Advertisement
০৫ মে ২০২৪

স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিত্‌সক নেই, রোগী দেখছেন ‘দিদিমণি’

ভাঙাচোরা লোহার গেট পেরিয়ে মেঠো পথ ধরে একটু এগোতেই থমকে দাঁড়াতে হয়। প্রায় ত্রিশটিরও বেশি পরিত্যক্ত ঘর পড়ে রয়েছে। বেশিরভাগ ঘরেই দরজা, জানালা নেই। দেওয়ালের রং উঠে গিয়েছে। জায়গায় জায়গায় শ্যাওলাও ধরেছে। আগাছায় ভর্তি গোটা এলাকা। জনাকয়েক লোক শীতের মিঠে রোদ্দুরে তাস খেলায় ব্যস্ত। কিছু জানতে চাইলে সটান জবাব “বিরক্ত করবেন না তো। যান না, ওদিকে গিয়ে দেখুন।”

ঘোড়ামারা মহিষমারা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দশা এমনটাই। ছবি: সেবাব্রত মুখোপাধ্যায়।

ঘোড়ামারা মহিষমারা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দশা এমনটাই। ছবি: সেবাব্রত মুখোপাধ্যায়।

নিজস্ব সংবাদদাতা
হরিহরপাড়া শেষ আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০২:৩২
Share: Save:

ভাঙাচোরা লোহার গেট পেরিয়ে মেঠো পথ ধরে একটু এগোতেই থমকে দাঁড়াতে হয়। প্রায় ত্রিশটিরও বেশি পরিত্যক্ত ঘর পড়ে রয়েছে। বেশিরভাগ ঘরেই দরজা, জানালা নেই। দেওয়ালের রং উঠে গিয়েছে। জায়গায় জায়গায় শ্যাওলাও ধরেছে। আগাছায় ভর্তি গোটা এলাকা। জনাকয়েক লোক শীতের মিঠে রোদ্দুরে তাস খেলায় ব্যস্ত। কিছু জানতে চাইলে সটান জবাব “বিরক্ত করবেন না তো। যান না, ওদিকে গিয়ে দেখুন।”

সামনে আর একটু এগোতে দেখা গেল প্রায় অন্ধকার ঘরে ভাঙা চেয়ারের উপর বসে আছেন এক জন সিস্টার। জানালার এ পারে বছর দুয়েকের ছেলেকে কোলে নিয়ে বেশ কয়েক কিলোমিটার উজিয়ে আসা এক মহিলা বলে চলেছেন, “দেখুন না দিদিমণি, ছেলেটার কিছুতেই জ্বর সারছে না। একার সংসারে বড় বিপদে পড়ে গিয়েছি।”

মাঝপথে কথা থামিয়ে দিয়ে ‘ডাক্তার দিদিমনি’ কপালে হাত ছুঁয়ে দুটো ‘জ্বরের বড়ি’ ওই মহিলাকে দিয়ে বললেন, “আধখানা করে দিনে দু’বার। আর রাতে ভুলেও ভাত নয়।” অজ পাড়াগাঁয়ের কোনও গ্রামীণ চিকিত্‌সকের চেম্বার নয়, ছবিটা হরিহরপাড়ার ঘোড়ামারা মহিষমারা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের।

স্থানীয় বাসিন্দাদের চিকিত্‌সার জন্য ১৯৫২ সালে ১০ শয্যার ওই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরি করা হয়। বেলডাঙা-আমতলা রাজ্য সড়কের উপর কালীতলা মোড়ে বাস থেকে নেমে ডান দিকে পিচ রাস্তা ধরে প্রায় কিলোমিটার পাঁচেক এগোলেই ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্র। ঘোড়ামারা, মহিষমারা, কেদারচাঁদপুর, হুমাইপুর, জগন্নাথপুর, দৌলতপুর, বিহারিয়া, শিবনগর ও চাঁদাবাদের প্রায় ৫০ হাজার মানুষ ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের উপর নির্ভরশীল।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, শুরুর দিকে ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সিজার, ছোটখাটো অস্ত্রোপচার করা হত। সব সময়ের জন্য ডাক্তার ও নার্স-এর দেখা মিলত। কিন্তু রাস্তা খারাপ হওয়ায় কোনও চিকিত্‌সক ওখানে পাকাপাকিভাবে থাকতে চাইতেন না। পরে জেলায় চিকিত্‌সকের আকাল দেখা দিলে সমস্যা আরও প্রকট হয়। শেষ পর্যন্ত বন্ধই হয়ে যায় ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্র। প্রায় ২৩ বছর বন্ধ থাকার পর ২০০৭ সালে ফের স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি চালু হয়। বহরমপুর থেকে চিকিত্‌সক এসে ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসা রোগীদের চিকিত্‌সা করছিলেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ প্রায় এক বছর হতে চলল ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কোনও চিকিত্‌সকের দেখা মেলেনি। বর্তমানে পরিস্থিতি এমনই যে সামান্য সর্দি-কাশির জন্য ওষুধ দেওয়ার লোকও সবসময় মেলে না। ভরসা বলতে এক জন নার্স।

অথচ ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে একজন চিকিত্‌সক, একজন ফার্মাসিস্ট, সুইপার ও গ্রুপ-ডি স্টাফ থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবে দেখা নেই কারও। স্থানীয় ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক কৌশিক মণ্ডল বলেন, “এক জন চিকিত্‌সক এনে ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি চালানোর খুব চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু চিকিত্‌সক না মেলায় তা আর সম্ভব হচ্ছে না।”

ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সবেধন নীলমনি নার্স বসুশ্রী দাস বলেন, “নার্সিং ট্রেনিংয়ের সময় যেটুকুু শিখেছিলাম তারই উপর ভরসা করে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসা রোগীদের চিকিত্‌সা করছি। যা ওষুধ আসে তাই দেওয়া হয়। কিন্তু অন্য কোনও কর্মী না থাকায় অন্যান্য পরিষেবা দেওয়া সম্ভব হয় না।”

স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি অচল হয়ে যাওয়ায় সামান্য কিছু হলেই ছুটতে হয় প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরের বেলডাঙা বা হরিহরপাড়া ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্র কিংবা প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরের বহরমপুর হাসপাতালে। যদিও ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিকের আশ্বাস, ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের জন্য একজন চিকিত্‌সকের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

কিন্তু কবে সেই চিকিত্‌সক আসবেন আর সাধারণ মানুষ ন্যূনতম পরিষেবা কবে পাবেন তার কোনও সদুত্তর মেলেনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE