খারাপ কাজের শাস্তি হিসেবে এক জন পূর্ণ মন্ত্রীরও চাকরি যায়নি। তবু, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মনে করেন, মন্ত্রিসভার দ্বিতীয় রদবদলের পিছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে কাজের মূল্যায়ন। প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় গত দু’মাস ধরে মন্ত্রীদের রিপোর্ট কার্ড তৈরি করেছে। আর তার ভিত্তিতেই রদবদল হয়েছে মন্ত্রিসভার। ছাঁটাই না হোক, ওঠা-নামা হয়েছে অনেকেরই।
রিপোর্ট কার্ড তৈরির অনেক আগেই কাজের হিসেবনিকেশ চলছিল। ছ’মাস আগে এক বার মন্ত্রিসভার বৈঠকে নরেন্দ্র মোদী তৎকালীন টেলিকম মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদকে তিরস্কার করেন কল ড্রপ সমস্যার জন্য। বলেন, ‘‘আমরা মন্ত্রী কিংবা রাজনৈতিক নেতারাই মোবাইল ফোনে কল ড্রপ সমস্যায় নাজেহাল হয়ে যাচ্ছি। তা হলে সাধারণ মানুষের অবস্থা কী হবে?’’ রবিশঙ্কর সতীর্থ মন্ত্রীদের সামনে অস্বস্তিতে পড়ে গিয়ে বলেন, ‘‘অফিসাররা আমার কথা শুনছে না। বলা সত্ত্বেও ওরা ওই কোম্পানিগুলির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না।’’ প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, অফিসারদের দিয়ে কাজ না করাতে পারাটাও কিন্তু মন্ত্রীর ব্যর্থতা। সে দিনই রবিশঙ্কর অশনি সংকেত দেখেছিলেন। মন্ত্রিসভার এই রদবদলের কয়েক দিন আগে দফতর ভিত্তিক মূল্যায়নের ম্যারাথন বৈঠকে আবার প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় টেলিকম মন্ত্রকের কাজের তীব্র সমালোচনা করেন। রবিশঙ্কর বুঝে যান, এই মন্ত্রককে ‘আলবিদা’ বলার সময় এসেছে। বরখাস্ত হওয়ার ভয়ও ছিল।
তবে রবিশঙ্করকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেননি মোদী। বিহারের এই কায়স্থ আইনজীবী নেতাকে উল্টে ফিরিয়ে দেওয়া হল আইন মন্ত্রক। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর মোদী রবিশঙ্করকে আইনমন্ত্রী করেছিলেন। কিন্তু বিচারপতি নিয়োগ ও সুপ্রিম কোর্টের নানা মামলায় সরকারের ব্যর্থতার দায় নিয়ে তাঁকে সরে যেতে হয়। অরুণ জেটলির ঘনিষ্ঠ অ্যাটর্নি জেনারেল মুকুল রোহতগির সঙ্গেও রবিশঙ্করের বিবাদ ছিল। অনেকেই মনে করেন, এটিও তাঁর অপসারণের আর একটি কারণ। এ বারেও রবিশঙ্কর প্রসাদের ঘনিষ্ঠ মহলে অভিযোগ ছিল যে, টেলিকম মন্ত্রক থেকে তাঁকে সরাতে অরুণ জেটলি নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ছেন।
তবে রবিশঙ্করকে সরিয়ে কর্নাটকের ইয়েদুরাপ্পা বিরোধী নেতা সদানন্দ গৌড়াকে আইন মন্ত্রকের দায়িত্ব দেওয়ার পরিণতি যে ভাল হয়নি সেটা দু’বছরে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন মোদী। পরিসংখ্যানের মতো কার্যত কর্মহীন দফতরে গৌড়াকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। রবিশঙ্করের জায়গায় নিয়ে এসেছেন মনোজ সিন্হাকে। উত্তরপ্রদেশের ভূমিহার নেতাটি রেলমন্ত্রকে প্রতিমন্ত্রী হিসাবে দাপটে কাজ করে সকলের নজর কেড়েছেন। উত্তরপ্রদেশের ছায়া মুখ্যমন্ত্রী হিসেবেও অনেকে তাঁর নাম প্রস্তাব করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ এই মনোজ সিন্হাকে টেলিকমে স্বাধীন দায়িত্ব দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, এ বার টেলিকম সমস্যার সমাধানে সরাসরি নামছেন মোদী। মনোজ সিন্হা হবেন তাঁর ফ্রন্টম্যান।
মন্ত্রিসভার দ্বিতীয় দফার রদবদলে মোদীর নিজের স্টাইল আগের চেয়ে অনেকটাই স্পষ্ট। দু’বছর আগে আমদাবাদ থেকে এসে গুজরাত ভবনে আস্তানা গেড়ে তিনি যখন প্রথম মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন তখন তাঁর কাছে নর্থ ব্লক সাউথ ব্লকের প্রশাসন ছিল অনেকটাই অপরিচিত। দিল্লির রাজনীতি বন্ধু এবং সহকর্মী অরুণ জেটলির হাত ধরেই করতে চেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। অর্থ মন্ত্রকের পাশাপাশি তথ্য মন্ত্রকেরও দায়িত্ব অরুণকে দিয়ে তিনি ভেবেছিলেন সর্বভারতীয় অভিজাততন্ত্র এবং বিশিষ্ট মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে জেটলিকে সেতু করে সম্পর্ক স্থাপন করবেন। দেশের নাগরিক সমাজের কাছে গোধরার কলঙ্ক মুছে এক নতুন অধ্যায় শুরু করবেন। কিন্তু এই দু’বছর পরে ৭ নম্বর রেসকোর্স রোডে বসে যে রদবদলটি মোদী করলেন তাতে মোহন ভাগবতের অদৃশ্য হাতের ছোঁয়া থাকলেও অন্য কোনও কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর, এমনকী জেটলিরও সক্রিয় ভূমিকা ছিল না। নরেন্দ্র মোদী দু’বছরে নিজেকে অনেকটাই সুসংহত করে ফেলেছেন। তাঁর রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করার মতো অবস্থায় কেউ নেই।
প্রধানমন্ত্রী সংসদীয় মন্ত্রীর পদ থেকে বেঙ্কাইয়া নায়ডুকে সরিয়ে নিয়ে এলেন অনন্ত কুমারকে। মোদীর মূল্যায়ন— বেঙ্কাইয়া সংসদীয় মন্ত্রী হিসেবে অসফল। অন্য দিকে, সংঘ পরিবারের ঘনিষ্ঠ, কর্নাটকের ব্রাহ্মণ নেতা অনন্তকুমার এক সময়ে ছিলেন প্রমোদ মহাজনের চেলা। প্রমোদ মহাজন যে ভাবে সংসদীয় মন্ত্রীর কাজ করেছেন, সেটা তাঁর অধীনে প্রতিমন্ত্রী হয়ে শিখে নিয়েছিলেন অনন্ত কুমার। সব দলের নেতাদের সঙ্গেই অনন্ত কুমারের বন্ধুত্ব সুবিদিত। বাদল অধিবেশনে তাঁর সংসদীয় দক্ষতা মোদীর কাজে লাগবে।
অরুণ জেটলির কাছ থেকে তথ্য মন্ত্রক নিয়ে নেওয়া হয়েছে। তার একটি কারণ হল, তিনি নিজেই তথ্য মন্ত্রক রাখতে চাইছিলেন না। বাজপেয়ী জমানায় তিনি এক বার তথ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। এবং তথ্য মন্ত্রক সম্পর্কে তাঁর নিজের মত হল, ভগবানেরও সাধ্য নেই প্রসার ভারতীর সংস্কার করে! নতুন তথ্যমন্ত্রী বেঙ্কাইয়া দিল্লির অভিজাত মহলে পরিচিত মুখ নন। অরুণের মতো দিল্লির মুখও নন তিনি। সংবাদপত্র্রের মালিকদের বন্ধু বলেও পরিচিত নন। প্রধানমন্ত্রীর উপলব্ধি, এ হেন ব্যক্তি সরকার এবং সংবাদ মাধ্যমের সেতু রচনার জন্য বেশি উপযুক্ত। বেঙ্কাইয়ার কাছ থেকে নগরোন্নয়ন না নিয়ে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে তথ্য মন্ত্রক দেওয়ায় বেঙ্কাইয়ার গুরুত্ব বেড়ে গিয়েছে। যেমন গুরুত্ব বেড়েছে প্রকাশ জাভড়েকরের। স্মৃতি ইরানির জায়গা নেওয়ার ব্যাপারে পীযূষ গয়াল এবং ধর্মেন্দ্র প্রধানের আশা থাকলেও নাগপুর তাঁদের পাশে দাঁড়ায়নি, সঙ্ঘ চেয়েছে প্রকাশ জাভড়েকরকে। এর ফলে শিক্ষা মন্ত্রকে আরএসএস-এর কর্মসূচি রূপায়ণে কোনও বাধা হবে না। স্মৃতির চেয়ে সফল ভাবে, ঢাকঢোল না পিটিয়ে প্রকাশ কাজটা করবেন বলেই মনে করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
তবে প্রধানমন্ত্রী চাইলেও পুরো মন্ত্রিসভার রদবদল যে কাজের মূল্যায়নের ভিত্তিতে তিনি করতে পেরেছেন, এমনটা বলা যায় না। রদবদলে জেটলির উপরে নির্ভরশীলতা কমানোর চেষ্টা রয়েছে, জেটলি-বিরোধী নেতা অনন্তকুমার থেকে বিজয় গয়ালদের ঠাঁই দিয়ে তিনি রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করেছেন। কিন্তু চূড়ান্ত ব্যর্থতা সত্ত্বেও উত্তরপ্রদেশের ব্রাহ্মণ নেতা কলরাজ মিশ্রকে মোদী সেই রাজ্যে ভোটের আগে সরাতে পারেননি। বয়সের লক্ষণরেখা অতিক্রম হয়ে যাওয়া কলরাজকে রাখতে বাধ্য হওয়ায় প্রবীণ নাজমা হেপতুল্লাকে বিদায় জানানোও সম্ভব হয়নি। স্বাস্থ্য মন্ত্রকের কাজ নিয়েও নালিশ অনেক। কিন্তু সঙ্ঘ পরিবারের চাপে জে পি নাড্ডারও দফতর বদলও সম্ভব হয়নি।
এক কথায়, বাদল অধিবেশনের আগে মোদী চেয়েছেন সরকারে নতুন গতি আনতে। দু’বছরে তৈরি হওয়া জীর্ণতায় আঘাত হানতে। কিন্তু যতটা সাহসী সংস্কার তিনি করতে চান, রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতায় সেই গতিতে কাজটি করা যে এখনও সম্ভব নয়, সেটাও বুঝতে পারছেন প্রধানমন্ত্রী। তাই অভিমুখ এবং চেষ্টা থাকলেও তিনি সাবধানী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy