Advertisement
E-Paper

শিশুর প্রাণ ফিরিয়ে দিচ্ছে মায়েরই কিডনি

পৃথিবীর আলো দেখিয়েছিলেন, এর পর সন্তানকে দ্বিতীয় জীবন দান করলেন সেই মায়েরাই! নিজের শরীরের ভিতরে তাঁরা একটু-একটু করে বড় করে তুলেছিলেন এক-একটি প্রাণ। সেই প্রাণের ধুকপুকুনিতে যখন সমস্যা দেখা গেল, তখন তাঁকে বাঁচাতে অনায়াসে মায়েরা নিজের শরীর থেকে কেটে দিলেন প্রত্যঙ্গ। নিজেদের একটি করে কিডনি দান করলেন সন্তানের জীবনের স্বার্থে। মা ও শিশুর সম্পর্কের রংটা যেন আরও গাঢ়তর হয়ে ধরা পড়ছিল মঙ্গলবার কলকাতার একটি হাসপাতালের কনফারেন্স রুমে।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১১ মার্চ ২০১৫ ০৩:৪৪
মা পুষ্পা মিশ্রের সঙ্গে রুদ্র। (ডান দিকে) রুমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে মেয়ে মেঘা।—নিজস্ব চিত্র।

মা পুষ্পা মিশ্রের সঙ্গে রুদ্র। (ডান দিকে) রুমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে মেয়ে মেঘা।—নিজস্ব চিত্র।

পৃথিবীর আলো দেখিয়েছিলেন, এর পর সন্তানকে দ্বিতীয় জীবন দান করলেন সেই মায়েরাই!

নিজের শরীরের ভিতরে তাঁরা একটু-একটু করে বড় করে তুলেছিলেন এক-একটি প্রাণ। সেই প্রাণের ধুকপুকুনিতে যখন সমস্যা দেখা গেল, তখন তাঁকে বাঁচাতে অনায়াসে মায়েরা নিজের শরীর থেকে কেটে দিলেন প্রত্যঙ্গ। নিজেদের একটি করে কিডনি দান করলেন সন্তানের জীবনের স্বার্থে। মা ও শিশুর সম্পর্কের রংটা যেন আরও গাঢ়তর হয়ে ধরা পড়ছিল মঙ্গলবার কলকাতার একটি হাসপাতালের কনফারেন্স রুমে। ১২ মার্চ ‘বিশ্ব কিডনি দিবসে’র দু’দিন আগে সন্তানের মঙ্গলের আজন্মলালিত আকাঙ্ক্ষাপূরণে আশ্চর্য আলোয় ভরে গিয়েছিল মায়েদের মুখগুলো।

হাসপাতালের হলঘরে দস্যিপনা করে বেড়াচ্ছে খুদের দল। মায়ের শরীর থেকে নেওয়া কিডনিতে প্রাণ ফিরেছে তাদের দেহে। ছোট্ট হাতের মুঠোয় ধরা দিয়েছে ভাল থাকা। ঝিলমিল করতে থাকা বাচ্চাগুলোর দিকে অসীম তৃপ্তির চোখে তাকিয়ে প্রাণদায়িণী মায়েরা!

লোককথায় বলে, সন্তানের অনুরোধে নিজের হৃদয় কেটে তার হাতে দিয়েছিলেন মা। সেই সন্তানের যখন চোট লাগে, আর্তনাদ করে উঠেছিল মায়ের সেই রক্তাক্ত হৃদয়। বাস্তবই বা কম কীসে? এখানেও তো মা নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাদ দিয়েছেন তাঁর অঙ্গ, শুধু সন্তানের ভালর জন্য। দেড় বছর হল বাইপাসের ধারের ওই হাসপাতালে শিশুদের কিডনি প্রতিস্থাপন শুরু হয়েছে। ৫-১৫ বছরের ৬টি শিশুর দেহে কিডনি প্রতিস্থাপিত হয়েছে। ছ’টি ক্ষেত্রেই কিডনিদাত্রীরা হলেন শিশুদের মা।

মায়েরাই শুধু কেন? বাবা-রা কেন নন? মায়েরা একটু থমকে যান। ভেবে তার পর বলেন, “বাবারাও দিতে পিছপা ছিলেন না কিন্তু...!” এই কিন্তুর মধ্যেই লুকনো অনেক কিছু। সমাজতত্ত্ববিদদের ব্যাখ্যায়, “এখনও আমাদের আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় ছেলেরাই পরিবারের মূল রোজগেরে। এবং একটি কিডনি দান করলে দাতার জীবনযাত্রায় কিছু বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়। তাই পুরুষের বদলে কিডনির জন্য মহিলাদেরই বেশি বাছা হয়।”

তবে কিডনি বাবা কিংবা মা যে-ই দিন, অভিভাবকদের মধ্যে এ ব্যাপারে সচেতনতা এবং আগ্রহ বাড়লে কিডনিচক্রের রমরমা অনেক কমবে এবং অসুস্থ শিশুদের জীবনের মেয়াদ দীর্ঘায়িত হবে বলে মনে করছেন চিকিৎসকেরা। নেফ্রোলজিস্ট অরূপরতন দত্ত জানাচ্ছিলেন, সাধারণত জন্মের থেকেই কিছু শারীরিক ত্রুটির জন্য বা নেফ্রাইটিস থেকে শিশুদের কিডনি নষ্ট হয়। তখন অন্য শিশুর কিডনি নেওয়া যায় না। কারণ ১৮ বছরের কমবয়সীদের এ ব্যাপারে সম্মতি দেওয়ার অধিকার নেই। আর মৃতদেহ থেকে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের চল এ দেশে বিরল। এই অবস্থায় সবচেয়ে ভাল উপায়, মা বা বাবার কিডনি সন্তানের শরীরে প্রতিস্থাপন করা।

ফোকলা দাঁতে হেসে কুটোপুটি হচ্ছিল ক্লাস ওয়ানের পড়ুয়া মেঘা। অভিনেতা দেবের বড় ভক্ত সে। সব সময় দেবের স্টাইলে ট্রাউজার-জ্যাকেট পরে থাকে। ফ্রক পরানোই যায় না। বছর দেড়েক আগে মেঘা ভাল করে হাঁটাচলাও করতে পারত না। ওর খুব প্রিয় চকোলেট আর চাউমিন খেতে পারত না, কোথাও বেড়াতে যেতে পারত না, এমনকী ডায়ালসিসের জন্য স্কুলে যাওয়াও ছেড়ে দিতে হয়েছিল। মা রুমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেওয়া একটি কিডনি মেঘার শৈশব ফিরিয়ে দিয়েছে, বাঁচার নতুন অর্থ খুঁজে পেয়েছে বাঙুর অ্যাভিনিউয়ের এই পরিবারটি।

একই ছবি হরিদেবপুরের মিশ্র পরিবার বা মেচেদার মণ্ডল পরিবারের। দু’বছর বয়সে কিডনির অসুখ ধরা পড়ে রুদ্র মিশ্রর। টানা এক বছর ধরে ডায়ালসিস নিয়ে ধুঁকছিল সে। মা পুষ্পার কিডনি পাওয়ার পরে সেই ছেলে এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ১৩ বছর বয়সে দু’টো কিডনি বিকল হওয়ার পরে বিছানায় মিশে গিয়েছিল দেবরূপ। মা মানসীর একটি কিডনি পাওয়ার পর জীবন নতুন করে ধরা দিয়েছে তার কাছে।

পেডিয়াট্রিক নেফ্রোলজিস্ট রাজীব সিংহ বলছিলেন, “অনেকের ধারণা, প্রাপ্তবয়স্কদের কিডনি শিশুদের দেহে ভাল কাজ করে না। কিন্তু তা একেবারে ঠিক নয়। বরং দেখা গিয়েছে শিশুদের দেহে ছোটদের তুলনায় প্রাপ্তবয়স্কদের কিডনি অনেক ভাল ফল দিয়েছে।” আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতি ১ কোটি শিশুর মধ্যে ১০-১২টি শিশুর কিডনি প্রতিস্থাপন দরকার হয়। সংখ্যাটা নেহাত কম নয় বলে মত চিকিৎসকদের। সে ক্ষেত্রে মা বা বাবা কিডনি দিলে অর্ধেক সমস্যার সমাধান হতে পারে বলে মনে করছেন তাঁরা। ইউরোলজিস্ট শিবাজি বসু, অমিত ঘোষেদের কথায়, “শিশুদের শরীরের গ্রহণ করার ক্ষমতা খুব ভাল হয়। তাই প্রাপ্তবয়স্কদের কিডনি আকারে একটু বড় হলেও তাদের শরীরে বসে যায়। তা ছাড়া, নতুন যা ওষুধপত্র বেড়িয়েছে তাতে অনায়াসে কিডনি প্রতিস্থাপনের পরে ২৫ বছর সুস্থ থাকা সম্ভব।”

এ সব শুনে ফর্টিস হাসপাতালের কনফারেন্স রুমে বসে চোখ ঝাপসা রুমা, মানসীদের। ওঁরা বললেন, “২৫ নয়, ঈশ্বর করুন আরও অনেক দিন। চিকিৎসাবিজ্ঞান নিশ্চয় আরও উন্নত হবে। আমাদের শরীরের অংশ সম্বল করে দীর্ঘায়ু হোক আমাদের সন্তান।”

parijat bandyopadhyay pushpa mishra ruma bandyopadhyay kidney
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy