সকাল ১০টা ১০। বিএমওএইচের ঘর ফাঁকা।
বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা। বনগাঁ ব্লকের সুন্দরপুর ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেল, অফিস খোলার কাজ করছেন চতুর্থ শ্রেণির এক কর্মী ও একজন নার্স। বিএমওএইচ জয়িতা মুৎসুদ্দি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ছিলেন না। বহির্বিভাগে কয়েক জন রোগী অবশ্য এসে পড়েছিলেন। বিএমওএইচ কোথায়? জানতে চাওয়া হলে চতুর্থ শ্রেণির ওই কর্মী জানালেন, তিনি প্রশাসনিক কাজে জেলায় বৈঠকে গিয়েছেন। আজ আসবেন না। জানা গেল মহুয়া সাহা নামে একজন চিকিৎসক আসবেন বহির্বিভাগে রোগী দেখতে। কিন্তু কোথায় তিনি? ঘড়ির কাঁটা সাড়ে ১০টা পেরিয়েছে। তখনও চিকিৎসকের দেখা নেই। বাসিন্দারা জানালেন, সকাল ১১টা-সাড়ে ১১টার আগে বহির্বিভাগে রোগী দেখা শুরু হবে, এমন রেওয়াজই নেই এখানে।
একটু ভুল হল, রোগী দেখা শুরু হয়। তবে রোগী দেখেন চতুর্থ শ্রেণির কর্মী, ফার্মাসিস্টস বা নার্স। এটাই দস্তুর। সাধারণ গ্রামবাসীরা মোটামুটি অভ্যস্ত এ সবের সঙ্গে। ফলে বেশির ভাগই দেরি করে বাড়ি থেকে বেরোন। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এখন এক জন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী, এক জন ফার্মাসিস্ট, দুই জন নার্স আছেন। এ দিন অবশ্য ফার্মাসিস্ট ছিলেন না। দু’জন নার্সের এক জন ছিলেন ছুটিতে।
ঘড়িতে তখন সকাল ১০টা ৫৩ মিনিট। পৌঁছলেন চিকিৎসক মহুয়া সাহা। এসেই অবশ্য রোগী দেখা শুরু করলেন। একটু দেরি হয়ে গেল না ম্যাডাম? মহুয়াদেবী বললেন, “দমদম ক্যান্টনমেন্ট থেকে আসি। সাত সকালে বেরিয়েও আসতে একটু দেরি হয়।”
পাশের রাউতারা গ্রাম থেকে এসেছিলেন বৃদ্ধা সাহারানা মণ্ডল। তিনি বললেন, “প্রেসার বেশি। তাই ডাক্তার দেখাতে এসেছি। কিছু ক্ষণ অপেক্ষা করতে হলেও কাজ হয়েছে।” বেলা আড়াইটের পরে অবশ্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কোনও চিকিৎসককে পাওয়া যায় না বলেই জানালেন গ্রামবাসীরা। কিন্তু তখন পরিষেবা পাওয়া যায় না ভাবলে ভুল হবে। চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ও নার্স একজন থাকেন। তাঁরাই চিকিৎসা করেন।
স্বাস্থ্যকেন্দ্র সূত্রের খবর, প্রতি সপ্তাহে সোমবার থেকে শনিবার পর্যন্ত এখানে বহির্বিভাগে রোগী দেখা হয়। বিএমওএইচ ছাড়াও মহুয়া সাহা, অনুপম সাহা, বিধানচন্দ্র রায়ের মতো কয়েকজন চিকিৎসক এখানে আসেন কোনও না কোনও না দিন। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের গায়ে বড় বড় করে লেখা আছে, প্রতি মঙ্গলবার বেলা ১২টা থেকে এখানে আর্সেনিক ক্লিনিক হয়। বাস্তবে অবশ্য মানুষ তা দেখতে পান না। দৈনিক গড়ে শ’খানেক রোগী বহির্বিভাগে আসেন। তবে সকলেই প্রায় আসেন সাড়ে ১১টার পরে। কর্মরত চতুর্থ শ্রেণির কর্মী মানুষের কাছে এতটাই ভরসার যে তাঁকে বদলি করা হবে জেনে গ্রামবাসীদের একাংশ আন্দোলন পর্যন্ত করেছিলেন। ওই কর্মী সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকেন।
স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পাঁচিলে শুকোতে দেওয়া হচ্ছে পাট।
এই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি স্থানীয় পাটশিমুলিয়া গ্রামে অবস্থিত। কিন্তু নামেই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। বাস্তবে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কোনও সুযোগ-সুবিধাই এখানে মেলে না বলে অভিযোগ। অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা নেই। নরম্যাল ডেলিভারিও হয় না। এক্স-রে সহ অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা নেই।
রোগী ভর্তি তো দূরের কথা। স্বাধীনতার কাছাকাছি কোনও সময়ে তৈরি হয়েছিল স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি। প্রাথমিক অবস্থায় এখানে রোগী ভর্তির ব্যবস্থা ছিল। চিকিৎসকেরা স্বাস্থ্যকেন্দ্র চত্বরের কোয়ার্টারে থাকতেন। পরে তাঁদের থাকাও বন্ধ হয়ে যায়। পুরনো জরাজীর্ণ ভবন মেরামত করে ২০০৬ সালে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নতুন ভবন তৈরি করা হয়। স্বাস্থ্য দফতরের পক্ষ থেকে ওই সময়ে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, রোগী ভর্তির জন্য ১৫টি শয্যার ব্যবস্থা হবে। ২৪ ঘণ্টা ডাক্তার থাকবেন। কিন্তু সে সবের কিছুই এখনও হয়ে ওঠেনি। ফলে চিকিৎসা পরিষেবা নিয়ে বাসিন্দাদের ক্ষোভ দীর্ঘদিনের।
পাটশিমুলিয়া, সুটিয়া, বাগলানি, সুন্দরপুর, পেটাঙ্গি-সহ বানগাঁ ও বাগদা বিধানসভার প্রায় তিরিশটি গ্রামের মানুষ ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের উপরে নির্ভরশীল। বতর্মানে মামুলি কিছু অসুখের চিকিৎসা ছাড়া কিছুই হয় না। গ্রামীণ এলাকা, অথচ সাপ ও কুকুরে কামড়ানোর প্রতিষেধক মেলে না। রাতে প্রসূতিদের বা অন্য রোগীকে এলাকার মানুষকে অটো বা অন্য কোনও যানবাহনে করে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে বনগাঁ মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যান।
স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সামনে যাত্রী প্রতীক্ষালয় রয়েছে। অভিযোগ, সন্ধ্যার পরেই স্থানীয় ও বাইরের যুবকেরা মোটর বাইকে করে এসে এখানে এসে মদ-গাঁজার আসর বসায়। চিৎকার-চেঁচামেচি করে। শৌচাগার আবর্জনায় ভরে গিয়েছে। নতুন ভবনের গায়েও শ্যাওলা জমেছে। জানালার কাচ ভাঙা। বিএমওএইচ নিয়মিত আসেন না বলেও অভিযোগ। তবে এখন কিছু সময়ের জন্য হলেও চিকিৎসক পাওয়ায় এলাকার মানুষ কিছুটা স্বস্তিতে। অতীতে তাঁরা পরিকাঠামো উন্নতির দাবিতে আন্দোলন করলেও এখন আর কিছু বলেন না। যেন ভবিতব্যই ধরে নিয়েছেন।
বিএমওএইচের সঙ্গে অবশ্য সারা দিন মোবাইলে বহু বার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও ফোন স্যুইচড অফ ছিল। উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পরিষদের সভাধিপতি রহিমা মণ্ডল বলেন, “ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসা পরিষেবা উন্নতির জন্য জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিককে বলা হয়েছে।” স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দশার জন্য বিএমওএইচকেও কিছুটা এর জন্য দায়ী করেছেন তিনি। জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক প্রলয়কুমার আচার্য বলেন, “বিএমওএইচকে বদলির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শীঘ্রই তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হবে।” তবে তিনি জানিয়েছেন, বনগাঁ ব্লকের গাঁড়াপোতা এলাকায় একটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র নতুন করে তৈরি করা হবে উন্নতমানের পরিষেবার জন্য। সুন্দরপুরের স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি নিয়ে স্বাস্থ্য দফতরের বিশেষ কিছু ভাবনা-চিন্তা নেই জেনে হতাশ এলাকার মানুষ।
ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy