তখনও জ্বলছে আগুন। আতঙ্কে রোগিণীরা। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।
চোপ! সচিবের বৈঠক চলছে!
বৃহস্পতিবার এমনই ঘটনার সাক্ষী থাকল ঝাড়গ্রাম জেলা হাসপাতাল। ইতিহাসের কথা, রোম নগরী যখন জ্বলছিল, তখন সম্রাট নিরো বেহালা বাজাচ্ছিলেন। আর বৃহস্পতিবার সকালে ফিমেল মেডিক্যাল ওয়ার্ডে শট সার্কিটে আগুন লেগে যাওয়ায় অসুস্থ রোগিণী ও তাঁদের পরিজনরা যখন প্রাণভয়ে চিত্কার করে ছোটাছুটি করছেন, তখন হাসপাতালের সভাঘরে সচিব পর্যায়ের পর্যালোচনা বৈঠকে ব্যস্ত থাকলেন স্বাস্থ্য আধিকারিকরা। একটি বারের জন্য কেউ বাইরে এলেন না। কর্তৃপক্ষের এই উদাসীন ও অমানবিক আচরণের অভিযোগে সরব হন রোগী ও তাঁদের পরিজনরা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবশ্য দাবি, এটি ছোট্ট ঘটনা।
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, ঝাড়গ্রাম জেলা হাসপাতালের উন্নয়ন প্রকল্পগুলির কাজ এগোচ্ছে মন্থর গতিতে। যে কারণে এদিন পরিদর্শন ও পর্যালোচনা বৈঠক করতে এসেছিলেন রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের যুগ্ম সচিব শ্যামল মণ্ডল। ফিমেল মেডিক্যাল ওয়ার্ড থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে বাতানুকুল সভাঘরে সকাল দশটা থেকে বৈঠক চলছিল। যুগ্ম সচিব ছাড়াও বৈঠকে ছিলেন ঝাড়গ্রাম স্বাস্থ্য জেলার সিএমওএইচ অশ্বিনীকুমার মাঝি, হাসপাতালের সুপার মলয় আদক-সহ স্বাস্থ্য ও পূর্ত দফতরের প্রশাসনিক আধিকারিকরা। এ দিন সচিবের বৈঠক চলাকালীন ওয়ার্ডে শট সার্কিটের ঘটনায় হাসপাতালের রুগ্ণ চিত্রটা ফের বেআব্রু হয়ে পড়ল। সকাল এগারোটা নাগাদ তখন হাসপাতালে ভিজিটিং আওয়ার্স থাকায় রোগীর পরিজনদের ভিড় ছিল। ফিমেল মেডিক্যাল ওয়ার্ডে চিকিত্সাধীন ৪৩ জন রোগিণীর মধ্যে অনেকের পরিজনরা দেখা করতে এসেছিলেন। আচমকা পোড়া গন্ধ পেয়ে কর্তব্যরত দুই নার্স উপরে তাকিয়ে দেখতে পান, শয্যার মাঝামাঝি সিলিংয়ের উপর একটি ‘হ্যাঙ্গিং ডবল টিউব লাইট সেট’-এর একপাশ থেকে আগুনের ফুলকি বের হচ্ছে। মুহূর্তে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে। পোড়া গন্ধে ভরে যায় চারদিক। এই পরিস্থিতিতে আতঙ্কিত রোগিনী ও পরিজনরা ওয়ার্ড থেকে ছুটে বেরনোর জন্য হুড়োহুড়ি শুরু করেন। কয়েক জন পড়ে গিয়ে অল্পবিস্তর চোট পান। স্যালাইন হাতে নিয়ে এক রোগিণীকে ছুটে বেরতে দেখা যায়। আবার অসুস্থ কয়েক জন রোগিনীকে পরিজনরা পাঁজাকোলা করে নিয়ে বেরিয়ে আসেন। আতঙ্কিত নার্সরাও ছোটাছুটি শুরু করেন। এর মধ্যেই সশব্দে টিউব ফেটে গিয়ে চারদিকে কাঁচ ছড়িয়ে পড়ে। এরপরই গোটা হাসপাতাল চত্বর জুড়ে আতঙ্কের বাতাবরণ তৈরি হয়। প্রায় মিনিট কুড়ি ধরে এই অবস্থা চললেও একটি বারের জন্য স্বাস্থ্য সচিব বা আধিকারিকরা বৈঠক ছেড়ে বেরিয়ে ঘটনার খোঁজ নিতে আসেন নি। দমকলকেও খবর দেওয়া হয় নি। হাসপাতালের কর্মীরাই ওই ওয়ার্ডের মেন সুইচ অফ করে বিদ্যুত্ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পরে সাড়ে এগারোটা নাগাদ রোগিনীরা ওয়ার্ডে ফেরেন। সচিব ও আধিকারিকদের বৈঠকও ওই সময় শেষ হয়। পরে বিদ্যুত্ সংযোগ পরীক্ষা করে দেখেন পূর্ত ইলেকট্রিক্যাল বিভাগের কর্মীরা।
ফিমেল মেডিক্যাল ওয়ার্ডে রক্তাপ্লতার উপসর্গ নিয়ে চিকিত্সাধীন রেখা রাউত বলেন, “আগুন দেখে দুর্বল শরীরে ছুটে বেরতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাই। ভয়ভীতির ফলে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়।” জ্বরে আক্রান্ত বৃদ্ধা আশালতা দাস বলেন, “হাঁটার ক্ষমতা ছিল না। অন্য রোগীর পরিজনরা পাঁজাকোলা করে আমাকে ওয়ার্ড থেকে বের করে আনেন।” রোগীদের পরিজন ভবনী নায়েক, মিতালী নায়েক, দিলীপ দাসের বক্তব্য, “কর্মীরা সময় মতো বিদ্যুত্ সংযোগ বিচ্ছিন্ন না করে দিলে বড় অঘটন ঘটার সম্ভাবনা ছিল। নামেই জেলা হাসপাতাল, জতুগৃহের মধ্যে রোগীদের থাকতে হচ্ছে।”
এর আগে গত ১৫ মে ফিমেল মেডিক্যাল ওয়ার্ডে শট সার্কিটের দরুণ আতঙ্ক ছড়িয়েছিল। তারপর ওয়ার্ডটি মূল ভবনে সরিয়ে আনা হয়। কিন্তু তারপর ফের এদিনের ঘটনায় অস্বস্তি বেড়েছে কর্তৃপক্ষের।
এ দিন বৈঠক সেরে বেরিয়ে যুগ্ম সচিব শ্যামলবাবুকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “পরিদর্শনে এসেছি। এর বেশি কিছু বলতে পারব না। কিছু জানার থাকলে সিএমওএইচকে জিজ্ঞেস করুন।” ঝাড়গ্রামের সিএমওএইচ অশ্বিনীকুমার মাঝি দাবি করেন, “সামান্য ইলেকট্রিক্যাল সমস্যা হয়েছিল। পুরনো ওয়ারিং ধাপে ধাপে পাল্টানো হবে।”
বৈঠক শেষে শ্যামলবাবু হাসপাতালের ডায়ালিসিস ইউনিট, কার্ডিয়্যাক কেয়ার ইউনিট, নবনির্মিত চার শয্যা বিশিষ্ট জরুরি বিভাগের কক্ষটি পরিদর্শন করেন। সিএমওএইচ অফিসের নতুন ভবনের জন্য প্রস্তাবিত জায়গাটিও ঘুরে দেখেন। সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের ভবন তৈরির কাজও পরিদর্শন করেন তিনি। তবে ফিমেল মেডিক্যাল ওয়ার্ড মুখো হন নি স্বাস্থ্যকর্তারা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy