Advertisement
১৮ মে ২০২৪

সোয়াইন ফ্লু ধরতে রাজ্যে ভরসা একা নাইসেড

উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত এলাকায় কারও দেহে সোয়াইন ফ্লু-র উপসর্গ ধরা পড়লে তাঁর থুতুর নমুনা বিমানে করে আনতে হবে কলকাতার পরীক্ষাকেন্দ্রে! সে পরীক্ষাও হয় দিনে এক বার। সকালের দিকে নমুনা এসে গেলে সে দিনই রিপোর্ট পাওয়া যাবে। না হলে অপেক্ষা। রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত কার্যত বিনা চিকিৎসায় পড়ে থাকবেন রোগী। অথচ দেহে সোয়াইন ফ্লু-র উপসর্গ মিললে চিকিৎসা যত তাড়াতাড়ি শুরু হয়, ততই মঙ্গল।

সোয়াইন ফ্লুয়ে মৃত আবু রাহান।

সোয়াইন ফ্লুয়ে মৃত আবু রাহান।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০২:৫৪
Share: Save:

উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত এলাকায় কারও দেহে সোয়াইন ফ্লু-র উপসর্গ ধরা পড়লে তাঁর থুতুর নমুনা বিমানে করে আনতে হবে কলকাতার পরীক্ষাকেন্দ্রে!

সে পরীক্ষাও হয় দিনে এক বার। সকালের দিকে নমুনা এসে গেলে সে দিনই রিপোর্ট পাওয়া যাবে। না হলে অপেক্ষা। রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত কার্যত বিনা চিকিৎসায় পড়ে থাকবেন রোগী। অথচ দেহে সোয়াইন ফ্লু-র উপসর্গ মিললে চিকিৎসা যত তাড়াতাড়ি শুরু হয়, ততই মঙ্গল।

উপায় নেই। স্বাস্থ্যকর্তারা স্বীকার করে নিয়েছেন, জেলাগুলিতে সোয়াইন ফ্লু-র জীবাণু শনাক্তকরণের কোনও পরিকাঠামো রাজ্য সরকার গড়ে তুলতে পারেনি। এই মুহূর্তে গোটা পশ্চিমবঙ্গে এই জীবাণুর শনাক্তকরণ কেন্দ্রের সংখ্যা মাত্র ১! সেটি আবার কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্থা, বেলেঘাটার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ কলেরা অ্যান্ড এন্টেরিক ডিজিজেজ (নাইসেড)। কাজেই রোগীর বাড়ি দার্জিলিং হোক বা ক্যানিং, চিকিৎসকের সন্দেহ হলে সেখান থেকে তাঁর কফ-থুতুর নমুনা পাঠাতে হবে নাইসেড-এই।

উত্তরবঙ্গে গত বছর এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গ থাকা একটি রোগের প্রকোপ জেলায় স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর চিত্রটা পরিষ্কার করে দিয়েছিল। এ বারও চিকিৎসকদের একাংশের অভিযোগ, সোয়াইন ফ্লু নিয়ে যে ধরনের সচেতনতার প্রচার দরকার ছিল, তা হয়নি। তাই রোগীর অবস্থার অবনতি হওয়ার আগে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে না। এর পরে রয়েছে রোগের জীবাণু শনাক্তকরণের ঝক্কি। স্বাস্থ্যসচিব মলয় দে কিন্তু মেনেই নিচ্ছেন, জীবাণু শনাক্তকরণের ওই পরিকাঠামো জেলায় জেলায় এখনই গড়ে তোলা সম্ভব নয়। তাঁর কথায়, “যে পরিকাঠামো রয়েছে, তার মধ্যেই আমাদের লড়তে হবে। কলকাতায় স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনে সোয়াইন ফ্লু শনাক্তকরণের একটি ইউনিট তৈরি হচ্ছে। সেটি হয়ে গেলে নাইসেডের চাপ কিছুটা কমবে।”

গত বছর এনসেফ্যালাইটিস উপসর্গ থাকা রোগের সংক্রমণ ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়ার পরে মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গাফিলতির অভিযোগে জেলার বেশ কয়েক জন স্বাস্থ্যকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। স্বাস্থ্যসচিব যা-ই বলুন, সোয়াইন ফ্লু নিয়েও রাজ্য সরকারের তরফে ব্যাপক গাফিলতির অভিযোগ উঠছে। কারণ, এই রোগ যে গত পাঁচ বছর ধরে দেশের নানা অংশে বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, তা স্বাস্থ্য ভবনের অজানা নয়। গত দু’মাস ধরে রোগটি উত্তর ও পশ্চিম ভারতে ব্যাপক ভাবে ছড়িয়েছে। তা সত্ত্বেও কেন আগে থেকে সচেতনতা ও পরিকাঠামোয় নজর দেওয়া হল না, স্বভাবতই সেই প্রশ্ন উঠেছে।

রাজ্যে ইতিমধ্যেই সোয়াইন ফ্লুয়ে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৮। মৃত্যু হয়েছে তিন জনের। এর মধ্যে শুক্রবার মারা যায় বাগুইআটি মাঝেরপাড়ার বাসিন্দা আবু রাহান (৮)। এ দিন নতুন করে ১১ জনের দেহে এই জীবাণু শনাক্ত হয়েছে। আবু রাহানকে সপ্তাহ দুয়েক আগে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় বেলেঘাটার বি সি রায় শিশু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। বি সি রায় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, আপাতত সেখানে সোয়াইন ফ্লু-আক্রান্ত ৬টি শিশু ভর্তি আছে। মুর্শিদাবাদের তরন্নুম নামে একটি শিশুর অবস্থা সঙ্কটজনক। আবু রাহানের পিসেমশাই অখিরুদ্দিন মহম্মদ এ দিন বলেন, “প্রথমে ওষুধ পেতে সমস্যা হচ্ছিল। বি সি রায় কর্তৃপক্ষ আমাদের আইডি-তে পাঠান। সেখানেও ওষুধ না পেয়ে স্বাস্থ্য ভবনে যাই। সেখানে যেতে আবার ফোনে বলা হয়, ওষুধ হাসপাতালে চলে এসেছে। আমরা যেন ফিরে আসি।”

স্বাস্থ্যকর্তারা অবশ্য বলছেন, সোয়াইন ফ্লু-র ওষুধ অর্থাৎ ‘ট্যামিফ্লু’ সব রোগীর প্রয়োজন নেই। এক শীর্ষ কর্তার কথায়, “এই সব ওষুধের যথেষ্ট পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। তাই অনর্থক দুশ্চিন্তা করে ওষুধ খাওয়া ঠিক নয়। চিকিৎসকেরা যখন বুঝবেন, তখনই ওষুধ দেওয়া হবে।”

বস্তুত, স্বাস্থ্যকর্তাদের অনেকেরই বক্তব্য হল, সোয়াইন ফ্লু নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই।

যদিও চিকিৎসক সংগঠন আইএমএ-র জাতীয় শাখার সেক্রেটারি জেনারেল কৃষ্ণকুমার অগ্রবাল এ দিন বলেন, “সোয়াইন ফ্লু-কে যথাযথ গুরুত্ব না দিলে বড় ভুল করা হবে। যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নিজেই স্বাস্থ্যমন্ত্রী, তাঁর এ ব্যাপারে আরও ওয়াকিবহাল থাকা ভাল।’’ এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যসচিবের বক্তব্য, “দুশ্চিন্তা করতে বারণ করার অর্থ রোগকে গুরুত্ব না দেওয়া নয়। নাইসেড থেকে রিপোর্ট আগে আমার কাছে আসছে। রোগীর বাড়ির সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছি। কোনও তরফেই যাতে সমন্বয়ের কোনও অভাব না থাকে, সে ব্যাপারে খেয়াল রাখা হচ্ছে।”

কলকাতা ও দিল্লি থেকে সোয়াইন ফ্লু ইতিমধ্যে পৌঁছে গিয়েছে নাগাল্যান্ড ও মিজোরামেও। সেখানে দুই রোগিণীর দেহে ধরা পড়েছে এই জীবাণু। ১৩ ফেব্রুয়ারি কলকাতা থেকে ডিমাপুরে আসা এক মহিলা জ্বর নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। তাঁর কফ পরীক্ষা করে এইচ১এন১ ভাইরাস ধরা পড়েছে। অন্য মহিলা গত সপ্তাহে দিল্লি থেকে মিজোরামে আসেন। সেখানেই তাঁর সোয়াইন ফ্লু ধরা পড়ে। মিজোরাম ও নাগাল্যান্ডে এ নিয়ে সতর্কতা জারির পাশাপাশি সতর্ক করা হয়েছে প্রতিবেশী অসমকেও।

সাংবাদিকদের জন্য টিকা

রাজনীতির গিমিক এমনও হয়! দেশ জুড়ে ক্রমশ মহামারীর আকার নিচ্ছে সোয়াইন ফ্লু। অথচ এই রোগের জন্য রক্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা এখনও যেমন সব সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্র নেই, তেমনই নিরাময়ের ওষুধ ও প্রতিষেধক টিকা হাসপাতালগুলিতেও অপ্রতুল। এই অবস্থায় সরকারের উপর রাজনৈতিক চাপ বাড়াতে কংগ্রেস সদর দফতরে সাংবাদিকদের বিনামূল্যে প্রতিষেধক দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন দলীয় নেতৃত্ব। দলের প্রধান মুখপাত্র অজয় মাকেন বলেন, “সরকার দায়িত্বহীন। কিন্তু জাতীয় দল হিসেবে কংগ্রেসের সামাজিক দায়বদ্ধতা রয়েছে। তাই কংগ্রেস স্থির করেছে, যে সব সাংবাদিক কংগ্রেসের রাজনীতি নিয়ে লেখালেখি করেন (বিট রিপোর্টার), তাঁদের প্রতিষেধক টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে দলের সদর দফতরে। প্রতিদিন দশ জন করে সাংবাদিককে টিকা দেওয়া হবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

swine flu
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE