কেন এই টনক নড়ার জন্য দিল্লির হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হল? স্বাস্থ্য মন্ত্রক সক্রিয় হল বলে জুলি না হয় সঠিক চিকিৎসা পেলেন, কিন্তু তাঁর মতো আরও যাঁরা রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় রয়েছেন, তাঁদের সহযোগিতা বা চিকিৎসার ব্যবস্থা করার কাজটা রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর কতটা করছে? যক্ষ্মার চিকিৎসায় গাফিলতির জন্য এখনও পর্যন্ত কত জন চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মী শাস্তি পেয়েছেন?

যাঁর চেম্বারে প্রথমে জুলির চিকিৎসা চলছিল এবং আসানসোল হাসপাতালেও যিনি তাঁর চিকিৎসার অন্যতম প্রধান দায়িত্বে ছিলেন সেই শুভজিৎ দত্তকে প্রশ্ন করা হয়, কফ পরীক্ষা না করেই কী ভাবে এমডিআর রোগিণী বলে জুলিকে বর্ধমানে পাঠিয়ে দেওয়া হল? আসানসোল হাসপাতালেই যে এই ধরনের রোগীর কফ সংগ্রহ করে কলকাতায় পরীক্ষায় পাঠানোর ব্যবস্থা রয়েছে, সেটা কেন আগে জানানো হল না? শুভজিৎবাবুর উত্তর, “আমি টিবি বিশেষজ্ঞ নই যে অত জানব।”

যা শুনে স্তম্ভিত প্রখ্যাত বক্ষ চিকিৎসক পার্থসারথি ভট্টাচার্য। তাঁর কথায়, “এই ভাবে যথাযথ পরামর্শ না পেয়েই বহু যক্ষ্মা রোগী মাঝপথে চিকিৎসা ছেড়ে দেন। তাতে আমাদের চারপাশে মারাত্মক ভাবে এমডিআর যক্ষ্মা বাড়ছে।”

গোটা ঘটনায় অস্বস্তিতে পড়েছেন রাজ্যের যক্ষ্মা অফিসার শান্তনু হালদার। তাঁর মতে, ২০১২ সালে রাজ্যে সরকারি ভাবে ৭১৯ জন এমডিআর যক্ষ্মা রোগীর চিকিৎসা হয়েছিল। ২০১৪-তে তা বেড়ে হয়েছে ১৮০৪! এই পরিস্থিতিতেও যদি চিকিৎসকেরা এই রকম গাফিলতি দেখান এবং রোগীকে চিকিৎসার ব্যাপারে সঠিক পন্থা না বাতলান তা হলে কিছু বলার নেই। তাঁর কথায়, “আমি দিল্লির চিঠি পাওয়া মাত্র ব্যবস্থা নিয়েছি। সমস্ত রিপোর্টও চেয়ে পাঠিয়েছি। দোষীদের উপযুক্ত শাস্তি হবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE