Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
পথ না পেয়ে ‘বিষপান’ লালুর

প্রথম কিস্তি নীতীশের, জোট-প্রার্থী তিনিই

নীতীশ কুমারকে মেনে নিয়ে শেষে কি নীলকণ্ঠ হলেন তিনি! সররাসরি এমনটা না বললেও নীতীশ কুমারকে জনতা পরিবারের তরফে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী মেনে নেওয়াটা যে তাঁর কাছে বিষ খাওয়ার চেয়ে কম কিছু নয়, ঠারেঠোরে আজ সেটাই বুঝিয়ে দিলেন লালু প্রসাদ। তবে মোড়কটা দিলেন অন্য। মুলায়ম সিংহ যাদব জেডিইউ নেতা নীতীশের নাম ঘোষণা করার পরে পাশে বসে লালু বললেন, ‘‘সাম্প্রদায়িকতার কেউটে মারতে যে কোনও কিছু গিলতেই আমি রাজি। এ জন্য দরকারে বিষপান করতেও প্রস্তুত।’’

জোটের মুখ। সাংবাদিক বৈঠকে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার। সোমবার পটনায়।

জোটের মুখ। সাংবাদিক বৈঠকে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার। সোমবার পটনায়।

শঙ্খদীপ দাস ও দিবাকর রায়
নয়াদিল্লি ও পটনা শেষ আপডেট: ০৯ জুন ২০১৫ ০৩:২৭
Share: Save:

নীতীশ কুমারকে মেনে নিয়ে শেষে কি নীলকণ্ঠ হলেন তিনি!

সররাসরি এমনটা না বললেও নীতীশ কুমারকে জনতা পরিবারের তরফে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী মেনে নেওয়াটা যে তাঁর কাছে বিষ খাওয়ার চেয়ে কম কিছু নয়, ঠারেঠোরে আজ সেটাই বুঝিয়ে দিলেন লালু প্রসাদ। তবে মোড়কটা দিলেন অন্য। মুলায়ম সিংহ যাদব জেডিইউ নেতা নীতীশের নাম ঘোষণা করার পরে পাশে বসে লালু বললেন, ‘‘সাম্প্রদায়িকতার কেউটে মারতে যে কোনও কিছু গিলতেই আমি রাজি। এ জন্য দরকারে বিষপান করতেও প্রস্তুত।’’

লালকৃষ্ণ আডবাণীর রথ রুখে দেওয়া নিয়ে এখনও গর্ব করেন তিনি। সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ‘মুখ’ হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে কতটা ক্ষতিস্বীকার করতে তিনি প্রস্তুত, আপাত ভাবে সেটাই বোঝানোর চেষ্টা করলেন লালু। কিন্তু তাঁর অনেক সরেস মন্তব্যেই মিশে থাকে তুখোড় রাজনীতির বার্তা। কথার আড়ালে বাঁকা অর্থ গুঁজে দিতে ওস্তাদ তিনি। এমনকী, ঘোর দুর্দিনও তার মুখে হয়ে ওঠে সুদিনের মতো! দুর্নীতির দায়ে জেলে যাওয়াকে যিনি শ্রীকৃষ্ণের জন্মভূমি দর্শনে তীর্থযাত্রা বলে বর্ণনা করতে পারেন— তিনি ভাঙতে পারেন, কিন্তু মচকান না। জোট গড়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হয়ে গিয়েছিল কালই। কিন্তু জোটের নেতৃত্বের প্রশ্নে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত হাল ছাড়েননি। কিন্তু ইতিউতি সাঁতরেও আঁকড়ে ধরার খড়কুটো জুটছে না বুঝে আজ সকালে সুর পাল্টাতে হল লালুকে। কিস্তি মারলেন নীতীশই।


নয়াদিল্লিতে সাংবাদিকদের মুখোমুখি লালু প্রসাদ।

লালুকে পাশে নিয়ে বর্ষীয়ান সমাজবাদী পার্টি নেতা মুলায়ম সিংহ যাদব আজ জানিয়ে দিলেন, ‘‘বিহার বিধানসভা ভোটে নীতীশ হবেন জনতা জোটের মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী।’’ মুলায়ম এ-ও জানান, তিনি ‘খুশি’ কারণ, ‘‘লালুজিই নীতীশের নাম প্রস্তাব করেছেন।’’ লালু এতে ‘খুশি’ কি না, সেটা অবশ্য নিজেই স্পষ্ট করে দেন এর পরে, বিষপানের প্রসঙ্গ তুলে। সেই সঙ্গে স্পষ্টই বুঝিয়ে দেন কোন দায় থেকে তিনি এই আপস করছেন। মুলায়মের বৈঠকখানায় বসে লালু বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী নিয়ে অলীক জল্পনা চলছিল! আমার পক্ষে ভোটে লড়া সম্ভব নয় (‌‌ফৌজদারি মামলায় যেহেতু তিনি অভিযুক্ত ও সাজাপ্রাপ্ত)। স্ত্রী-ছেলেমেয়েরও এ ব্যাপারে আগ্রহ নেই। ছেলেমেয়েরাও ছোট। এমনকী, আমার দলে এই পদের কোনও দাবিদার নেই।’’ এর পরই নিজের ও নীতীশের দলের সব নেতা-কর্ম়ীকে একজোট হয়ে সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামার ডাক দেন লালু।

এই ঘোষণার অপেক্ষায় ছিল পটনা। মুলায়মের ঘোষণা শেষ হতেই খুশির ঝিলিক খেলে যায় মুখ্যমন্ত্রী নীতীশের সরকারি বাসভবন চত্বরে। ক্রমশ ভিড় জমান জেডিইউ সমর্থকরা। স্লোগান তোলেন নীতীশের নামে। যেন ভোটের আগেই জিতে গিয়েছেন তাঁদের নেতা! তবে কৌশলী নীতীশ এ দিনও আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখেন। জোট প্রসঙ্গে শুধু বলেন, ‘‘এতে সামিল হবে কংগ্রেসও।’’ পাশাপাশি রাহুল গাঁধীর সঙ্গে তাঁর গত কালের বৈঠক নিয়েও ব্যাখ্যা দেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী। মনে করা হচ্ছে, নীতীশ-রাহুল এই নয়া অক্ষের চাপেই হার মানতে হল লালুকে। বিহারে লালু-নীতীশের সঙ্গে জোটে গেলে কংগ্রেস খুব বেশি আসনে লড়ার সুযোগ পাবে না। তবু বিজেপিকে হারাতে সনিয়া গাঁধী চান জোট হোক। রাহুল গাঁধীও রাজি বিহারের ক্ষেত্রে একলা চলো নীতি ছাড়তে। কিন্তু কংগ্রেস এ-ও আঁচ করছিল, জোটের চেষ্টা ঘেঁটে দিতে চাইছেন লালু। তাতে ইন্ধন জোগাচ্ছে বিজেপি। এই অবস্থায় সনিয়া লালুকে স্পষ্ট বুঝিয়ে দেন, তিনি নীতীশের নেতৃত্ব না মেনে নিলে তাঁকে বাদ দিয়েই পৃথক জোট হবে। এ ব্যাপারে সনিয়া ও রাহুলের সঙ্গে তলে তলে সমঝোতা রেখে চলেন নীতীশও।

সেই হুঁশিয়ারির পরেও গত কাল মুলায়মের বাড়িতে ডাকা বৈঠকে জোটের নেতৃত্বের প্রশ্নে নরম হননি লালু। রাজনৈতিক সূত্রে খবর, এই অবস্থায় রাতে মুলায়মের সঙ্গে কথা বলেন কংগ্রেস নেতা গুলাম নবি আজাদ ও সনিয়া গাঁধীর রাজনৈতিক সচিব আহমেদ পটেল। মুলায়মকে তাঁরা বলেন, লালুকে বুঝিয়ে রাজি করাতে। সব দিক থেকে চাপের মুখে পড়েই শেষমেশ লালুর ‘বিষপান’।

কংগ্রেসের এক শীর্ষ নেতার কথায়, আর কোনও উপায় ছিল না লালুর সামনে। মতাদর্শগত কারণেই বিজেপির সঙ্গে তাঁর জোট সম্ভব নয়। তবু নীতীশকে ঠেকাতে সেই পথে হাঁটলে আখেরে ঢের বেশি ক্ষতি হবে লালুর। কারণ, বিজেপি তখন যাদব ভোট পুরো গ্রাস করে নেবে। এমনিতেই লোকসভা ভোটে নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহরা তাদের মেরুকরণের রাজনীতির মাধ্যমে যাদব ভোটে ধস নামিয়ে দিয়েছিল। আবার লালু একা লড়লে বিহারে তাঁর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই মুশকিল। বিকেলে এক টিভি সাক্ষাৎকারে লালু তাই বলেন, ‘‘নীতীশ আমার ছোট ভাই। তাঁর সঙ্গে জোটটা সময়ের দাবি।’’

তবে এই জোট-রফার পরেও থাকছে প্রশ্ন। কুর্মি নীতীশকে মেনে নেবে তো রাজ্যের ১৪% যাদব ভোট? বিহারের রাজনীতিতে তেলে-জলে মিশ খাবে তো? আজই আরজেডি থেকে বহিষ্কৃত সাংসদ পাপ্পু যাদব আলাদা দল গড়ে লালু-নীতীশ জোটের মোকাবিলা করবেন বলে ঘোষণা করেছেন। তবে এবিপি নিউজ এবং এসি নিয়েলসেনের সম্প্রতি এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে লালু-নীতীশ-কংগ্রেস জোট বেঁধে লড়লে সরকার গড়তে পারে। তবে এ ধরনের সমীক্ষা যে সব সময় মেলে, এমনটা নয়। তা ছাড়া, আসন সমঝোতার প্রশ্নে জোটের যাত্রা মসৃণ হবে কি না সেটাও বড় প্রশ্ন। লালু অবশ্য বলেছেন, ‘‘মনের মিল যখন হয়েছে, আসন সমঝোতাটা কোনও সমস্যাই নয়।’’ মুখে এটা বললেও লালুর লক্ষ্য হবে যথা সম্ভব বেশি আসনে লড়া, যাতে নীতীশ মুখ্যমন্ত্রী হলেও আরজেডি-র উপরে তাঁকে নির্ভর করে চলতে হয়। মেয়ে মিসার ভবিষ্যৎও সুনিশ্চিত করতে চাইবেন তিনি।

সিপিএএম সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি আজ মুলায়মের ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছেন। তবে এখনই জনতা পরিবারের সঙ্গে হাত মোলানোর প্রসঙ্গ এড়িয়ে তিনি জানিয়েছেন, বাকি বামেদের সঙ্গে মিলেই লড়ার কথা ভাবা হয়েছে এ পর্যন্ত।

প্রতিপক্ষের দলগুলি কাছাকাছি আসায় বিজেপি শিবিরে তৈরি হয়েছে উদ্বেগ। তবে বিজেপি নেতা রবিশঙ্কর প্রসাদ ও রাজীবপ্রতাপ রুডিরা এই জোটের কোনও ভবিষ্যৎ নেই বলে দাবি করেছেন। রুডির কটাক্ষ, ‘‘লালুপ্রসাদের জঙ্গলরাজের বিরুদ্ধে লড়েই ক্ষমতায় এসেছেন নীতীশ। দু’জনে হাত মেলালেন আজ। দু’জনেরই বিশ্বাসযোগ্যতা এখন শূ্ন্য। আর দু’টি শূন্য যোগ করলে শূন্যই হয়। নিজেদের অস্তিত্বরক্ষার তাগিদেই ওঁরা পরস্পরকে আঁকড়ে ধরেছেন। কিন্তু বিহারের মানুষ এই সুবিধাবাদী রাজনীতি থেকে মুক্তি চাইছে।’’

ছবি: পিটিআই

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE