ফের রঘুরাম রাজনের সঙ্গে সংঘাতে অরুণ জেটলির অর্থমন্ত্রক। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নরের ডানা ছাঁটার প্রস্তাব এনে অর্থমন্ত্রক রঘুরাম রাজনের সঙ্গে আবার কুস্তির লড়াই ঘোষণা করে দিল।
ক্ষোভের আগুন ধিকিধিকি জ্বলছিলই। নরেন্দ্র মোদী সরকারের মন্ত্রীরা নিয়মিত ঘরোয়া আলোচনায় বিষোদ্গার করছিলেন রঘুরাম রাজনের নামে। কারণ? রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর সুদের হার কমাচ্ছেন না। শিল্পের জন্য ঋণ সহজলভ্য না হওয়াতেই নতুন লগ্নি হচ্ছে না। দ্রুত গতিতে আর্থিক বৃদ্ধির হার বাড়ছে না। সেই কারণেই আসছে না ‘অচ্ছে দিন’।
এ বার অর্থমন্ত্রক রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নরের ডানা ছাঁটার প্রস্তাব পেশ করায় সেই ক্ষোভই প্রকাশ্যে চলে এল।
দু’দিন আগেই আর্থিক ক্ষেত্রের জন্য খসড়া বিধি প্রকাশ করেছে অর্থমন্ত্রক। ওই বিধি অনুযায়ী, সুদের হার ঠিক করার ক্ষমতা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হাত থেকে কার্যত কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে চলে যাবে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বদলে একটি সাত সদস্যের সুদ নীতি কমিটি সুদের হার ঠিক করবে। ওই সাত জনের মধ্যে চার জনকেই কেন্দ্র নিয়োগ করবে। গভর্নরের কোনও ‘ভেটো পাওয়ার’-ও থাকছে না।
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের স্বাধীনতায় সরকার হস্তক্ষেপ করতে চাইছে বলে শোরগোল শুরু হয়েছে। অর্থমন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী জয়ন্ত সিনহা, মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যম যুক্তি দিয়েছেন, এটা খসড়া প্রস্তাব মাত্র। সরকারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নয়। খসড়া প্রকাশ করে সকলের মতামত চাওয়া হয়েছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞ বা সংশ্লিষ্ট মহল যাতে খসড়া প্রস্তাবের পক্ষেই মত দেয়, তার জন্য ঘরোয়া স্তরে দরবার শুরু করে দিয়েছেন কেন্দ্রীয়মন্ত্রী ও বিজেপি-র শীর্ষনেতারা। তাঁরা যুক্তি দিচ্ছেন, সুদ কমানো বা বাড়ানোর ক্ষমতা কোনও এক জন ব্যক্তির ইচ্ছের উপর নির্ভর থাকা উচিত নয়। গভর্নরের ক্ষমতা কমিয়ে এ ক্ষেত্রে আরও গণতন্ত্র আসা প্রয়োজন। সরকারের মতামতও গুরুত্ব পাওয়া উচিত।
ক্যাবিনেট মন্ত্রীরা ঘরোয়া আলোচনায় স্পষ্ট করে দিচ্ছেন, এ শুধু ডানা ছাঁটার প্রস্তাব নয়। এটি রঘুরাজ রাজনের উদ্দেশে কড়া বার্তাও। কারণ বারবার ইঙ্গিতপূর্ণ বার্তা পাঠানো সত্ত্বেও রঘুরাম সুদ কমানোর রাস্তায় হাঁটছেন না। তিনি আরও মূল্যবৃদ্ধি কমার অপেক্ষায় রয়েছেন। এক ক্যাবিনেট মন্ত্রী বলেন, ‘‘উনি আসলে অর্থনীতির আরও খারাপ সময়ের অপেক্ষা করছেন!’’ মন্ত্রীদের যুক্তি, পাইকারি মূল্যবৃদ্ধির হার শূন্যর নীচে চলে গিয়েছে। অর্থাৎ, জিনিসপত্রের দাম আদৌ বাড়ছে না। কমছে। উল্টো দিকে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের যুক্তি, খুচরো পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার ৫ শতাংশের উপরে। এতে খাদ্যপণ্যের দাম অনেক বেশি প্রতিফলিত হয়। এপ্রিল মাস থেকেই তা ধাপে ধাপে ধাপে বাড়ছে। তা ছাড়া, শুধু মূল্যবৃদ্ধির হার দেখে সুদের হার ঠিক হয় না। অর্থনীতির নানারকম মাপকাঠি, দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে, তা খতিয়ে দেখে সুদের হার ঠিক হয়।
বিশেষজ্ঞদের অনেকেরই মত, সরকারের হাতে সুদের হার ঠিক করার ক্ষমতা চলে গেলে স্বল্পমেয়াদি লাভের কথাই ভাবা হবে। তাতে অর্থনীতিরই ক্ষতি। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক তার স্বাধীনতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে ‘রাবার স্ট্যাম্প’-এ পরিণত হলে আন্তর্জাতিক দুনিয়াতেও ভুল বার্তা যাবে। কিন্তু সরকারের মন্ত্রীদের যুক্তি, সুদ নীতি কমিটিতে সরকারের লোক থাকলে সরকারের আর্থিক নীতি ও সুদের নীতির মধ্যে আরও বেশি সমন্বয় থাকবে। পাল্টা যুক্তি হল, সরকারের হাতে ক্ষমতা গেলে রাজনৈতিক লাভের দিকে তাকিয়ে সুদের হার ঠিক হবে। মন্ত্রী বলছেন, ব্রিটেন বা আমেরিকার মতো দেশে সুদ নীতি কমিটিই সুদের হার ঠিক করে। পাল্টা যুক্তি, ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ডের কমিটিতে ব্যাঙ্কের প্রতিনিধিরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। আমেরিকার কমিটিতে আইনসভার প্রতিনিধিরা কমিটিতে যথেষ্ট দীর্ঘ সময় থাকেন। ফলে তাঁরা স্বল্পমেয়াদি লাভের কথা ভাবেন না।
অর্থমন্ত্রকের সঙ্গে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নরের সংঘাত এ দেশে নতুন নয়। ইউপিএ-জমানায় পি চিদম্বরমের সঙ্গেও তদানীন্তন গভর্নর ডি সুব্বারাওয়ের এই সুদ কমানো নিয়েই সংঘাত চরমে উঠেছিল। চিদম্বরম প্রকাশ্যেই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কঠোর সুদ নীতির সমালোচনা করেছিলেন। অরুণ জেটলি প্রকাশ্যে মুখ খোলেননি বটে। কিন্তু কাগজে-কলমে সংঘাত চলছে।
সুদের হার নির্ধারণের ক্ষমতা ছাঁটার আগে সরকারি ঋণপত্রের (গভর্নমেন্ট ডেট) নিয়ন্ত্রণ সেবি-র হাতে তুলে দিয়ে চেয়েছিলেন জেটলি। কেন্দ্রের ঋণ নিয়ন্ত্রণ ও দেখভালের জন্য পৃথক সংস্থা তৈরির কথা ঘোষণা করেন। কিন্তু বিভিন্ন মহলে ও রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তরফেও আপত্তি আসায় দু’টি প্রস্তাবকেই হিমঘরে পাঠান জেটলি। লড়াইয়ের প্রথম রাউন্ডে এগিয়ে থেকে শেষ করলেও এ বার দ্বিতীয় রাউন্ডেও জেটলি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। সুদের হার কমানো-বাড়ানোকেই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নরের সবথেকে বড় ক্ষমতা হিসেবে ধরা হয়। এ বিষয়ে তিনি ব্যাঙ্কের উপদেষ্টামণ্ডলীর পরামর্শ নিতে পারেন। কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তাঁরই হাতে। সেই ক্ষমতাতেই হাত দিতে চাইছে অর্থমন্ত্রক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy