Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

দাম কমানোর ফরমান শুনেই উধাও জীবনদায়ী

অসহায় ভাবে উনি কেঁদে যাচ্ছেন। সান্ত্বনা দিচ্ছেন যাঁরা, তাঁদেরও মুখ উদ্বেগে কালো। সোমবার সকালে এসএসকেএম চত্বরে কান্নায় ভেঙে পড়া যুবকটির বাবা সিরোসিস অফ লিভারে আক্রান্ত। গত দু’মাস ধরে ডাক্তারেরা বলছেন একটা ওষুধ জোগাড় করতে। কিন্তু কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। “স্রেফ একটা ওষুধের অভাবে বাবার প্রাণটা চলে যাবে?” আকুল প্রশ্ন সন্তানের। বাইপাসের বেসরকারি হাসপাতালের রিসেপশনে বসে থাকা তরুণীরও এক প্রশ্ন।

সোমা মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০২:৫২
Share: Save:

অসহায় ভাবে উনি কেঁদে যাচ্ছেন। সান্ত্বনা দিচ্ছেন যাঁরা, তাঁদেরও মুখ উদ্বেগে কালো।

সোমবার সকালে এসএসকেএম চত্বরে কান্নায় ভেঙে পড়া যুবকটির বাবা সিরোসিস অফ লিভারে আক্রান্ত। গত দু’মাস ধরে ডাক্তারেরা বলছেন একটা ওষুধ জোগাড় করতে। কিন্তু কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। “স্রেফ একটা ওষুধের অভাবে বাবার প্রাণটা চলে যাবে?” আকুল প্রশ্ন সন্তানের।

বাইপাসের বেসরকারি হাসপাতালের রিসেপশনে বসে থাকা তরুণীরও এক প্রশ্ন। তাঁর মায়ের একটা কিডনি বাদ গিয়েছে। একটা জরুরি ওষুধ কিছুতেই মিলছে না। ফলে আরোগ্যলাভ অনিশ্চিত। এমআর বাঙুর হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের সামনে দাঁড়ানো যে প্রৌঢ়ের স্ত্রী ৫৫% পুড়ে যাওয়া অবস্থায় ভর্তি, তিনিও কিংকর্তব্যবিমূঢ়। অগ্নিদগ্ধের চিকিৎসায় অতি প্রয়োজনীয় ওষুধটি তিনি শহর ঢুঁড়েও খুঁজে পাননি!

ওঁরা সকলে একটি বিশেষ ওষুধের জন্য হাহাকার করছেন। এবং শুধু কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গ নয়, এই মুহূর্তে গোটা দেশেই তা অমিল। ওষুধটির নাম হিউম্যান অ্যালবুমিন সিরাম। জীবনদায়ী হিসেবে চিকিৎসক মহলে যার সম্যক পরিচিতি। এমন একটা জিনিস উধাও হয়ে গেল কেন?

কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক সূত্রের খবর, জীবনদায়ী ওষুধের দাম বেঁধে দেওয়ার লক্ষ্যে মূল্য নির্ধারক সংস্থা ‘ন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল প্রাইসিং অথরিটি’ (এনপিপিএ) যে নির্দেশ জারি করেছিল, তার জেরেই সঙ্কটের সৃষ্টি। বিষয়টি নিয়ে আগামী সপ্তাহে জরুরি বৈঠক ডেকেছে কেন্দ্র। বৈঠক অবশ্য আগেও হয়েছে। কিন্তু কোনও সমাধানসূত্র বেরোয়নি। তাই চিকিৎসকেরা এ বারের বৈঠকের পরিণতি সম্পর্কেও বিশেষ আশাবাদী হতে পারছেন না।

হিউম্যান অ্যালবুমিন আদতে রক্তের প্লাজমার এক জাতীয় প্রোটিন। তৈরি হয় মূলত লিভারে। লিভারে ক্যানসার হলে, কিডনি বিকল হলে কিংবা পুড়ে গেলে শরীরে এর উৎপাদন খুব কমে যায়। অপুষ্টির শিকার হলেও তা-ই। অথচ যে কোনও ওষুধকে রক্তে মিশিয়ে কাজ শুরু করানোর জন্য অ্যালবুমিন সিরাম একান্ত প্রয়োজন। বিশেষত কিডনি বা লিভার প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে এর বিকল্প নেই।

এখন বাজারে ওষুধটি অমিল হওয়ায় আক্ষরিক অর্থেই হাহাকার পড়ে গিয়েছে। বহু হাসপাতালে লিভার ও কিডনি প্রতিস্থাপন ধাক্কা খাচ্ছে। অকূল-পাথারে পড়ছেন রোগীর পরিজনেরা। ডাক্তারবাবুরা অসহায়। এসএসকেএমের স্কুল অফ লিভার ডিজিজ-এর চিকিৎসক অভিজিৎ চৌধুরীর কথায়, “বছরখানেক হল, সমস্যাটা শুরু হয়েছে। গত মাস তিনেক ভয়াবহ অবস্থা। রোগীর বাড়ির লোককে আমরা কোনও ভরসা দিতে পারছি না।” ওষুধ-ব্যবসায়ীরা কী বলছেন?

পশ্চিমবঙ্গের ওষুধ বিক্রেতা সংগঠন ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট অ্যাসোসিয়েশন’-এর কর্তারাও দিশা দিতে পারছেন না। সংগঠনের তরফে তুষার চক্রবর্তীর প্রতিক্রিয়া, “ভাবতে অবাক লাগে, এমন একটা জীবনদায়ী ওষুধ মাসের পর মাস পাওয়া যাচ্ছে না! দাম বাঁধতে গিয়ে ওষুধটাই নাগালের বাইরে চলে গেল! কিছু আর বলার নেই।” আগে থেকে মজুত করে রাখা কিছু সিরাম বহু গুণ দামে বিকোচ্ছে বলে অভিযোগও শোনা যাচ্ছে।

সব মিলিয়ে রোগী ও চিকিৎসক, দুই তরফেই চরম বিভ্রান্তি ও হতাশা। বাইপাসের এক হাসপাতালের এক ডাক্তারের আক্ষেপ, “লিভার ট্রান্সপ্লান্টেশনে ১০ থেকে ৩০ ইউনিট হিউম্যান অ্যালবুমিন লাগে। আমরা এক ইউনিটও জোগাড় করতে পারছি না। বাধ্য হয়ে অপারেশন বন্ধ রাখতে হয়েছে।” এ দিকে অবিলম্বে অস্ত্রোপচার না-হলে মারা যাবেন, এমন রোগীও কম নেই। তাঁদের অস্ত্রোপচার হচ্ছে বটে, কিন্তু সাফল্য সম্পর্কে যথেষ্ট সংশয়। “কারণ হিউম্যান অ্যালবুমিন ছাড়া প্রতিস্থাপন ব্যর্থ হওয়ার ঝুঁকি ষোলো আনা।” মন্তব্য ওই চিকিৎসকের।

আগে হিউম্যান অ্যালবুমিনের এক-একটা ভায়ালের দাম পড়ত প্রায় ছ’হাজার টাকা। ২০১৩-য় এনপিপিএ-র নির্দেশিকা মোতাবেক তা কমে হয়েছে দেড় হাজারের কাছাকাছি। তার পরেই সেটি নিরুদ্দেশের দিকে পা বাড়িয়েছে। প্রস্তুতকারী এক সংস্থার সূত্রের বক্তব্য, “যে কোনও ওষুধ তৈরি ও বাজারজাত করতে বিস্তর ঝক্কি পোহাতে হয়। আচমকা দাম কমিয়ে দিলে প্রস্তুতকারীরা বেকায়দায় পড়ে। সাধারণ অর্থনীতির নিয়মেই উৎপাদন মার খায়।”

এবং এ ক্ষেত্রে তা-ই হয়েছে বলে সূত্রটির ইঙ্গিত। কিন্তু একটা জীবনদায়ী ওষুধ কি এ ভাবে রাতারাতি বাজার থেকে তুলে নেওয়া যায়?

পশ্চিমবঙ্গের ড্রাগ কন্ট্রোলার চিন্তামণি ঘোষের জবাব, “কোনও ভাবেই যায় না। কেন্দ্রীয় ড্রাগ কন্ট্রোলার জেনারেলের তরফে এ দিকে নজর রাখার কথা। কেননা ওষুধ কোম্পানিগুলোকে তারাই লাইসেন্স দেয়।” কেন্দ্রীয় ড্রাগ কন্ট্রোলের এক আধিকারিক সমস্যার কথা স্বীকার করে নিয়ে বলেন “কোম্পানিগুলোর যুক্তি, তাদের উৎপাদন কম হচ্ছে। ওদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, প্রয়োজনের তুলনায় উৎপাদন যেন ঠিকঠাক থাকে।”

কিন্তু নির্দেশ ঠিকঠাক কার্যকর হচ্ছে কি না, সে দিকে নজরদারি থাকবে তো?

কেন্দ্রীয় ড্রাগ কন্ট্রোলের কর্তাটির আশ্বাস, “একটা সংস্থা আগে কত উৎপাদন করত, আর দাম কমার পরে কত করছে, তা যাচাই করা হচ্ছে। সরকার প্রয়োজনে কড়া পদক্ষেপ করবে।”

আশ্বাসে বুক বাঁধা ছাড়া উপায় কী?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

human albumin serum soma mukhopadhyay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE