গত বছর এনসেফ্যালাইটিসের প্রকোপের সময় উত্তরবঙ্গের তিন স্বাস্থ্যকর্তাকে সাসপেন্ড করা হয়েছিল। এ বার সেই উত্তরবঙ্গেই সোয়াইন ফ্লু-র দাপটের মুখে বদলি করা হল এক জেলা স্বাস্থ্যকর্তা এবং একটি হাসপাতালের সুপারকে। সোয়াইন ফ্লু প্রতিরোধ ও সতর্কতা-সচেতনতা নিয়ে বিতর্কের মধ্যে এ ভাবেই এনসেফ্যালাইটিস কাণ্ডের ছায়া দেখতে পাচ্ছেন উত্তরবঙ্গের স্বাস্থ্যকর্তাদের একাংশ। রোগ নিয়ে উদ্বেগের মধ্যেই চাকরি ঘিরে তাঁরা দেখছেন সিঁদুরে মেঘ।
স্বাস্থ্য দফতর গত বছর উত্তরবঙ্গের তিন স্বাস্থ্যকর্তাকে সাসপেন্ড করেছিল এনসেফ্যালাইটিস ছড়িয়ে পড়ার খবর স্বাস্থ্য ভবনকে সময়মতো না-দেওয়ার অভিযোগে। তাঁদের মধ্যে জলপাইগুড়ির তৎকালীন মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকও ছিলেন। এ বার সোয়াইন ফ্লুয়ে আক্রান্ত হওয়ার পরেও দুই চিকিৎসক কী ভাবে ওয়ার্ডে কাজ চালিয়ে গেলেন, তা নিয়ে জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতালের সুপার পার্থ দে-কে বৃহস্পতিবার শো-কজ করে স্বাস্থ্য দফতর। তার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে, শুক্রবার পার্থবাবু এবং জেলার অতিরিক্ত মুখ্য স্বাস্থ্য অধিকর্তা গৌতম মণ্ডলকে বদলি করা হয়েছে। পার্থবাবুকে পাঠানো হয়েছে নদিয়ায় আর গৌতমবাবুকে উত্তর দিনাজপুরে।
স্বাস্থ্য দফতর অবশ্য দু’বছরের দু’টি ঘটনার মধ্যে মিল খুঁজতে যাওয়া অর্থহীন বলে মনে করছে। রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর দাবি, “সোয়াইন ফ্লুয়ের সঙ্গে ওই দু’জনের বদলির কোনও সম্পর্ক নেই। এগুলি নিছকই রুটিনমাফিক বদলি। পার্থবাবু ও গৌতমবাবু দীর্ঘদিন ধরেই বদলি চাইছিলেন। তাই ওঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হল, এটা ভাবা ভুল হবে।”
জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক প্রকাশ মৃধাও বলেন, “সুপারের স্ত্রী, ছেলেমেয়ে গঙ্গার ও-পারে থাকেন। উনি ডিসেম্বর থেকে বদলি চেয়েছিলেন। সেটা হয়েছে। আর গৌতমবাবুর বদলিও রুটিন।”
কিন্তু উত্তরবঙ্গে চিকিৎসকদের একটা বড় অংশ একে শাস্তি হিসেবেই দেখছেন। একাধিক চিকিৎসক মন্তব্য করেছেন, “ওঁরা অনেক দিন ধরে বদলি চাইছিলেন বলা হচ্ছে। কিন্তু ঠিক শো-কজের পরের দিন সেই বদলির আর্জি মঞ্জুর হওয়াটা চোখে লাগছে।”
জলপাইগুড়িতে দুই চিকিৎসকের সোয়াইন ফ্লুয়ে আক্রান্ত হওয়া, সেই অবস্থায় কাজ করা এবং পরে সরকারি পদক্ষেপ নিয়ে বিতর্ক চলছেই। সরকারি নির্দেশিকা অনুযায়ী কোনও রোগীর কফ-থুতু পরীক্ষার জন্য পাঠানোর আগে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়। জলপাইগুড়ি হাসপাতালের দুই চিকিৎসকের ক্ষেত্রে সেই নিয়ম মানা হল না কেন, সেই প্রশ্ন উঠেছে।
কেন্দ্রের নির্দেশিকা অনুযায়ী সোয়াইন ফ্লু-র উপসর্গকে ‘এ’, ‘বি’ এবং ‘সি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এ এবং বি শ্রেণিভুক্ত উপসর্গ মামুলি বলে ধরা হয়। এ ক্ষেত্রে সোয়াইন ফ্লু-র সংক্রমণ ঘটেছে কি না, তার জন্য পরীক্ষার প্রয়োজন নেই বলে জানাচ্ছে নির্দেশিকা। কিছু ক্ষেত্রে রোগীকে হাসপাতালেও ভর্তি করার প্রয়োজন হয় না। সংক্রমণের ওষুধেই রোগ সেরে যায়। মামুলি উপসর্গের ক্ষেত্রে পরীক্ষা এবং হাসপাতালে ভর্তি করালে অযথা আতঙ্ক ছড়াতে পারে বলে নির্দেশিকায় উল্লেখ করা হয়েছে। তবে অন্য ক্ষেত্রে নমুনা পরীক্ষা এবং হাসপাতালে ভর্তি করা দরকার।
জলপাইগুড়ির দুই চিকিৎসকের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় নির্দেশিকা মানা হয়নি বলে চিকিৎসকদের একাংশের অভিযোগ। তাঁরা জানান, হাসপাতালে ভর্তি সোয়াইন ফ্লুয়ে আক্রান্ত এক ছাত্রের দেখভালের দায়িত্বে থাকা দুই চিকিৎসক জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন, কর্তৃপক্ষ এই খবর পেয়েছিলেন ৭ মার্চ। ১০ তারিখে তাঁদের সোয়াব বা শ্লেষা সংগ্রহ করা হয়। তবে সরকারি নির্দেশিকা মেনে তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়নি। কর্তৃপক্ষ তাঁদের রোগী দেখতেও নিষেধ করেননি। বুধবার দুই চিকিৎসকের শরীরে সোয়াইন ফ্লু সংক্রমণের রিপোর্ট আসার পরে বিষয়টি জানাজানি হতেই স্বাস্থ্য দফতর নড়েচড়ে বসে। দুই চিকিৎসককে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় এবং কেন আক্রান্ত অবস্থায় তাঁরা রোগী দেখলেন, তা জানতে চেয়ে শো-কজ করেন জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক। এ দিকে, সদর হাসপাতালের সব বিভাগে সোয়াইন ফ্লু-র উপসর্গে কী করণীয়, তার ‘গাইডলাইন’ বা নির্দেশিকা পৌঁছয়নি বলে অভিযোগ। সতর্কতার জন্য যে-‘এন৯৫ মাস্ক’ পরা আবশ্যিক, সেগুলোও পৌঁছয়নি চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছে।
রাজ্যে শুক্রবার নতুন করে ১৫ জন ওই মারণ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ন’জন কলকাতার এবং ছ’জন জেলার। ওই জেলাগুলির মধ্যে আছে জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, হাওড়া, হুগলি ও উত্তর ২৪ পরগনা। এই নিয়ে আক্রান্তের মোট সংখ্যা দাঁড়াল ২৮৯। এই মুহূর্তে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন ৭৯ জন। এ দিন প্রাণহানির খবর মেলেনি।
বাড়ল মৃতের সংখ্যা
সারা দেশে সোয়াইন ফ্লুয়ে আরও ৪০ জন প্রাণ হারিয়েছেন। সেই সঙ্গে ওই রোগে মৃতের সংখ্যা ১৬০০ ছাড়িয়েছে। শুক্রবার কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের তরফে একটি তথ্য পেশ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, এইচ-১ এন-১ ভাইরাসে মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৬২৭। আর সোয়াইন ফ্লুয়ে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ২৮৪৪১ জন। এর মধ্যে গুজরাতে ওই রোগে সব চেয়ে বেশি মানুষ মারা গিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) একটি সমীক্ষায় প্রকাশ পেয়েছে, ভারতে সোয়াইন ফ্লু ভাইরাসের জিনগত পরিবর্তন হয়েছে। এর ফলে তা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy